Tuesday, August 14, 2018

ফিরে পড়া কবিতা- পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল



আত্মকথন



চলিত ক্রিয়াপদের বাংলা আর লিখিতে ইচ্ছা হয় না। এই বাংলা বড়ো সাহিত্যিক। যদিও আমার বয়স ত্রিশ বৎসর ও ২মাস পূর্ণ হইয়াছে এবং এক্ষণে আমি রবিবারের মধ্যাহ্নে, ত্রিতলে, খাটে বসিয়া আছি, চারিদিক বেশ শান্ত, একটি কাক ডাকিতেছে—কেমন ধারণা হইতেছে যে ইহার মধ্যেই মিশিয়া আছে আমারই মরণোন্মুখতা। কোনো-না কোনো একটি সত্য বলিতে ইচ্ছা করিতেছে। আমার ব্যক্তিগত সত্য। জীবন এপর্যন্ত যতোটা যাপিত হইয়াছে, তাহার তথ্য ও চিত্রের ভিত্তিতে কিন্তু এই সত্য প্রস্তুত নয়। কেবলি মনে হইতেছে আঁটপুর বা ঐরকম কোনো একটা গ্রামের বাড়িতে বসিয়া থাকিতে পারিলে বিলক্ষণ শান্তি হইত। না, যে থাকিত সে কোনো ত্রিশবয়সী লোক নয়। তাহার বয়স কোনোমতেই সতেরোর বেশি হইবে না। সে ধুতি ও হাতকাটা গেঞ্জি পরিবে। এখন নির্জন দুপুর, কলাঝাড় পার হইয়া সে জামের বনে যাইতেছে। সেখানে কি একটি বালিকা থাকিবে না, যে তাহাকে আঁকাবাঁকা হরফে বহু সাধ্যসাধনায় একটি চিঠি দিয়াছে কিছুদিন আগে—‘কেমন আছ। আমার প্রণাম নিবে।’ তাহার মুখ ও হাবভাবের বর্ণনা, আমি, ওই সতেরো বছরের হাতকাটা গেঞ্জি ও ধুতি পরা যুবা, দিতে মনস্থ করিতেছি না; শুধু পাঠকের সঙ্গে কথা বলিতে ভাল লাগে তাই বলিব, তাহার নাম পূর্ণশশী। কতবার ভাবিয়াছি—ঐ তো সে এখনো ভাবিতেছে আজ হয়তো তাহার হাত তাহার বশ মানিবে না, আলিঙ্গন করিবে; আজ হয়তো তাহার মুখ চুম্বনে চুম্বনে পূর্ণশশীকে জানাইয়া দিবে সে ডাগর হইয়াছে, সে শহরে গিয়া জানিয়াছে; কিন্তু ঐ তাহাকে দেখা যায়, পূর্ণশশীর হাত হইতে জাম খাইতেছে যেভাবে পোষা ঘোড়ায় মানুষের নিকট হইতে দানা খায়, শুধু একটি করতল পূর্ণশশীর পদমূলে। জামবনে হাওয়া অতি ধীরে বহিতেছে। পাঠক, আপনাকে ভগবান জানিয়া বলিতেছি, আমি এ-ই। 


একটি ভাগ্যান্বেষীর বৃত্তান্ত



প্রায়শই মিটিমিটি হাসিতে ইচ্ছা করে। নানাভাবে হাসিয়া দেখিয়াছি,

হাসিলে ভাগ্যও হাসিতে শুরু করে। সে হাসি সামলানো শক্ত – তখন

আর কাঁদিয়া কূল পাওয়া যায় না। যে কাঁদে তাহার ভাগ্যও কাঁদে।

অশ্রুজল মুছিয়া ফেলিলে ভাগ্যও সমস্ত অশ্রুজল মুছিয়া ফেলে। অর্থ, সে

যাহা করিয়াছে, ঠিকই করিয়াছে। তখন ক্রোধ হয়। অদৃষ্টও রুষ্ট হইয়া

ওঠে। ক্রোধের জন্য অনুতাপ হইলে ভাগ্যও নানারূপ ঘ্যানঘ্যান করিতে

থাকে। তখন বুঝি যে ভাগ্য আমাকে ভ্যাংচায়। ভ্যাংচাইবেই। স্থির

বুঝিয়াছি যে যাহা কিছু হইবে, যাহা কিছু করিব – গণ্ডগোলই

উহার আঁতুড়, বিবাহবাসর, তীর্থ ও শ্মশান। সুতরাং প্রায়শই

মিটিমিটি হাসিতে ইচ্ছা করে, কেননা, ভাবলেশহীন থাকিয়া

দেখিয়াছি যে ভাগ্যও ভাবলেশহীন থাকে।


বিতর্ক প্রস্তাব



কী হইলে নিজেকে সফল মনে করিতে পারিতাম? এমন কোনো

সাফল্য কি রহিয়াছে যাহা হইলে বাকি জীবন নিজেকে নিশ্চিন্ত

মনে সফল বলিয়া ধারণা করা যায়? ঈশ্বরের মুহূর্ত জানিয়াছি,

ক্ষুধার মুহূর্ত জানিয়াছি, ত্রাস, প্রেম, সন্তানসুখ, বৃদ্ধবৃদ্ধার মুখের

মুহূর্ত – কিন্তু সকলি মুহূর্ত মাত্র। পুনরায় গড়াইয়া পড়িতে

হইয়াছে, ট্রাম বাস বিছানা চেয়ার সিগারেট সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী

