Tuesday, August 14, 2018

স্বাধীনতা এক খুড়োর কল : দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়





ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে সুচিত্রা-উত্তমের বাংলা ছবি দেখতে যেতুম। সেই রকমই কোনও একটি সিনেমা দেখার পর জীবনের প্রথম কবিতাটি লিখেছিলুম।  ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চীর সম্ভোগদৃশ্যের প্রতিক্রিয়ায় না-হলেও, বঙ্গদেশের দুই কিংবদন্তী নায়ক, নায়িকার ফিল্মি প্রণয়ঘটিত অভিঘাত সেই লেখার উদ্দীপক ছিল। বাল্মীকির সঙ্গে আমার মিল ততটুকুই। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হল, কবিতাটি লিখিত হওয়ার পর, শিরোনাম দিয়েছিলাম স্বাধীনতা। সেই থেকেই স্বাধীনতা বিষয়টিকে বড্ড গোলমেলে বলে মনে হয়।
কয়েক দিন আগে ইউটিউব খুলে একটি তথ্যচিত্র দেখছিলুম। মোজাম্বিকের একটি উপজাতি, হিম্বা। সেই কুলের মহিলাদের রীতি হল ঊর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত রাখা। তথ্যচিত্রটি দেখে আমার এক বান্ধবীর খেদোক্তি, ইস, ওরা কত স্বাধীন। আমরা ইচ্ছে করলেও ওই রকম হতে পারব না! বস্তুত, আপাত গুরুত্বহীন, অগভীর, খানিকটা যেন হাস্যকর এই মন্তব্য থেকেই হোঁচট খাওয়ার শুরু। স্বাধীনতা বলতে তবে কী বুঝব?
 স্কুলের পাঠ্যবই পড়ে স্বাধীনতা বলতে আমরা কোনও দেশের সার্বভৌমত্বকে বুঝি। রক্তক্ষয়ী সুদীর্ঘ সংগ্রামের ভিতর দিয়ে দুশো বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছে আমার দেশ, স্বাধীন হয়েছে। এই রকম ঢপের একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়া হয় ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু, কখনওই সেই স্বাধীনতার স্বরূপ চেনানো হয় না। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের, আত্মত্যাগের ইতিহাসকে খর্ব না-করেই বলছি, রাতের অন্ধকারে যে স্বাধীনতা পাওয়া গেল, সেই স্বাধীনতা একটি মস্ত বড় প্রহসন নয় কি? একটা দেশ ভেঙে দুটো হল। আমাদের শরীরে ধর্মের লেবেল সাঁটা হল, আমরা ধর্মের দাস হলাম। এও তো বেড়ি পরা, শৃঙ্খলিত হওয়া। স্বাধীনতা, ফুঃ। ঋত্বিক কুমার ঘটকের যুক্তি তর্ক আর গল্প স্মতর্ব্য।
খবরের কাগজে চাকরি করতে গিয়ে জেনেছি, সব লেখা যায় না। দুর্নীতি চিনেও, অনেক ক্ষেত্রেই না-চেনার ভান করে থাকতে হয়, কলমে কন্ডোম পরাতে হয়। এও তো এক পরাধীনতা। অর্থাৎ, স্বাধীনতা বস্তুটি অনেকটাই যেন খুড়োর কল।
সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখা বিপ্লবীরাও আজ বুঝতে পেরেছেন, ওখানে মানুষের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকে না। অন্যদিকে ধনতান্ত্রিক সমাজে সব-পেয়েছি গোছের জীবন মোহগ্রস্ত করে তোলে। মনে হয়, এই বুঝি স্বাধীনতা। ক্রয়ের স্বাধীনতা, বিলাস-ভোগের স্বাধীনতা। কিন্তু, সত্যিই কি তাই? আমরা কী পরব, কতটুকু পরব, কী খাব, কতটুকু খাব, কী হাগব, কতটুকু হাগব সবই কি ঠিক করে দিচ্ছে না কর্পোরেট দুনিয়া? আমাদের মূল্যবোধ পর্যন্ত তৈরি হয় বণিকসমাজের ইচ্ছানুসারে। তা হলে কোথায় স্বাধীনতা? কোন নির্জন দ্বীপে তার বাস?
আদর্শ আঁকড়ে থাকা ষাট দশকের কিছু মানুষকে আমি চিনতুম। তাঁরা প্রত্যেকেই ওই আদর্শের জাঁতাকলে নিয়ত পিষ্ট হচ্ছিলেন, চালিত হচ্ছিলেন  বলে মনে হত। ব্যক্তিসত্তা বলে কিছুই থাকত না। এও কি পরাধীনতা নয়?
