Tuesday, August 14, 2018

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে



৪৭ নয় স্বাধীনতা
.
তোমার আমার স্বাধীনতা
রক্তের মত লাল স্বাধীনতা,
তোমার আমার স্বাধীনতা
আকাশের মত নীল স্বাধীনতা,
জেনো সংগ্রাম আনে স্বাধীনতা
জেনো ভাবনা আনে স্বাধীনতা,
৪৭ নয় স্বাধীনতা, ৪৭ নয় স্বাধীনতা
৪৭ আনেনি, দেয়নি স্বাধীনতা।।

কৈশোর থেকে শুধু শুনে গেছি তোমার নাম
ইতিহাসের পাতায় পড়ে গেছি তোমার নাম
তুমি নাম থেকে গেছ স্বাধীনতা
তুমি নাম থেকে গেছ স্বাধীনতা,
তোমার নাম নিয়ে করে খেলো কিছু লোক
তুমি নেই বলে খেলো না অনেক বেশি লোক,
খেতে পাওয়ার নাম স্বাধীনতা
কাজ পাওয়ার অধিকার স্বাধীনতা
পড়তে পারার নাম স্বাধীনতা
ভাবতে শেখার নাম স্বাধীনতা,
জেনো সংগ্রাম আনে স্বাধীনতা
জেনো ভাবনা আনে স্বাধীনতা,
৪৭ নয় স্বাধীনতা, ৪৭ নয় স্বাধীনতা
৪৭ আনেনি, দেয়নি স্বাধীনতা।

তার দুটি চোখ যেন খাঁচায় বন্দী হরিণী
মুক্তির দাবী দাওয়া জানাতে সে আজো পারে নি
তার চোখে জ্বলে ওঠো স্বাধীনতা
তার দেহে ভাষা দাও স্বাধীনতা,
যেই অশনি হানবে তার দৃষ্টি
তুমি শুকনো মাটিতে এনো বৃষ্টি,
তার ঠোঁটে কেঁপে ওঠো স্বাধীনতা
তার নখে ধার হও স্বাধীনতা,
ট্র্যাফিক থামিয়ে চুমু স্বাধীনতা
তাকে নিয়ে প্রতিরোধ স্বাধীনতা
জেনো সংগ্রাম আনে স্বাধীনতা
জেনো ভাবনা আনে স্বাধীনতা
৪৭ নয় স্বাধীনতা
৪৭ আনে নি,দেয় নি স্বাধীনতা।

( কবীর সুমন-এর  গান। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই)







সম্পাদকীয় দপ্তর- বেবী সাউ মণিশংকর বিশ্বাস সন্দীপন চক্রবর্তী
                            হিন্দোল ভট্টাচার্য শমীক ঘোষ


যোগাযোগ  ও লেখা পাঠানোর ঠিকানা - abahaman.magazine@gmail.com



লেখা পাঠাবেন অভ্রতে। মেল বডিতে পেস্ট করে অথবা ওয়ার্ড ফাইলে। কবিতা কমপক্ষে পাঁচটি পাঠাবেন। আমন্ত্রিত লেখাও অনুমোদনযোগ্য। প্রেরিত লেখা প্রকাশ পাবে কিনা, তা আমরাই মেল করে জানিয়ে দেব। অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে দুই মাস। অনুবাদ পাঠালে মূল কবিতাও পাঠাতে হবে। কোনও লেখার কোনও শব্দসীমা নেই। 

ফিরে পড়া কবিতা- পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল



আত্মকথন



চলিত ক্রিয়াপদের বাংলা আর লিখিতে ইচ্ছা হয় না। এই বাংলা বড়ো সাহিত্যিক। যদিও আমার বয়স ত্রিশ বৎসর ও ২মাস পূর্ণ হইয়াছে এবং এক্ষণে আমি রবিবারের মধ্যাহ্নে, ত্রিতলে, খাটে বসিয়া আছি, চারিদিক বেশ শান্ত, একটি কাক ডাকিতেছে—কেমন ধারণা হইতেছে যে ইহার মধ্যেই মিশিয়া আছে আমারই মরণোন্মুখতা। কোনো-না কোনো একটি সত্য বলিতে ইচ্ছা করিতেছে। আমার ব্যক্তিগত সত্য। জীবন এপর্যন্ত যতোটা যাপিত হইয়াছে, তাহার তথ্য ও চিত্রের ভিত্তিতে কিন্তু এই সত্য প্রস্তুত নয়। কেবলি মনে হইতেছে আঁটপুর বা ঐরকম কোনো একটা গ্রামের বাড়িতে বসিয়া থাকিতে পারিলে বিলক্ষণ শান্তি হইত। না, যে থাকিত সে কোনো ত্রিশবয়সী লোক নয়। তাহার বয়স কোনোমতেই সতেরোর বেশি হইবে না। সে ধুতি ও হাতকাটা গেঞ্জি পরিবে। এখন নির্জন দুপুর, কলাঝাড় পার হইয়া সে জামের বনে যাইতেছে। সেখানে কি একটি বালিকা থাকিবে না, যে তাহাকে আঁকাবাঁকা হরফে বহু সাধ্যসাধনায় একটি চিঠি দিয়াছে কিছুদিন আগে—‘কেমন আছ। আমার প্রণাম নিবে।’ তাহার মুখ ও হাবভাবের বর্ণনা, আমি, ওই সতেরো বছরের হাতকাটা গেঞ্জি ও ধুতি পরা যুবা, দিতে মনস্থ করিতেছি না; শুধু পাঠকের সঙ্গে কথা বলিতে ভাল লাগে তাই বলিব, তাহার নাম পূর্ণশশী। কতবার ভাবিয়াছি—ঐ তো সে এখনো ভাবিতেছে আজ হয়তো তাহার হাত তাহার বশ মানিবে না, আলিঙ্গন করিবে; আজ হয়তো তাহার মুখ চুম্বনে চুম্বনে পূর্ণশশীকে জানাইয়া দিবে সে ডাগর হইয়াছে, সে শহরে গিয়া জানিয়াছে; কিন্তু ঐ তাহাকে দেখা যায়, পূর্ণশশীর হাত হইতে জাম খাইতেছে যেভাবে পোষা ঘোড়ায় মানুষের নিকট হইতে দানা খায়, শুধু একটি করতল পূর্ণশশীর পদমূলে। জামবনে হাওয়া অতি ধীরে বহিতেছে। পাঠক, আপনাকে ভগবান জানিয়া বলিতেছি, আমি এ-ই। 


একটি ভাগ্যান্বেষীর বৃত্তান্ত



প্রায়শই মিটিমিটি হাসিতে ইচ্ছা করে। নানাভাবে হাসিয়া দেখিয়াছি,

হাসিলে ভাগ্যও হাসিতে শুরু করে। সে হাসি সামলানো শক্ত – তখন

আর কাঁদিয়া কূল পাওয়া যায় না। যে কাঁদে তাহার ভাগ্যও কাঁদে।

অশ্রুজল মুছিয়া ফেলিলে ভাগ্যও সমস্ত অশ্রুজল মুছিয়া ফেলে। অর্থ, সে

যাহা করিয়াছে, ঠিকই করিয়াছে। তখন ক্রোধ হয়। অদৃষ্টও রুষ্ট হইয়া

ওঠে। ক্রোধের জন্য অনুতাপ হইলে ভাগ্যও নানারূপ ঘ্যানঘ্যান করিতে

থাকে। তখন বুঝি যে ভাগ্য আমাকে ভ্যাংচায়। ভ্যাংচাইবেই। স্থির

বুঝিয়াছি যে যাহা কিছু হইবে, যাহা কিছু করিব – গণ্ডগোলই

উহার আঁতুড়, বিবাহবাসর, তীর্থ ও শ্মশান। সুতরাং প্রায়শই

মিটিমিটি হাসিতে ইচ্ছা করে, কেননা, ভাবলেশহীন থাকিয়া

দেখিয়াছি যে ভাগ্যও ভাবলেশহীন থাকে।


বিতর্ক প্রস্তাব



কী হইলে নিজেকে সফল মনে করিতে পারিতাম? এমন কোনো

সাফল্য কি রহিয়াছে যাহা হইলে বাকি জীবন নিজেকে নিশ্চিন্ত

মনে সফল বলিয়া ধারণা করা যায়? ঈশ্বরের মুহূর্ত জানিয়াছি,

ক্ষুধার মুহূর্ত জানিয়াছি, ত্রাস, প্রেম, সন্তানসুখ, বৃদ্ধবৃদ্ধার মুখের

মুহূর্ত – কিন্তু সকলি মুহূর্ত মাত্র। পুনরায় গড়াইয়া পড়িতে

হইয়াছে, ট্রাম বাস বিছানা চেয়ার সিগারেট সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী

রমণীশরীর ধরিয়া ফেলিতে হইয়াছে, শরীরকে খারাপ করিতে

হইয়াছে, শরীরকে ভালো করিতে হইয়াছে। আমি মারদাঙ্গাপ্রিয়

নয়। খুনে। সাফল্যের জন্য মারপিট করিতে পারিব না, কিন্তু

খুন করিতে পারিব। তাই আমার ক্লান্তি একজন শিকার না

পাওয়া ঘাতকের সহিত তুলনীয় – আমি জহ্লাদ, কিন্তু

কাহাকেও বধ করিবার আদেশ যেন দীর্ঘদিন আসে না। আমার

ভিতরের সংস্কৃতজ্ঞের সহিত আমার বিতর্ক চলে – সব

বৃক্ষে কি ফল ধরে? তবে কেন তুমি বলিলে, ফলেই

বৃক্ষের পরিচয়, যেখানে গাছে একটি পাতা না

থাকিলেও তুমি গাছকে গাছ বলিয়াই চেনো?





অমিতব্যয়ী



টাকা মানুষের মনের প্রতিনিধি বলিয়াই টাকায় মানুষ

রাজার মুখ মনীষীর মুখের ছাপ বসায়, দেশের

কোনো প্রিয় বৈশিষ্ট্যকে উৎকীর্ণ করে। কৃপণ এ কথা

জানে। কৃপণ মানুষের মনকে অত্যন্ত বেশি মূল্য

দেয় তাই উহার ব্যবহার রুদ্ধ করিতে চায়। কৃপণ

চায় উত্তর-মন মনুষ্যত্ব, যাহা এখনো আবিষ্কৃত হয়

নাই।







একটি বৃদ্ধের গল্প




সেই বৃদ্ধ তাঁহার কাকার কাহিনী অনবরত বলিতে থাকিতেন। তিনি

লেখাপড়ায় খুব খারাপ ছিলেন না অথচ তাঁহার সাহস ও শক্তি

নাকি বিস্তর খ্যাতি লাভ করিয়াছিল, একদা চল্লিশটি রুটি ও

আধখানা পাঁঠা খাইয়াছিলেন যখন তাঁহার বয়স মাত্র পনেরো,

মাথায় নারিকেল ভাঙিতেন এবং আটক্রোশ হাঁটিলেও কিছুমাত্র

ক্লান্ত হইতেন না। দেশী আন্দোলন করিতে গিয়া তিনি জমিদার

ও ব্রিটিশ কোর্ট উভয়কেই চটান এবং কোর্টে যখন উপস্থিত হন

তখন তাঁহার সমস্ত পিঠে ব্যাণ্ডেজ। তদবস্থাতেও কোর্ট কুড়ি ঘা

বেত চালাইবার আদেশ দেয় এবং সেই সপ্তদশবর্ষীয় যুবাটির

নিতম্বে ও উরুতে বেত পড়ে। বৃদ্ধ হাসিয়া বলিতেন, তাহা

মাস্টারের বেত নহে।

তাহার পর বৃদ্ধ সেই প্রসঙ্গে আর কিছুই

বলিতেন না। পরে জানিয়াছি তাঁহার সেই কাকার

আঠারো বছর বয়সে বিবাহ হয় এবং তিনি শ্বশুরালয়েই

বেশি সময় থাকিতেন। সেখানে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি

স্বীয় স্ত্রী, শ্বশুরালয়ের দুই দাসী, স্ত্রীর জনৈকা বিধবা

মাসির গর্ভ উৎপাদন করেন – যাহার জন্য স্ত্রী আত্মঘাতী

হন, বিধবা কাশী চলিয়া যান, দুই দাসী বেশ্যা হয়। তিনি

মদ ধরেন। কিছুকাল বাদে তিনি আগুনে পুড়িয়া মরিবার

মুহূর্তে একটি শিশুকে উদ্ধার করেন এবং ইহার কয়েকদিন

বাদে অত্যধিক মদপানে মারা যান।


ট্রেন 



যশোর, সবুজ ট্রেন, তুমি কি এখন

অন্য কোনো বালকের মর্মে এসে পড়ো?

