Sunday, August 12, 2018

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র







 "It's coming through a hole in the air, 
from those nights in Tiananmen Square. 
It's coming from the feel 
that this ain't exactly real, 
or it's real, but it ain't exactly there. 
From the wars against disorder, 
from the sirens night and day, 
from the fires of the homeless, 
from the ashes of the gay:"

                                        ( Leonardo Cohen, Democracy)



প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে একটি চাকু এবং খাঁচার কথা। স্থির। রেখে গেছে কেউ। তার ভেতরে মুরগী। জ্যান্ত। চাকু-টি স্থির। মহাস্থিতির গতি ধারণ করে আছে। যেহেতু স্থিরতা চাকুটির ধর্ম, ইচ্ছেটাই নিদ্রিত। সে জানে না তার কাজ কি! তার দায়িত্ব কি! কিংবা নিজেই আন্দাজ করতে পারেনা, কিভাবে একটা ধারালো, হিংস্র খুন তার মধ্যে লুকিয়ে আছে। নিজেকে চালিত করতে না পারা এই জড় স্থিরতা তাকে শুধু সমর্পণ শেখায়। শেখায় কী নিজের অসহায়তার উপলব্ধি! হয়ত।  তাই অসংখ্য দৃশ্য তার কাছে শুধু দৃশ্য মাত্র। অসংখ্য যাতায়াত তার কাছে ধর্ম মাত্র। আবার সমস্ত দৃশ্য, দৃষ্টি, উপেক্ষা, অপেক্ষা - সবেতেই নিজেকে মিলিয়ে মহাপৃথিবীর অংশ ভাবতে পারে নিজেকে। 
 আবার ওই মুরগী, জ্যান্ত থাকার কলা কৌশল, রক্ত, তীক্ষ্ণ তীব্র আন্দাজ --সব সবটাই অপরের চালানো এবং চলাটাই তার কাছে এনে দেয় মুক্তির বাতাস। কেননা, জন্ম থেকে সে শিখে এসেছে নির্ভরতা-- অপরের চালানো শক্তিটাই তার কাছে স্বাধীনতা। কেননা, সমস্তটাই একটা ইচ্ছের কারণ, ভ্রম মাত্র। আর তাই সেও ভেবে নেয় এটাই সত্য। এটাই বিধিনির্ধারিত।

 অথচ, মুরগী দেখেছে পূর্বপুরুষদের হত্যা, তাদের কাতরানি-- তার মনে অজস্র ভয়ের দানা জমাট বেঁধে আছে। জন্ম- জন্মান্তরের ভয়ের বীজ বহন করে চলেছে সে। শৃঙ্খলের দাসত্ব তাকে শিখিয়েছে মৃত্যুর সম্ভাবনা। তাই ঘটে যাওয়া দৃশ্য থেকে শুরু করে চারপাশের পরিস্থিতি -- সবেতেই তার ত্রাস, মৃত্যু ভয়। হারিয়ে যাওয়ার, মুছে যাওয়ার ভয়। অস্তিত্ব৷ বিপন্ন হওয়ার ভয়। পূর্বপিতাদের চোখ তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। কিছুতেই ভোগ করতে দিচ্ছে না চারপাশের দৃশ্য, সুন্দর কুৎসিতের ফারাক। আর  সেও প্রতিটি সম্পর্কে গেঁথে দিচ্ছে অবিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা। প্রতিবেশী চাকুকে ভেবে নিচ্ছে তার শত্রু। তার মৃত্যু। বেঁচে থেকেও মরে আছে মৃত্যুর পরাধীনতায়।