স্বাধীনতা তা হলে কী? মানুষের নিজের ইচ্ছানুসারে চলার অধিকার? নাকি, প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার? এখানে অধিকার নামক আরও একটি গোলমেলে বিষয় চলে আসে। এই অধিকার বস্তুটির স্বরূপ কী হবে, তা স্থির করবে কে? ক্ষমতাসীন কিছু মানুষ? তাঁরাই বলে দেবেন, আপনার অধিকারের দৌড় কতটুকু? মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষমতাসীন মানুষই ঠিক করে দিচ্ছেন সাধারণের স্বাধীনতার পরিধি! পরাধীন ভারতে এক রকম, এখন আরেক রকম। সাধারণের পায়ে বেড়ি পরানো আছেই।
আরও একটি ঢপের চপ হল গণতন্ত্র। স্বাধীন মানুষ আসলে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় বসবাসকারী মানুষ। এই ধারণা মহান, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু, সেই মহত্ব পুঁথিতেই আবদ্ধ। তার প্রয়োগ কোনও দেশেই সুষ্ঠ নয়, ভারতে তো নয়ই।
এই যে একটি সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে গর্ববোধ করি, তাও কতটা যথার্থ? এই দেশ প্রকৃত বিচারে কতটা স্বাধীন? বিশ্বের কিছু নিয়ন্ত্রক সংস্থার মর্জি মতো চলতে কি বাধ্য নয় এই দেশ, তার সরকার? ঢপ ঢপ মস্ত ঢপ এই স্বাধীনতার বুলি।
সিনেমা হলের পর্দায় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে দেশভক্তি জাগ্রত করার চেষ্টা, আর প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া মানুষের স্বতস্ফূর্ত দেশপ্রেম কখনওই এক বস্তু নয়, হতে পারে না। কিন্তু, প্রকৃত স্বাধীনতা বস্তুটি খায়, না মাথায় মাখে?
আমাদের দেশে স্বাধীনতা যেন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাক্ স্বাধীনতা বলে কিছুই আর থাকছে না। নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সংবাদপত্রের অধিকার। ধর্ম, জাতপাতের রাজনীতির নোংরা খেলায় স্বাধীনতা কলুষিত হচ্ছে প্রতিদিন।
গোটা বিশ্বের পরিস্থিতিও আশাপ্রদ নয়। কত মানুষের কোনও দেশ নেই, শরণার্থী হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয় খুঁজতে হচ্ছে চরম হীনম্মন্যতায়। ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতা আজ  অলীক এক ধারণামাত্র।
জন লেননের একটি গানের কথা মনে পড়ে যায়।
মনে করো কোনও দেশ নেই। এই মনে করাটা কোনও কঠিন কাজই নয়। কোনও হানাহানি, মারামারি থাকবে না, থাকবে না কোনও ধর্ম। বিশ্বের সব মানুষ শান্তিতে জীবন কাটাবে।
তুমি ভাবতে পারো এই স্বপ্ন শুধু আমিই দেখি। কিন্তু, জেনো, আমি একা নই। আমি আশা করি এক দিন তুমিও আমারই মতন স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। এই পৃথিবী সেইদিন হবে সীমান্তহীন।
পাশাপাশি আরও একটি গানের কলি মনে পড়ে। মৌসুমী ভৌমিকের সেই গানে কী তীব্র শ্লেষ, যন্ত্রণা। কোথায় যেন কাঁদছে মানুষ...মানুষ বড় নিঃসহায়!
সত্যিই আজ বড় নিঃসহায় মানুষ। দিশাহীন, আদর্শহীন চূড়ান্ত পরাধীন! তাই, স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু, স্বপ্ন দেখানোর কোনও মানুষ নেই। পৃথিবী আজ, আক্ষরিক অর্থেই, অভিভাবকহীন।
তবু মনে হয়, এমন কেন সত্যি হয় না, আহা:

“Imagine no possessions

I wonder if you can
No need for greed or hunger
A brotherhood of man
Imagine all the people
Sharing all the world...”

1 comment:

  1. সাহসী লেখা। নিটোল একটি লেখা। ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...