যখের গহনা আগলায় আজ এই

উত্তর-বালক, জড়-স্মৃতি করে জড়ো

অপারগ আচার্যের আঙুলের উন্মন

উপবীত যেন, যার ব্যবহার নেই।



শৈশব, সবুজ ট্রেন, ট্রেনের সতত

শৈলজল অগ্নিশব্দ, তমসাজীবিতা…

যত্নে স্বচ্ছ হলো আজ, তবু পথ-ক্ষত

যশোরেশ্বরীর ভূমে শয়ান কবিতা

আমাকে জানায় কীর্তিনাশা-দূরদেশে

আর্ত পারাপার আজো। ইন্দ্রিয়সঙ্কুল



অতীতে। সবুজ ট্রেন, তরুর অমূল

অন্য বালকের ঘুমে, চুলে ওঠে ভেসে।




দ্বন্দ্ব অহর্নিশ : বিশ্বজিৎ রায়





রবীন্দ্রনাথই সমস্যাটির কেন্দ্রে উপনীত হতে পেরেছিলেন। ব্যক্তি ও সমূহ এ দুয়ের টানাপোড়েনের স্বরূপ না বুঝলে স্বাধীনতার অর্থ ভেদ করা যাবে না। বাহাত্তর বছর হয়ে গেছে ভাঙা স্বাধীনতার –  তবু ব্যক্তি ও সমূহের ভারসাম্য বজায় থাকে না।

মুঘলরা পূর্ববর্তী অনেকের মতো যে অর্থে এ-দেশের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, আকবর যে ভাবে ভারতীয় শাসক হয়ে উঠেছিলেন ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের যে রকমে সমীভবন ঘটেছিল সেই অর্থে ইংরেজরা এদেশের হয়ে ওঠেননি। তাঁরা বহিরাগত ও এদেশ তাঁদের উপনিবেশ। ভারত কাঁচামাল সরবরাহ করবে, ম্যাঞ্চেস্টারের কলের উৎপাদিত দ্রব্য কিনবে – বণিক আর শাসকদের দু-ফেরতা লাভ হবে। এই লাভের কলকব্জা ঢেকে রাখার জন্য তাঁরা নানা আপাত হিতবাদী কৌশল গ্রহণ  করেছিলেন। তাঁরা বলবেন আমাদের জন্য রেললাইন, কিন্তু আমাদের জন্য তো রেললাইন নয়। কাঁচামাল বন্দরে পাঠাতে হবে, প্রশাসনিক-সামরিক শাসন বজায় রাখতে হবে, উৎপাদিত দ্রব্য বন্দর থেকে বাজারে পাঠাতে হবে তারই জন্য রেললাইন। ভূমিঢাল রেললাইন পাততে গিয়ে নষ্ট হলে চাষের বারো বাজলে কিছু যায় আসে না। কেরানি তৈরির জন্যই শিক্ষা – ধুতি পরে কলে ঢোকো, অফিসের বস্ত্রের উপযুক্ত হয়ে বাইরে এসো। এই ঔপনিবেশিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার দাবি উঠেছিল – সমূহ ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দিতে হবে। এই  স্বাধীনতার দাবি অনিবার্য ও ন্যায়-সংগত।

তবে আরেকটি প্রশ্ন না-তুললে তো স্বাধীনতা তাৎপর্যহীন হয়ে যায়। শাসকের মুখ বদল হল কিন্তু শাসন পদ্ধতির! অর্থাৎ ঔপনিবেশিকতার মৌতাত কি গেল ? নাকি সাহেবদের ফেলে যাওয়া জুতোতেই ভাঙা স্বাধীন দেশের শাসক পা গলালেন? প্রশ্নটা স্বাধীনতার অনেক আগেই স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উত্থাপন করেছিলেন। তাঁর এ প্রশ্ন করা সাজে। প্রশ্নটা বাইরে থেকে করেননি। ভেতর থেকে করেছিলেন। দু-দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা যিনি তিনি স্বাদেশিক, নেশনবাদী নন। স্বাদেশিকতার সীমা কোথায় শেষ হয় আর নেশনের প্রহার কোথায় শুরু হয় সেই ভেদরেখাটিকে নির্দেশ করাই তাঁর জীবনের শেষ দুই-দশকের মুখ্য কাজ। 

রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শাসকের কল-কব্জাগুলোকে পছন্দ করতেন না, ব্যক্তিজীবনে সে-সব যতটা সম্ভব পরিহার করেছিলেন। জাতীয়তাবাদীরা সমূহকে স্বাধীন করতে গিয়ে যেখানেই ঘুরপথে পুঁজির দিকে, নেশনের যুক্তির পক্ষে সেখানেই রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত। আর বিরক্ত সেখানে, যেখানে ব্যক্তি চোখ বন্ধ করে দেশীয় নেতার অনুসারী। চরকা কাটেন যে গান্ধী তাঁর সে কৃত্য ব্যক্তিগত উপলব্ধির ফল। গান্ধীবাবাকে অনুসরণ করে যে সমূহ চরকা কাটে তাঁদের  দেশপ্রেমের যান্ত্রিক পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পায়নি। গান্ধীবাদী নন যাঁরা সেই সহিংসপন্থীদের আত্মত্যাগের প্রতি রবীন্দ্রনাথ সশ্রদ্ধ। সহিংসপন্থা যেখানে নিরপরাধ সাহেব-মেমদের প্রাণহরণ করে, যেখানে কেবল বন্দেমাতরম্‌ ধ্বনি সহিংস-বোধকে নির্বিচারে উদ্দীপিত করে সেখানে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা মুখর। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সরব আবার স্বদেশের নামে হিংসা যেখানে নিরপরাধের  প্রাণ নেয় সেখানেও তিনি প্রতিবাদী। রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই একা হয়ে যান।