আর এভাবেই সে ক্রমশ মেনে নিচ্ছে নিয়িতির নিষ্ঠুরতা। মেনে নিচ্ছে এভাবেই হয়ত তাকেও সেই শীতল ক্রুর মৃত্যুর চোখের সামনে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এভাবেই নিজেকে হত্যার সামনে নিপুণ ভাবে সঁপে দিতে বাধ্য হয়েছে তার পূর্বপুরুষেরা। এভাবেই তারা কেবল খাদ্য। তার জীবন এভাবেই বলিপ্রদত্ত। এ নিয়ে তার আক্ষেপ করার কোনও কারণ নেই। সে ভয়ের অধীন। সে মৃত্যুর অধীন। তার অস্তিত্বে মিশে আছে হাজার হাজার বছরের পূর্বপুরুষদের ভয়, হত্যা ও মৃত্যু। তার আর কিছু করার নেই। সে জানে মৃত্যু তাকে নিয়ে এক নিশ্চিত-অনিশ্চিতের খেলায় মেতে আছে শুধু। যখন সেই মুরগি ঠাসা খাঁচার মধ্যে এগিয়ে আসে হাত, তখন মৃত্যুও জানে না, সে কাকে তুলে নেবে। এমনকী মুরগী ও তার মতো মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে থাকা কয়েকশো মুরগীও জানে না এবার কার পালা। আর সেই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রত্যেকেই প্রতি মুহূর্তে মরে যায়। এই যে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়া, তুমি জীবিত নেই, তুমি আসলে মৃত, তুমি আসলে আমার ইচ্ছার উপর বেঁচে আছ। যখন আমি চাইব, যতক্ষণ আমি চাইব, তুমি ততক্ষণ প্রাণ নিয়ে আছ। তার পর নেই। 

  কিংবা যদি মনে করে নিই মুরগী জন্ম থেকে ছিল স্বাধীন। বন- বাদাড়, সবুজ -খেত, রাঙা মাটি তার চেনা-- সমস্ত পূর্বের প্ররোচিত খুন ঘটেছে তার আড়ালে, তার অজান্তে-- তখন কী এই খাঁচা এবং চাকু বৈরী দৃষ্টি দিয়ে দেখবে সে? না। আর তাই এখনও তার মধ্যে নিজের মৃত্যু কিংবা বাঁচার ইচ্ছে কোনটাই প্রবল নয়। আছে, থাকতে হয় বলে। বাঁচে বাঁচতে হয় বলে। নিস্পৃহ দৃষ্টিতে দেখছে কি স্থিরতায় শুয়ে আছে একটা ঝকঝকে চাকু। ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে দিচ্ছে মাঝে মধ্যে। টুং করে শব্দ হচ্ছে আর মজা পেয়ে বারবার খাঁচা ভুলে, পারিপার্শ্বিক ভুলে চাকুকেই ভেবে নিচ্ছে খেলনা। চাকু'র  ধারালোতে মুছে নিচ্ছে তার চোখের ভ্রম। চাকুর ধারালো স্বর তখন হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার কাছে শিল্প। সুরের মাধুর্যে ভরে উঠছে চারপাশ। সমস্ত তুচ্ছ ভেবে মুরগীটিও সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকছে। হঠাৎ কোনও কারণ বশত  ধারালো চাকুতে লেগে যদি তার পা কেটে যায়? কিংবা ছিঁড়ে যায় ডানার পালক! যদি... যদি...

যদি অন্য কিছু হয়, এই হল মুরগীর কাছে আশাবাদ। তার নিজের চাকু নেই। সে নিজে পারে না পালটা আক্রমণ করে মৃত্যুকে আহত করতে। প্রতিহিংসা তার স্বভাবে নেই। সে শুধুই মরতে জানে। কিন্তু তার বা তাদের মতো অস্তিত্বগুলির কাছে আশাবাদ ছাড়া আর অন্য কিছু থাকে কী? সে দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করে। একদিন মৃত্যুর কাছে বিস্বাদ হয়ে গেল মুরগীর রক্ত। একদিন মৃত্যু নিজে মনে করতে শুরু করল আর সে হত্যা করবে না। খুলে দিল সব খাঁচা। আবার এও দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করল মুরগীটি- একদিন তাদের সবার আকৃতি ডাইনোসেরসের মতো হয়ে গেল। তারা ছিঁড়ে ফেলল সব খাঁচা। আক্রমণ করল স্বয়ং মৃত্যুকে। পাল্টে গেল খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। একটা অনাবশ্যক আনন্দ জন্ম নেয় তার মনে। সে আবৃত্তি করতে থাকে- " পেটের কাছে উঁচিয়ে আছ ছুরি/ কাজেই এখন ইচ্ছেমতো ঘুরি"। 