রমণীশরীর ধরিয়া ফেলিতে হইয়াছে, শরীরকে খারাপ করিতে

হইয়াছে, শরীরকে ভালো করিতে হইয়াছে। আমি মারদাঙ্গাপ্রিয়

নয়। খুনে। সাফল্যের জন্য মারপিট করিতে পারিব না, কিন্তু

খুন করিতে পারিব। তাই আমার ক্লান্তি একজন শিকার না

পাওয়া ঘাতকের সহিত তুলনীয় – আমি জহ্লাদ, কিন্তু

কাহাকেও বধ করিবার আদেশ যেন দীর্ঘদিন আসে না। আমার

ভিতরের সংস্কৃতজ্ঞের সহিত আমার বিতর্ক চলে – সব

বৃক্ষে কি ফল ধরে? তবে কেন তুমি বলিলে, ফলেই

বৃক্ষের পরিচয়, যেখানে গাছে একটি পাতা না

থাকিলেও তুমি গাছকে গাছ বলিয়াই চেনো?





অমিতব্যয়ী



টাকা মানুষের মনের প্রতিনিধি বলিয়াই টাকায় মানুষ

রাজার মুখ মনীষীর মুখের ছাপ বসায়, দেশের

কোনো প্রিয় বৈশিষ্ট্যকে উৎকীর্ণ করে। কৃপণ এ কথা

জানে। কৃপণ মানুষের মনকে অত্যন্ত বেশি মূল্য

দেয় তাই উহার ব্যবহার রুদ্ধ করিতে চায়। কৃপণ

চায় উত্তর-মন মনুষ্যত্ব, যাহা এখনো আবিষ্কৃত হয়

নাই।







একটি বৃদ্ধের গল্প




সেই বৃদ্ধ তাঁহার কাকার কাহিনী অনবরত বলিতে থাকিতেন। তিনি

লেখাপড়ায় খুব খারাপ ছিলেন না অথচ তাঁহার সাহস ও শক্তি

নাকি বিস্তর খ্যাতি লাভ করিয়াছিল, একদা চল্লিশটি রুটি ও

আধখানা পাঁঠা খাইয়াছিলেন যখন তাঁহার বয়স মাত্র পনেরো,

মাথায় নারিকেল ভাঙিতেন এবং আটক্রোশ হাঁটিলেও কিছুমাত্র

ক্লান্ত হইতেন না। দেশী আন্দোলন করিতে গিয়া তিনি জমিদার

ও ব্রিটিশ কোর্ট উভয়কেই চটান এবং কোর্টে যখন উপস্থিত হন

তখন তাঁহার সমস্ত পিঠে ব্যাণ্ডেজ। তদবস্থাতেও কোর্ট কুড়ি ঘা

বেত চালাইবার আদেশ দেয় এবং সেই সপ্তদশবর্ষীয় যুবাটির

নিতম্বে ও উরুতে বেত পড়ে। বৃদ্ধ হাসিয়া বলিতেন, তাহা

মাস্টারের বেত নহে।

তাহার পর বৃদ্ধ সেই প্রসঙ্গে আর কিছুই

বলিতেন না। পরে জানিয়াছি তাঁহার সেই কাকার

আঠারো বছর বয়সে বিবাহ হয় এবং তিনি শ্বশুরালয়েই

বেশি সময় থাকিতেন। সেখানে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি

স্বীয় স্ত্রী, শ্বশুরালয়ের দুই দাসী, স্ত্রীর জনৈকা বিধবা

মাসির গর্ভ উৎপাদন করেন – যাহার জন্য স্ত্রী আত্মঘাতী

হন, বিধবা কাশী চলিয়া যান, দুই দাসী বেশ্যা হয়। তিনি

মদ ধরেন। কিছুকাল বাদে তিনি আগুনে পুড়িয়া মরিবার

মুহূর্তে একটি শিশুকে উদ্ধার করেন এবং ইহার কয়েকদিন

বাদে অত্যধিক মদপানে মারা যান।


ট্রেন 



যশোর, সবুজ ট্রেন, তুমি কি এখন

অন্য কোনো বালকের মর্মে এসে পড়ো?

যখের গহনা আগলায় আজ এই

উত্তর-বালক, জড়-স্মৃতি করে জড়ো

অপারগ আচার্যের আঙুলের উন্মন

উপবীত যেন, যার ব্যবহার নেই।



শৈশব, সবুজ ট্রেন, ট্রেনের সতত

শৈলজল অগ্নিশব্দ, তমসাজীবিতা…

যত্নে স্বচ্ছ হলো আজ, তবু পথ-ক্ষত

যশোরেশ্বরীর ভূমে শয়ান কবিতা

আমাকে জানায় কীর্তিনাশা-দূরদেশে

আর্ত পারাপার আজো। ইন্দ্রিয়সঙ্কুল



অতীতে। সবুজ ট্রেন, তরুর অমূল

অন্য বালকের ঘুমে, চুলে ওঠে ভেসে।




3 comments:

  1. বারবার পড়ার। আবহমানকে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগলো

    ReplyDelete

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...