তাঁর এই একাকিত্বে যাঁরা সঙ্গে ছিলেন তাঁরা এদেশের মানুষ, অন্যদেশেরও। বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথ এমন এক মুক্ত পরিসর হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন যেখানে স্বাধীনতা ব্যক্তি-উপলব্ধি সঞ্জাত বলেই সামূহিকতার নির্বিচার ছাঁচ চেপে শরীর মনে চেপে বসবে না। অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন তিনি সাফল্য তাঁর আসেনি। সাফল্য আসেনি বলে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাটাই ভুল এ-বলার মানে হয় না।  রাশিয়ায় গিয়ে তীর্থদর্শনের অভিজ্ঞতা হল তাঁর, আবার এও বুঝলেন রাশিয়া যদি ব্যক্তিমানুষকে ভুলে সমাজতন্ত্রের ছাঁচটিকে বড়ো করে তোলে তাহলে এদেশ ভাঙবে। দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ – সমাজতন্ত্রের জুলুমের ফল তিনি দেখে যাননি, যথার্থ অনুমান করতে পেরেছিলেন। বিশ্বভারতীর আদর্শ নিয়ে জুলুমবাজি করেননি বলেই চকিত সংক্ষিপ্ত সামূহিক সাফল্যের মুখ সে প্রতিষ্ঠান দেখেনি। তবে এই প্রতিষ্ঠান অনেক মানুষ তৈরি করেছিল যাঁরা রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন ও আদর্শকে সম্প্রসারিত করেছেন।

সমূহকে একদিকে চালনা করলে নানা লাভ হয়। কে আর তা অস্বীকার করবে? স্বাধীনতার নামে, রাষ্ট্রগত স্বাধীনতার নামে সেই একদিকেই চালনা করা হয় সমূহকে। চালনা করা সহজ হয় ভয় দেখিয়ে, ভুলিয়ে রেখে। পুরনো চিহ্নগুলোকে  নতুন প্রেক্ষিতে বসিয়ে দেওয়া হয়। ইউ টিউবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে রচিত স্বদেশগীতি শুনতে গেলে ইদানীং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে।  ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির পুতুল হয়ে ওঠেন অনেক সময়। রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকার জন্য মাঝে মাঝেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা লাগিয়ে দেওয়া হয় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে। সেই খেলায় নাগরিকসমূহকে উত্তেজিত ভাবে সামিল করার জন্য পুরনো স্বদেশগীতি নতুন বোতলে ঢুকিয়ে দেওয়ার দস্তুর চোখে পড়ে। সমূহকে একদিকে চালাতে পারলেই তো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হস্তান্তর, স্বাধীনতা প্রাপ্তি। তারপর? তারপর নানাভাবে ক্ষমতার নখ-দাঁত বাইরে আসে, ‘সাম আর মোর ইক্যুয়াল’ এই সমীকরণ আবার তৈরি হয়।  এই প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে  ব্যক্তি সরব হন।

নিজের বোধ জাগ্রত না হলে, নিজের লোভ শমিত না হলে, শাসন ও ক্ষমতাতন্ত্রের অংশ হয়ে ওঠেন মানুষ। ক্ষমতা সুবিধে ও সুযোগ দেয়।  তাকে আমরা স্বাধীনতা বলে ভাবি – তা স্বাধীনতা নয়। ক্রমে সেটা বোঝা যায়। ক্ষমতা ক্ষমতাভোগীর দিকে বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে ধেয়ে আসে।

রবীন্দ্রনাথের  নিজস্ব প্রকল্পটি তাই ব্যক্তির আত্মবোধ কেন্দ্রিক। আত্মবোধ যাঁর আছে  তিনি সমূহের অংশ হবেন। স্বদেশ তাঁকে অর্জন করতে হবে, জন্মসূত্রে মুফতে স্বদেশ মিলবে না। যা মিলবে তা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ভাবনা ও কতগুলি বিধি। সেই ভাবনা ও বিধি মাননীয় নেশন হতে পারে, স্বদেশ নয়।  নিজের বোধে নিজের কাজে ব্যক্তি মানুষ স্থানিকতার সূত্রে, বৈশ্বিকতার প্রেক্ষিতে যখন সচেতন ভাবে সমূহের অংশ হন তখনই স্বাধীনতার ধ্যান শুরু হয়। এ ধ্যান ক্রিয়ামূলক, শেষ হয় না। চলে, চলতেই থাকে আজীবন। তাই রোজ স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য কাজ করতে হয়। দেশের স্বাধীনতা দিবস পালন এক আর স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য নিত্যদিন সচেতন থাকা আর এক। এই সচেতনতা না থাকলেই নির্বিচারে রাষ্ট্রিক ছাঁচ মাথায় চেপে বসবে। রাষ্ট্রিক ছাঁচকে চাপে রাখা চাই, প্রশ্ন করা চাই, ভালো কাজ করলে বাহবাও দেওয়া চাই। সম্পর্কটা দ্বন্দ্বমূলক – দ্বন্দ্ব মানে মিলন ও কলহ। সেই মিলন কলহের টানাপোড়েনে নেশনকে স্বদেশ করে তোলাই ব্যক্তি নাগরিকের নিত্য দিনের কাজ।           

