Sunday, August 12, 2018

স্বাধীনতাদিবস ও ধনঞ্জয়ের ফাঁসি : গৌতম ঘোষদস্তিদার





২০০৪  সালের ১৫ আগস্ট। আবাসনরক্ষী ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির উদ্‌যাপনে দেশ পালন করল সাতান্নতম স্বাধীনতাদিবস। সেই পুণ্যদিনে দেশের সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম-পৃষ্ঠা অধিকার করেছিলেন বাঁকুড়ার ছাতনা-থানার কুলুডিহি গ্রামের ৩৯-বছরের নিম্নবিত্ত-আবাসনরক্ষী ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মৃত, কাঠ, ঝুলন্ত পা-দুটির ছবি দেখে প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ হয়েছিল বিবেকবান-জনতার। সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় সেই সুসকালেও যেন মৃদুমন্দ দুলছিল ধনঞ্জয়ের নিথর পা-দুটি। পারিবারিক অভিযোগ, শাসকদল ও সংবাদমাধ্যমের অবিরাম প্রচার, গণ-উন্মাদনার পরিণামে ১৪-বছর জেলবাস করে, শীর্ষ-আদালতের রায়ে, আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ১৪ আগস্ট ভোররাতে ফাঁসি হল তাঁর। ঘটনাচক্রে সেদিন ছিল ধনঞ্জয়ের জন্মদিনও। সবরকম চাপ সহ্য করে, ফাঁসির আগেও, ১৮-বছরের স্কুলছাত্রী হেতাল পারেখকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ স্বীকার করেননি তিনি। অস্বীকার করেছেন চুরির অভিযোগ বা তাঁর-বাঁকুড়ার-বাড়ি-থেকে-সংগৃহীত মামলার তথাকথিত প্রমাণাদিও। বরং, ফাঁসির আগেও ধনঞ্জয় জেলারকে বলেছিলেন, ‘আপনি বড় অফিসার। দেখবেন, যে-কোনও অভিযোগের তদন্ত যেন ঠিকমতো হয়।’ ধনঞ্জয় সেদিন রাষ্ট্রীয় হিংসার শিকার হয়েছিলেন। যার অনেকাংশিক কৃতিত্ব মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও গোয়েন্দাপ্রধান প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের। নেপথ্যের কলকাঠিটি নেড়েছিলেন হেতালের মা যশোমতী ও বাবা নাগরদাস, এবং অবশ্যই সংবাদমাধ্যম।     
    এই মামলা যেন ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ (১৮৬৭) বা ‘ব্রাদারস করমাজোভ’ (১৮৮০) বা; ফ্রানজ কাফকার ‘দি ট্রায়াল’ (১৯১৫) উপন্যাসের মতো ঘটনার ঘনঘটায় রোমাঞ্চকর। বিশেষত, ‘দি ট্রায়াল’ উপন্যাসের নায়ক জোশেফ কে-র সঙ্গে ধনঞ্জয়ের সঙ্গতিবিহীন বিচারপর্ব বা জন্মদিনে-মৃত্যুদণ্ডের সাদৃশ্য চমকপ্রদ ও মর্মান্তিক। এক পরাবাস্তব অনির্দিষ্ট-অভিযোগে জোশেফকে হৃদযন্ত্রে ‘কুকুরের মতো’ ছুরি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, আর ধনঞ্জয়কে ফাঁসিতে চড়ানো হয়েছিল অনির্ণেয়-অপরাধে। এই মামলার অভিযোগকারী হেতালপরিবার, পুলিশ, সংবাদমাধ্যম, আদালত নিশ্চয়ই এইসব ধ্রুপদিরচনা সম্পর্কে অবহিত নয়। তাহলে হয়তো সাবধানী হত তারা। কিন্তু, ঘটনার ১৪-বছর পরে এইসব উপন্যাসের পাঠস্মৃতি আমাদের মৃত-ধনঞ্জয়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী করে তোলে।
     আসলে, ধনঞ্জয়ের পক্ষে তথ্যভিত্তিক যুক্তিসমগ্রে এইসব পাঠস্মৃতি উস্‌কে দেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের (আইএসআই) অধ্যাপক দেবাশিস সেনগুপ্ত, প্রবাল চৌধুরী ও পরমেশ গোস্বামী। ধনঞ্জয়ের ফাঁসির বারো-বছর-পরে-প্রকাশিত ‘আদালত মিডিয়া সমাজ এবং ধনঞ্জয়ের ফাঁসি’ পুস্তিকায় তাঁরা প্রখর-গোয়েন্দার মতো উলটে দিয়েছেন পুলিশ, সংবাদমাধ্যম, আদালতের সম্মিলিত রায়। যে-রায় ছিল, প্রকৃতপক্ষে, পূর্বানুমাননির্ভর সিদ্ধান্তসাপেক্ষে বানানো-প্রমাণের অমোঘ পরিণতি। মৃতদেহ চাক্ষুষ করেই, হেতালের মায়ের অভিযোগমতো, গোয়েন্দাপ্রধান সাংবাদিকদের তাৎক্ষণিক জানিয়েছিলেন, ধর্ষক ও খুনি আর-কেউ নয়, গরিব ও গ্রামীণ ধনঞ্জয়ই। যে-কোনও ঘটনায় পুলিশ যেমন স্বভাবতই ‘তদন্ত চলছে’-র চিরাচরিত-লব্জে সাংবাদিকদের আপাত-প্রতিহত করে, এখানে প্রসূনের ভূমিকা ঠিক তার বিপরীত। সংবাদপত্রে ঘটনাটি সবিশেষ-গুরুত্বে ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে-হতে একটি গোটা-সমাজ ধনঞ্জয়কে ফাঁসিতে চড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সেই অবকাশে হেতালের রহস্যময়, অজানা দেহভোগী ও খুনি মসৃণভাবেই চলে গিয়েছিল আড়ালে। তথ্যবিশ্লেষণ করে আইএসআইয়ের গবেষকরা দেখিয়েছেন, সংঘটিত ঘটনাদুটি হয়েছিল যথাক্রমে হেতালের বাড়ির বাইরে ও তাদের ফ্ল্যাটের ভিতরে। দুটি ঘটনা ঘটিয়েছিল ভিন্নজন। কিন্তু, আদালত, মিডিয়া, সমাজ সেইসব খতিয়ে দেখেনি। সকলেই চেয়েছিল, অসহায়-তরুণীর বিরুদ্ধে নৃশংস-অপরাধের ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’। অনিশ্চিত-প্রমাণে সেই  শাস্তি শেষপর্যন্ত হয়ে উঠেছিল নিছকই প্রতীকী। আর, কে না-জানে, সেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিতে ধনঞ্জয়ের মৃত্যুর এতদিন পরেও রাজ্যে বা দেশে ধর্ষণের সংখ্যা বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং বেড়েছে। ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পরে রাজ্যে যেমন ঘটেছে সুটিয়ার মতো দীর্ঘকালীন সংগঠিত-দলধর্ষণ, তেমনই রাজধানী-দিল্লিতে নির্ভয়ার নৃশংস ঘটনা থেকে কাঠুয়া উন্নাও সুরাত মুজফ্‌ফরপুর বা পঞ্চকোটের নারীসন্ত্রাস। অথচ, ছয়-বছরেও আদালত বা রাষ্ট্র নির্ভয়াধর্ষণ বা খুনের সুনিশ্চিত-অপরাধীদের ফাঁসি দিতে পারেনি। দেশে ধনঞ্জয়ের আগে-পরে উল্লেখযোগ্য ফাঁসি হয়েছে ১৯৮২ সালে নয়াদিল্লির খুনি-ধর্ষক রঙ্গা-বিল্লার ও ২০১২ সালে মুম্বই-হামলায়-যুক্ত পাকজঙ্গি আজমল কাসভের। মুক্তিপণের জন্য গীতা চোপড়া (১৬.৬) ও সঞ্জয় চোপড়া (১৪) নামে ভাইবোনকে অপহরণ করে, মেয়েটিকে ধর্ষণ ও দু-জনকেই খুন করেছিল রঙ্গা-বিল্লা। পরে অবশ্য স্বভাবতই ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে তারা।
    পুলিশ, আদালত, রাজনীতি, সমাজ কেউ শোনেনি ধনঞ্জয়ের আর্তি। হেতাল পারেখের খুনের তদন্তে গিয়ে কলকাতা-পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান প্রসূন মুখোপাধ্যায় (যার বিরুদ্ধে পরে অভিযোগ উঠবে, পুলিশ-কমিশনার পদে থেকে অবাঙালি-ব্যবসায়ী অশোক টোডির মুসলমানজামাতা রেজোয়ানুর রহমানকে যথেচ্ছ-হুমকি ও আত্মহত্যার প্ররোচনা, বা তসলিমা নাসরিনকে কলকাতা ছাড়ার ফরমান দেওয়ার) অকুস্থলেই ধনঞ্জয়কে দোষীসাব্যস্ত করেছিলেন। তাঁর সিদ্ধান্তের ভিত্তি ছিল পারেখদের প্রমাণবিহীন অভিযোগ। সেই তাৎক্ষণিক-সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার অভীপ্সায়ই যেন চালিত হয়েছিল দীর্ঘকালীন আইনি-প্রক্রিয়া। পারেখদের অভিযোগ, পুলিশকর্তার যুক্তি ও কলকাতার গুজরাতসমাজের চাপে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও ছিলেন কার্যত ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পক্ষে। আলিপুরের দায়রা আদালত থেকে কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট ছিল একই সিদ্ধান্তে অবিচল। রাষ্ট্রপতি আবুল পাকির জয়নুলআবেদিন আবদুল কালাম ও রাজ্যপাল বীরেন জীবনলাল শাহ যেন অপরাধীর প্রাণভিক্ষার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সংবাদমাধ্যম ও জনমতের প্রভাবেই। এম এস সত্থ্যুর ‘দি রাইট টু লিভ’ তথ্যচিত্রে চিত্রসাংবাদিক অনিরুদ্ধ ধরকে এক সাক্ষাৎকারে ধনঞ্জয় বলেছিলেন, ‘যে-অপরাধের দায় আমার ঘাড়ে চেপেছে, তেমন অপরাধ কেউ সত্যিই করে থাকলে তার ফাঁসি হওয়াই উচিত। তবে, আমি নির্দোষ।’