 এরপরেই শুরু হয় আসল ক্রাইসিস। জন্ম নেয় একটা ভয়-মন, তখন সে সেই চাকু থেকে, খাঁচার বন্দিত্ব থেকে পালাতে চায়। তার মনে ঢুকে পড়ে পালানোর ইচ্ছে, ইচ্ছেমতো জায়গায় যাপনের ইচ্ছে। তখন মুরগীটি সেই ঘাতক চাকু থেকে, তার ধারালো চোখ থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে চায়। সে তার খাঁচার চারপাশে খোঁজে ফাঁক- ফোকর। ঝাঁকুনি দেয় লোহার গ্রিলে। চাওয়ার ইচ্ছে থেকে জন্ম নেয় মুক্তির আকাঙ্খা। আর যেটা সে কিছুতেই পারে না। খাঁচার চারপাশে ঘুরঘুর করে, লোহার খাঁচায় মুক্তি খোঁজে,  কিন্তু ততক্ষণে সে বুঝে গেছে চাইলেই পাওয়া যায় না ইচ্ছেবস্থান। তাই গলায় আওয়াজ তোলে,প্রথমে ধীরে  কুককুক করে প্রতিবাদ জানায়, তারপর জাগিয়ে তোলে পাড়া- প্রতিবেশীদের।
আর এখান থেকেই জন্ম নেওয়া একটি পালানোর ভয় তৈরি করছে এক স্বাধীন স্পৃহা। আকাঙ্খা। পালাতে চেয়ে পালাতে না পারার ভয়। জ্ঞাতিকুল থেকে, জন্ম থেকে, স্থিরতা থেকে মুক্তি চেয়ে মুক্তি না পাওয়ার বাধা। এই পরাধীনতা মুরগীর জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ।

" dragging his hunger through the sky 
Of my skull shell of sky and earth
Stooding to the prone who must 
Soon take up their life and walk 
Mocked by a tissue that may not serve 
Till hunger earth and sky be off all"   ( স্যামুয়েল বেকেট,  The Vulture)

 কিন্তু চাকু স্থির। চুপচাপ দেখছে মুরগীর কার্যকলাপ। তার মধ্যে ঘাতক নেই, জন্ম নেই। অনন্তের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসে আছে দৃশ্য এবং দৃশ্যান্তরের দিকে, স্থিরতা দিকে। যতক্ষণ না তৃতীয় ব্যক্তি এসে নেড়েচেড়ে নিয়ে যাচ্ছে মুরগীর গলার কাছে, সে জানেও না মুরগীর ভয়ের কারণ। কিন্তু এরপর যা দাঁড়াল, তৃতীয় কারও চালনায় চাকুটিও বুঝে নিল তার পাওয়ার - শক্তি। মুরগী তখন চাকুর কাছে পরাধীন। মুরগী ভাবছে চাকু-ই আসল শাসনকর্তা। তাই শোষণের হাত থেকে উদ্ধারকল্পে দূরে সরে যাচ্ছে। আবার চাকু ভেবে নিচ্ছে সেই তৃতীয় পার্সনটিকে সমঝে চলতে হবে, নাহলে সে যে অসহায়। আবার যদি নিয়ম মেনে তৃতীয় ব্যক্তিকে স্বাধীন বলে ভাবি! মোটেই না-- সে দেখছে, কখন আসবে মাংস কিনতে আসা কাস্টমার। এভাবেই চলতে থাকে। 

 আর ততক্ষণে প্রবেশ করা  ব্যক্তি দরদাম করে, খদ্দের এসে দেখে নেয় কচি এবং মাংসালো স্বাদ। দরদাম হয়। আর হত্যাকারীর অবস্থানকে ভেবে নেয় স্বাধীনতা। অবশ্য খদ্দেরদের কথা আর না-ই বা বললাম। মুরগীটি দেখতে পায় নিয়তিকে। কেননা শেষ সময়ে, সে বোঝে, তার খাদক আসলে অনেকটা তার মতোই অসহায়। মাথার উপর ঝুঁকে নেমেছে ওয়াচটাওয়ারের চোখ। সে জানে না। সে জানে না, কখন তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে তার চেয়েও বড় এক খিদে। কত খাবে তোমরা হে? বছরের পর বছর ধরে তো খেয়ে চলেছ। তবু তোমাদের খিদে মেটে না। তোমরা খাচ্ছ মাঠের পর মাঠ, খাচ্ছ গোলার পর গোলা ফসল, খাচ্ছ মানুষের স্বপ্নগুলিকে, আবার স্বপ্ন দেখাচ্ছ নতুন নতুন খিদের। তোমরা খাচ্ছ মানুষের ইতিহাস, মানুষের সংস্কৃতি, মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্নগুলিকে। অথচ দিবাস্বপ্নে নতুন নতুন খাওয়ার গল্প শোনাচ্ছ। তোমরা খাচ্ছ রাস্তাঘাট, প্রেম, একাকীত্ব, সৌন্দর্যবোধ, শিল্প, আর স্ব-অধীন বেঁচে থাকার ইচ্ছেগুলোকে। আর ক্ষুধার্ত কাকের চারদিকে ভাত ছড়ানোর মতো করে ছড়িয়ে দিচ্ছ দেশপ্রেমের খাবার। আর বলছ, খিদে বাড়াও। বলছ কাঁটাতারের কথা। মুরগীটি দেখে তার দেশ হল সেই খাঁচা আর তার খাদকের দেশ হল তার খাঁচার বাইরে আরও একটা খাঁচা। সবার মাথার উপর লকলক করছে ছুরি।  তারপর... তারপর...ভয়, বিদ্রোহ, স্বাধীনতা --- অপেক্ষা করে, চাকু আর মুরগী, তৃতীয় ব্যক্তি, চতুর্থ কেউ--- সবাই প্রবেশ করে  নিয়ম নামক, জীবন নামে একটি বৃহৎ  চক্র পর্বে। শোনা যায় লেফট রাইট লেফট রাইট, লেফট...লোকে বলে দেশ। বলে রাষ্ট্র। 