স্বাধীনতা এক খুড়োর কল : দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়





ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে সুচিত্রা-উত্তমের বাংলা ছবি দেখতে যেতুম। সেই রকমই কোনও একটি সিনেমা দেখার পর জীবনের প্রথম কবিতাটি লিখেছিলুম।  ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চীর সম্ভোগদৃশ্যের প্রতিক্রিয়ায় না-হলেও, বঙ্গদেশের দুই কিংবদন্তী নায়ক, নায়িকার ফিল্মি প্রণয়ঘটিত অভিঘাত সেই লেখার উদ্দীপক ছিল। বাল্মীকির সঙ্গে আমার মিল ততটুকুই। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হল, কবিতাটি লিখিত হওয়ার পর, শিরোনাম দিয়েছিলাম স্বাধীনতা। সেই থেকেই স্বাধীনতা বিষয়টিকে বড্ড গোলমেলে বলে মনে হয়।
কয়েক দিন আগে ইউটিউব খুলে একটি তথ্যচিত্র দেখছিলুম। মোজাম্বিকের একটি উপজাতি, হিম্বা। সেই কুলের মহিলাদের রীতি হল ঊর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত রাখা। তথ্যচিত্রটি দেখে আমার এক বান্ধবীর খেদোক্তি, ইস, ওরা কত স্বাধীন। আমরা ইচ্ছে করলেও ওই রকম হতে পারব না! বস্তুত, আপাত গুরুত্বহীন, অগভীর, খানিকটা যেন হাস্যকর এই মন্তব্য থেকেই হোঁচট খাওয়ার শুরু। স্বাধীনতা বলতে তবে কী বুঝব?
 স্কুলের পাঠ্যবই পড়ে স্বাধীনতা বলতে আমরা কোনও দেশের সার্বভৌমত্বকে বুঝি। রক্তক্ষয়ী সুদীর্ঘ সংগ্রামের ভিতর দিয়ে দুশো বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছে আমার দেশ, স্বাধীন হয়েছে। এই রকম ঢপের একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়া হয় ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু, কখনওই সেই স্বাধীনতার স্বরূপ চেনানো হয় না। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের, আত্মত্যাগের ইতিহাসকে খর্ব না-করেই বলছি, রাতের অন্ধকারে যে স্বাধীনতা পাওয়া গেল, সেই স্বাধীনতা একটি মস্ত বড় প্রহসন নয় কি? একটা দেশ ভেঙে দুটো হল। আমাদের শরীরে ধর্মের লেবেল সাঁটা হল, আমরা ধর্মের দাস হলাম। এও তো বেড়ি পরা, শৃঙ্খলিত হওয়া। স্বাধীনতা, ফুঃ। ঋত্বিক কুমার ঘটকের যুক্তি তর্ক আর গল্প স্মতর্ব্য।
খবরের কাগজে চাকরি করতে গিয়ে জেনেছি, সব লেখা যায় না। দুর্নীতি চিনেও, অনেক ক্ষেত্রেই না-চেনার ভান করে থাকতে হয়, কলমে কন্ডোম পরাতে হয়। এও তো এক পরাধীনতা। অর্থাৎ, স্বাধীনতা বস্তুটি অনেকটাই যেন খুড়োর কল।
সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখা বিপ্লবীরাও আজ বুঝতে পেরেছেন, ওখানে মানুষের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকে না। অন্যদিকে ধনতান্ত্রিক সমাজে সব-পেয়েছি গোছের জীবন মোহগ্রস্ত করে তোলে। মনে হয়, এই বুঝি স্বাধীনতা। ক্রয়ের স্বাধীনতা, বিলাস-ভোগের স্বাধীনতা। কিন্তু, সত্যিই কি তাই? আমরা কী পরব, কতটুকু পরব, কী খাব, কতটুকু খাব, কী হাগব, কতটুকু হাগব সবই কি ঠিক করে দিচ্ছে না কর্পোরেট দুনিয়া? আমাদের মূল্যবোধ পর্যন্ত তৈরি হয় বণিকসমাজের ইচ্ছানুসারে। তা হলে কোথায় স্বাধীনতা? কোন নির্জন দ্বীপে তার বাস?
আদর্শ আঁকড়ে থাকা ষাট দশকের কিছু মানুষকে আমি চিনতুম। তাঁরা প্রত্যেকেই ওই আদর্শের জাঁতাকলে নিয়ত পিষ্ট হচ্ছিলেন, চালিত হচ্ছিলেন  বলে মনে হত। ব্যক্তিসত্তা বলে কিছুই থাকত না। এও কি পরাধীনতা নয়?
স্বাধীনতা তা হলে কী? মানুষের নিজের ইচ্ছানুসারে চলার অধিকার? নাকি, প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার? এখানে অধিকার নামক আরও একটি গোলমেলে বিষয় চলে আসে। এই অধিকার বস্তুটির স্বরূপ কী হবে, তা স্থির করবে কে? ক্ষমতাসীন কিছু মানুষ? তাঁরাই বলে দেবেন, আপনার অধিকারের দৌড় কতটুকু? মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষমতাসীন মানুষই ঠিক করে দিচ্ছেন সাধারণের স্বাধীনতার পরিধি! পরাধীন ভারতে এক রকম, এখন আরেক রকম। সাধারণের পায়ে বেড়ি পরানো আছেই।
আরও একটি ঢপের চপ হল গণতন্ত্র। স্বাধীন মানুষ আসলে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় বসবাসকারী মানুষ। এই ধারণা মহান, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু, সেই মহত্ব পুঁথিতেই আবদ্ধ। তার প্রয়োগ কোনও দেশেই সুষ্ঠ নয়, ভারতে তো নয়ই।
এই যে একটি সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে গর্ববোধ করি, তাও কতটা যথার্থ? এই দেশ প্রকৃত বিচারে কতটা স্বাধীন? বিশ্বের কিছু নিয়ন্ত্রক সংস্থার মর্জি মতো চলতে কি বাধ্য নয় এই দেশ, তার সরকার? ঢপ ঢপ মস্ত ঢপ এই স্বাধীনতার বুলি।
সিনেমা হলের পর্দায় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে দেশভক্তি জাগ্রত করার চেষ্টা, আর প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া মানুষের স্বতস্ফূর্ত দেশপ্রেম কখনওই এক বস্তু নয়, হতে পারে না। কিন্তু, প্রকৃত স্বাধীনতা বস্তুটি খায়, না মাথায় মাখে?
আমাদের দেশে স্বাধীনতা যেন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাক্ স্বাধীনতা বলে কিছুই আর থাকছে না। নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সংবাদপত্রের অধিকার। ধর্ম, জাতপাতের রাজনীতির নোংরা খেলায় স্বাধীনতা কলুষিত হচ্ছে প্রতিদিন।
গোটা বিশ্বের পরিস্থিতিও আশাপ্রদ নয়। কত মানুষের কোনও দেশ নেই, শরণার্থী হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয় খুঁজতে হচ্ছে চরম হীনম্মন্যতায়। ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতা আজ  অলীক এক ধারণামাত্র।
জন লেননের একটি গানের কথা মনে পড়ে যায়।
মনে করো কোনও দেশ নেই। এই মনে করাটা কোনও কঠিন কাজই নয়। কোনও হানাহানি, মারামারি থাকবে না, থাকবে না কোনও ধর্ম। বিশ্বের সব মানুষ শান্তিতে জীবন কাটাবে।
তুমি ভাবতে পারো এই স্বপ্ন শুধু আমিই দেখি। কিন্তু, জেনো, আমি একা নই। আমি আশা করি এক দিন তুমিও আমারই মতন স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। এই পৃথিবী সেইদিন হবে সীমান্তহীন।
পাশাপাশি আরও একটি গানের কলি মনে পড়ে। মৌসুমী ভৌমিকের সেই গানে কী তীব্র শ্লেষ, যন্ত্রণা। কোথায় যেন কাঁদছে মানুষ...মানুষ বড় নিঃসহায়!
সত্যিই আজ বড় নিঃসহায় মানুষ। দিশাহীন, আদর্শহীন চূড়ান্ত পরাধীন! তাই, স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু, স্বপ্ন দেখানোর কোনও মানুষ নেই। পৃথিবী আজ, আক্ষরিক অর্থেই, অভিভাবকহীন।
তবু মনে হয়, এমন কেন সত্যি হয় না, আহা:

“Imagine no possessions

I wonder if you can
No need for greed or hunger
A brotherhood of man
Imagine all the people
Sharing all the world...”

ক্রোড়পত্রের কবিতা: 'বাংলা বাজার' সোনালী চক্রবর্তী


ক্রোড়পত্রের কবিতা






 হ্যালুসিনেশান


প্রবল উষ্ণতা আর সীমাহীন নেশা,
দুই এর অনুভব দ্বন্দ্বহীন সহোদরা।
অজস্র বিন্দু ঝাঁক বেঁধে বেঁধে
 ক্রমশঃ ছাইছে বঙ্গদেশ,
নাসা জানাচ্ছে এশিয়াটিক এরোসল,
ব্যাক্তিগত টেলিস্কোপের খবর,
তাদের দুই পা ফ্ল্যাশের তীব্রতা অনুযায়ী,
অজস্র মঞ্চে চলমান,আর,
এক হাতের ভাঁজে শৌখিন কলমদান।
শাতিল ইউনিফর্ম মাস্ক সরিয়ে,
প্রজাতি বিচারের আগেই,
তাদের আস্তিন থেকে ছোঁড়া বিষাক্ত আয়ুধে,
ভাঙলো লেন্স,
সংজ্ঞাহীন নির্বাসনের আগে মস্তিষ্ক 
নিয়েছিল শুধু-
"ধ্বংস করো,পুড়িয়ে দাও,
গোষ্ঠীহীন একাকী উন্মাদ,
লিখতে জানে......"


 সহকবি 


গভীর,ভীষণ গভীর থেকে,
অনেকক্ষণের একটা হাগ,
শেষ দেখা হয়েছিল,
বোধহয়,বছর আড়াই আগে।
বদলেছি কে কতটা,
এখন কে কোথায়,
এসব আর চিন্তায় আসেনা।
জিয়া নস্টাল এখন শুধু
সাদা কালো ফটোগ্রাফের 
গবেষণামূলক প্রদর্শনীতে 
আর মথ জারিত সাহিত্যে।

অনুষ্ঠান,পাশাপাশি আসন,
যখন তুমি স্পটলাইট,আমি দর্শক,
এবং ভাইসি ভার্সা।
এইসব কাব্যসভার একটা দুর্ধর্ষ গুন আছে,
নখ দাঁত লুকিয়ে কিভাবে
সৌজন্য প্রদর্শন করতে করতে,
আদতেই জড়ভরত হয়ে যেতে হয়,
সেই প্রশিক্ষণ গুলো অজান্তেই পাওয়া হয়ে যায়।

হলের এয়ার কন্ডিশন অফ হলে,
উদ্যোক্তা আর সর্বাধিক ঘনিষ্ঠরা
একসঙ্গে বেরোয়,
সেল্ফি,ওয়াটস্যাপ নম্বর,চা,
মিনিট দশেক বড়জোর,
এলাকা মরু সাহারা।

তোমার ইচ্ছে ছিলো হয়তো আকস্মিকতার,
যা জন্ম দেবে দীর্ঘ,রিলিজ না পাওয়া,
কোনও সিনেমার শুটিং পর্বের।
আমার অনায়াস আয়ত্ত
নিজেকে কৈফিয়তহীন খুলে নেওয়ার বাস্তবতা।
বলে এসেছি,নিরানব্বই পেরাও,
একশো তে আছি।
এ কথায় অরোরা বেরিয়ালিস দেখা যায়না,
তবে বাতিঘরের আলেয়া নাবিক মাত্রেই দেখে থাকে,ব্যতিক্রম ঘটেনি ।

এসব কোনও ঘটনা নয়,
বিদ্বজনেরা বলেন,কবিতায় ঘটনা থাকেনা।
প্রতি মুহূর্তেই কবিতা থাকে,
অথবা,প্রতি কবিতাই একটি করে মুহূর্ত।
কবিতা কখনও সত্যি হয়?