গুনগুন করে উঠি -

"রাষ্ট্র মানেই
কাঁটাতারে ঘেরা সীমান্ত
রাষ্ট্র মানেই
পাসপোর্ট নিয়ে উমেদারি
রাষ্ট্র মানেই
ম্যাপে বাঁধা আমার দিগন্ত
রাষ্ট্র মানেই
সবকিছু দারুণ সরকারি।



রাষ্ট্র মানেই

জন্মেই নাগরিক
তারপরে করণিক
মধ্যবিত্ত সুখদুঃখ,



রাষ্ট্র মানেই

পরীক্ষা দেওয়া
তারপরে মেওয়া
ফলার ফলশ্রুতি সূক্ষ্ম।



রাষ্ট্র মানেই

নেতাদের মুখ
আহা বড়ো সুখ
তাঁদের প্রসাদবাণী পেয়ে,



রাষ্ট্র মানেই

সম্পাদকীয়
বেশি করণীয়
আমাদের ধারণার চেয়ে।



রাষ্ট্র মানেই

লোকসভা নিয়ে
হামাগুড়ি দিয়ে
রাষ্ট্রীয় প্রগতির মজা,



রাষ্ট্র মানেই

প্রচার অভিযান
মুশকিল আছান
পলিটিক্সের জিভেগজা।



রাষ্ট্র মানেই

রেশনের লাইন
শৃঙ্খলা আইন
যে করেই হোক ধরে রাখা,



রাষ্ট্র মানেই

অষুধে ভেজাল
রোজ নাজেহাল
হয়েও নাভিতে তেল মাখা।



রাষ্ট্র মানেই

চাপা প্রতিবাদ
এ বাদ ও বাদ
কার বাদে কে বড়ো বিবাদী,



রাষ্ট্র মানেই

মেনে নাও সব
হে জরদগব
নাগরিক হও আশাবাদী।



রাষ্ট্র মানেই

শিল্প এলাকা
শুধু রুটি সেঁকা
শ্রমিকের যুবতী ঘরণী,



রাষ্ট্র মানেই

আধপেটে থাকা
জমি বাঁধা রাখা
কৃষকের হারানো ধরণী।



রাষ্ট্র মানেই

বড়ো বড়ো কথা
শুধু নীরবতা
জমে থাকা বুকের মাঝেতে,



রাষ্ট্র মানেই

একলা মানুষ
বেচারা মানুষ
পরবাসী নিজের ঘরেতে।"


                                    (রাষ্ট্র,কবীর সুমন)


রা\

3 comments:

  1. ভালো লাগলো। শৈলী তো খুবই ভালো। শুধু একটা কথা, আর একটু সংক্ষিপ্ত হলে মনে হয় আরো ধারালো হতো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আপনাকে। কিছু লেখা সংক্ষিপ্ত হতে চায় না। যেন মনে হয় সব বিষ বের করে দিই কলমের নিব দিয়ে, মনে হয় কীবোর্ড ঝলসে উঠুক জমা আক্রোশে। এটাই কারণ। আপনার কথাটিও ঠিক। সংক্ষিপ্ত অবয়বআনার চেষ্টা করবো।

      Delete
  2. ভালো লাগল। কবিতাটিও কবির সুমনের দৃঢ় বাস্তব।

    ReplyDelete

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...