Monday, August 13, 2018

হয় 'গ্ল্যামারাস পরাধীনতা', নতুবা মুহূর্তের স্বাধীনতা সংগ্রামী : কিশোর ঘোষ








Freedom can be three types... The first is freedom from, the second is freedom for, and the third is just freedom.
(Osho, The book of wisdom, chapter 3.)

আমি চাপা স্বরে নিজেকে বললাম, কাল রবিবার, কাল স্বাধীনতা দিবস
কুনাল বলল, কী বলছ?
তখন সন্ধে যাচ্ছে রাতের দিকে সাড়ে আটটার কাছাকাছি বাজে অফিস ছুটির পর আমি আর আমার আড়াই মাসের অফিস-বন্ধু (কলিগ) কুনাল যাচ্ছি ফুলবাগানের হরিয়ানা মোড় সেখান থেকে বাস হাউসিঙ স্টপে নামব তারপর উত্তরায়ণের গা ধরে ট্রাম লাইনের উপর দিয়ে অনেক স্বাধীনতা আর পরাধীনতার দোকান-বাড়ি, মানুষ, শিশু, কুকুর, গাড়িঘোড়া দেখতে দেখতে হাঁটব লাইন টপকে উল্টোডাঙা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরব দু'জন কুনাল যাবে বালি আমি মধ্যমগ্রামের বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে... কেন? কারণ বাড়ির দিকে, বাড়িতে মাঝে মাঝে টুকরো স্বাধীনতার মুহূর্ত ওড়ে!
হরিয়ানা মোড়ে এসে কুনাল বলল, 'চলো, দেরি যখন হয়েইছে, তখন একটু চা-সিগারেট খাব'
আমি বললাম, 'হ্যাঁ, মুহূর্তের স্বাধীনতা!'
চায়ের দোকানে দু'কাপ চা বলে ভারী গলায় কুনাল বলল, 'কী বলছ বুঝতে পারছি না!'
আমি রুমালে মুখের ঘাম মুছে বললাম, 'প্র্যাকটিস করছি আগামীকাল রবিবার পাঁচদিনের পরাধীনতার পর তো, কাল মুহূর্তের স্বাধীনতা নিয়ে লিখব হিন্দোলের ওয়েবম্যাগের জন্যে'
'হিন্দোল কে?'
'কবিতার প্রেমিক'
'মানে তোমার কবি বন্ধু হেয়ালি করছ কেন?'
'এখন তো অফিসে নেই, ইন্টারভিউ দিচ্ছি না, দোকান বাজার করছি না, 'বড়' কবিদের সঙ্গে কথাও বলছি না মানে শরীরের স্বার্থ নেই ফল মনকে চান্স দিচ্ছি যদি সে খানিক ক্ষণ আত্মা হতে পারে'
চা এগিয়ে দিল কুনাল চুমুক দিলাম আমি গরম চায়ে জিভ পুড়ল আমি জোরসে বললাম, 'পেয়েছি পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি শাল্লা!'
কুনাল অবাক হয়ে জানতে চাইল, 'কী?'
'শরীর থেকে মন, মন থেকে আত্মা হতে পারলেই স্বাধীনতা গো ফর গোলের (লক্ষ্য) জীবনে বেশিক্ষণ হবে না হয়তো এক মিনিট, না না অতটাও না, ধরো সেকেন্ড তিরিশেক, তারচেয়েও কম এক তারা-খসা মুহূর্ত সময় ছেড়ে সময়হীনতায় যেতে পারলেই 'অ্যাবসুলুট ফ্রিডম'
চায়ের ভাড় ডাস্টবিনে ফেলে সিগারেট ধরালাম আমরা হাওয়ায় ধোয়া ধোয়া স্বাধীনতা ছেড়ে বললাম, এই যে সময়টায় দাঁড়িয়ে আছি এটাই স্বাধীনতা। অফিসের দায়িত্ব আর বাড়ির কর্তব্যের মাঝখানে ভেসে ওঠা চর, যার নাম হরিয়ানা মোড়। তোমার কী মনে হয়?'
কুনাল বলল, 'ঠিকই।'
আমি ভাবি, কুনাল কি ধরতে পারল যা বললাম। ধরার কথা। কারণ সে মাঝে মাঝে ট্রেক করে। বেড়াতে যাওয়ার অভ্যেস আছে। বাঘ-দেখা-টুরিস্ট না। বরং সে শহরে হারিয়ে ফেলা নিজের সঙ্গে দেখা করতে যায় পাহাড়ে, সমুদ্রে। তাছাড়া মুখের উপর সোজা কথা বলতে জানেকথা বলার সময় এক রকমের স্বাধীনতা নেয়। অফিসের বড় কর্তাদের সঙ্গেওকুনাল হাই হ্যালোকে নয়, এফিসিয়েন্সিকে গুরুত্ব দিতে চায়। কিন্তু কর্মসংস্কৃতি পরাধীন হচ্ছে দিকে দিকেভালো বাঁচার স্বাধীনতা দিচ্ছে কৌশল। প্রশ্ন উঠতে পারে---ভালো বাঁচা কাকে বলে? উত্তর যদি হয় 'স্বাধীন ভাবে বাঁচা'তবে পরের প্রশ্ন---সেই বাঁচা কি কৌশলে মেলে? উত্তর---না। কারণ ঘর থেকে কর্মজীবন, আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠায় যাকে প্রতি মুহূর্তে 'রাজনীতি' করতে হয়, সে তো পরাধীন! মায়া-মোবাইলের কাছে পরাধীন, দোতলা বাড়ি, মার্বেলের মেঝে, সোনার গয়না, পাসবুকের আপডেট অংকের কাছে, পুরস্কার মঞ্চের কাছে, প্রতিদিন বিউটি পার্লারে যাওয়া বউয়ের স্তনের কাছে সে পরাধীন ইগোর পুরুষ। সে জানে না, কিন্তু তার স্বাধীনতা হল 'গ্ল্যামারাস পরাধীনতা!'

দুই
'By freedom is not meant any political, social or economic freedom. By freedom is meant freedom from time, freedom from mind, freedom from desire. The moment mind is no more, you are one with the universe, you are as vast as the universe itself.  
' (Osho, The dhammapada: The Way of the Buddha, Vol 1, chapter 9)
 
সোনা বল করল। বিল্টু ব্যাট চালাল। ব্যাটের কানা নিয়ে বল শূন্যে উঠল লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে। আমি পয়েন্ট থেকে শরীর ছুড়ে দিলাম অনন্তে। বাঁ হাতে তালুবন্দি বল কিংবা একটা মুহূর্ত। ক্যাচ লুফে আছড়ে পড়লাম পাড়ার মাঠের সবুজ ঘাসে। আউট। আনন্দে বন্ধুরা ঝাপিয়ে পড়ল আমার উপর
ছোটবেলা থেকে প্রথম বড়বেলা অবধি এরকম কত স্বাধীন মুহূর্ত চেখেছিব্যাট করতাম খুব খারাপ, বল করতাম মোটামুটি। কিন্তু দুর্দান্ত ফিল্ডার ছিলাম। শার্প আই সাইট। ইনবর্ন বডি রিফ্লেক্স। আর আগুপিছু না ভাবা সাহস। (কারণ তখনও ভয়-অভিজ্ঞ নয় 'আমি')। যাক গে, আসল কথা হল ক্যাচ লোফার ওই সময়। মানে ওই সময়হীনতা!
আজ বুঝতে পারি খেলার মাঠেই পেয়েছিলাম প্রথম 'সঙ্গমসুখ'। ক্রিকেটে ক্যাচ ধরার সময়। ওই যতক্ষণ আমি আর বল আল্ট্রা মোশানে দু'জনে দু'জনের দিকে এগোচ্ছি...। বল যতটা যোনি, আমিও ততটা লিঙ্গ। হাতবন্দি বীর্যপাত। স্বাধীনতার চরম। ওই দুই কী তিন সেকেন্ড মহাশূন্যে কাটানো। ওই হল 'নো মাইন্ড'। চিন্তার বাইরে, চেতনার স্বাধীনতা। তখন আর জন্ম নিয়ে ভাবিত নই, মৃত্যু নিয়ে ভাবছি না। স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স ভুলে মেরেছি। কেবল ইগো থেকে অনন্তে উঠে, ক্ষণিকের অনন্তকাল সাঁতরে ইগোর অভিকর্ষে নেমে আসা। ফুটবল মাঠে, রাইট আউট দিয়ে দৌড়চ্ছি, দৌড়চ্ছি কিন্তু স্বাধীনতার দিকে। ডিফেন্ডারদের লাথি খেয়েও থামছি না। ১১টা থেকে ৪টে অবধি স্কুল করেছি। স্কুলই বটে। বিদ্যালয় তো গোটা পৃথিবী---বিশ্ববিদ্যালয়। পরাধীন সিলেবাস নেই যেখানে। নিজের মতো পড়। উঠোনের পোকাধরা গন্ধরাজ পড়ছি, লেবুতলার ছায়া, দড়িতে ঝোলানো খুটতুতো বনের টেপ জামা, মেজো জেঠির ঘোমটা দিয়ে ফুল তোলা দৃশ্য, বর্ষাকালে কেন্নো হাঁটছে দেওয়ালে, বাবার মুখাগ্নি করলাম নিমতলায়। সারাদিন অফিস ঠেঙিয়ে রাতে রান্না করছে অন্নপূর্ণা মা। তারপর ওই দূরে অ্যাডাল্ট সমুদ্র, দেখি ঝাউবনকে কারা প্রাপ্তবয়স্ক করে রেখে গেছে। মদের বোতল আর কন্ডোমের প্যাকেট বালিতে এলোমেলো। বউবাজার দিয়ে হাঁটছি কলেজ বন্ধুর সঙ্গে। রাস্তার দু'পাশে নকল মুমতাজ-মিনাক্ষী-রানি-রম্ভা-ক্যাটরিনারা দাঁড়িয়ে আছে, ওদের খোলা চুল, উন্মুক্ত স্তনের বিষ আঁকছি লুকিয়ে, মিটিং-মিছিল, বৃষ্টিতে আটকে পড়া চায়ের দোকান, ছাদে বসে দেখা রাতের তারাদের আড্ডা, বাস-ট্রাম-অটো, টিভি-কাগজ-ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ, এবং কোন ছোটবেলা থেকে কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা। স্বাধীন হওয়ার অসুখ। ফলে জীবন হলেও কেরিয়ার হল না!
তিন
'To know it is to be free, free from all prisons: the prisons of the body, the prisons of the mind, the prisons that exist outside you.' (Osho, The messiah, Vol 2, chapter 2)
তবু, মুহূর্তকে ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তই বা কজন পায়! এই যে সূর্যদয়ের গন্ধ, বেঁচে থাকার গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জ করছে পাখি-হাওয়া-কাচা রোদ। দুপুরের অবৈধ দোতলায় শাখা-সিঁদুর রঙের স্কার্ট, সাইকেল নিয়ে লাল আপেল, কালো আঙুরের স্কুলে ঢুকে পড়া, জীবন বকা দিচ্ছে মাঝে মাঝে। আর বৃদ্ধ ফেড়িওলার ঘামে যে দুপুর স্নান করছে। রোটি-কাপড়া-মকানের চক্করে লুকোনো কান্না, না বলা প্রেম, ঢেকে রাখতে হয় ধরনের স্নেহ, মুখ খুললে বিপদ রঙের রাগ, ঘৃণা। এবং বিষাদ। এই সবটা লেখার স্বাধীনতা দেয় যে মুহূর্ত তার নাম কবিতা। একটা লাইন। দুটো শব্দ। শব্দব্রহ্ম! যতক্ষণ তার মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকা যায়, ধ্যান হয়ে থাকা যায় ততক্ষণই জীবন।  
Buddha is talking about the reality---the real freedom. He calls it nirvana. The word 'nirvana' is very beautiful; it means cessation of self---consciousness, utter cessation of the self, the naked state of egolessness. It brings great ecstasies, great harvest; inexhaustible treasures it brings.
(Osho, The Dhammapada; The way of the Buddha, Vol 1, chapter 9)
 

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...