    বামপন্থীরা তত্ত্বগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধবাদী  ( শিশুদর্ষণে মৃত্যুদণ্ড-আইন প্রণয়নের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বৃন্দা কারাট ফের তা মনে করিয়েছেন) বলেই হয়তো দলের বকলমে ‘সমাজকর্মী’ মুখ্যমন্ত্রীজায়া মীরা ভট্টাচার্যকে জনমত প্রভাবিত করতে পথে নামানো হয়েছিল। তখন তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর প্রভাবশালী- সাংবাদিক কুণাল ঘোষ ও ধনঞ্জয়ের ঘোষিত-ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিকও। শহরের নানা-প্রান্তে পথসভা করে তাঁরা ধনঞ্জয়ের ফাঁসির সওয়াল করে বেড়াতেন। সেইসব তথ্য সে-সময়ের সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় সমুজ্জ্বল।
    ১৯৯০ সালের ৫ মার্চ পদ্মপুকুরের  ছয়তলা আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছিল ১৮-বছরের (পরিবারের দাবি, ১৪-বছর) গুজরাতি তরুণী হেতাল পারেখের শব। বিকেল ৫.৪৫ মিনিটে শরৎ বসু রোডের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির থেকে ফিরে যশোমতী পারেখ লোকজন ডেকে তৎক্ষণাৎ ফ্ল্যাটের বন্ধ-দরজা ভেঙে একমাত্র কন্যা হেতালের মেঝেতে-শায়িত দেহটি আবিষ্কার করেন। তাঁর দেহে বাইশটি ছোট-বড় আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাঁর প্যান্টিটি পড়ে ছিল মেঝের উপর, নিম্নাঙ্গ ছিল অনাবৃত। দেহে প্রাণ আছে আশা করে যশোমতী হেতালকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন ভেবে, প্রতিবেশী বা আবাসনের কর্মীদের সাহায্যের জন্য না-ডেকে, একাই লিফটে করে হেতালের অচৈতন্য-দেহ নীচতলায় নিয়ে আসেন। চিকিৎসকদের ডাকেন। দু-জন চিকিৎসক হেতালকে পরীক্ষা করে তাকে মৃতসাব্যস্ত করেন। যশোমতী দেহটি ফের চারতলায় নিয়ে যান। খবর পেয়ে সন্ধ্যা সাতটানাগাদ আবাসনে ফেরেন হেতালের দাদা ভবেশ, আর সাড়ে-আটটায় বাগড়িমার্কেটের পারিবারিক দোকান থেকে হেতালের বাবা নাগরদাস। পুলিশে খবর দেওয়া হয় রাত সাড়ে-নটায়। কেন সবকটি পর্যায়েই এত-কালক্ষেপ হয়েছিল, কোনও অনুসন্ধিৎসু-সাংবাদিকই এমন সহজ-প্রশ্নটি তোলেননি।
     ইতিমধ্যে হেতালের খুনে তাঁকে খোঁজা হচ্ছে জেনে পুলিশি-আতঙ্কে আত্মগোপনের স্বাভাবিক-তাড়নায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাড়াগাড়িতে কলকাতা ছাড়েন ধনঞ্জয়। তিনি থাকতেন কাছেই মনোরমা স্কুলে। প্রতিবেশী জনৈক বাবুদার জোরাজুরিতে খরচসাপেক্ষ ভাড়াগাড়িতেই ধনঞ্জয় সদল দাদার বাড়ি দুর্গাপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। গাড়িতে বাবুদা সকলকে মদও খাওয়ায়। দুর্গাপুর থেকে পরে ধনঞ্জয় যান নিজের বাড়ি কুলুডিহিতে। সেই বাড়ি থেকে ১২ মে ভোররাতে ধনঞ্জয়কে গ্রেফতার করে পুলিশ। ধনঞ্জয়ের বোঝার কথা নয়, বাবুদাকে দিয়ে পারেখরাই ধনঞ্জয়কে কলকাতাছাড়া করেছে। পরে পুলিশ দৃর্গাপুরে খোঁজ করে ধনঞ্জয়কে পায়নি। কেননা, কলকাতার সঙ্গীরা তাঁর দাদার বাড়ি চিনত না। তারা তাকে ভিড়িঙ্গির মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিল। পুলিশকে তারা অতটুকুই জানাতে পেরেছিল। সকলেই জানি, তখনও ধনঞ্জয়ের মতো নিম্নবিত্তরা (মধ্যবিত্তরাও) কলকাতা থেকে দুর্গাপুর যেতে হুট করে ভাড়াগাড়ির কথা ভাবত না। তাছাড়া, তখন শহরে দূরপাল্লার (দুর্গাপুর রোড হয়নি) ভাড়াগাড়িও বেশ-দুর্লভই ছিল। সে-জন্য বিশেষ-ব্যবস্থার দরকার হত। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সেই বিশেষ-ব্যবস্থা করেছিল পারেখরাই। কেননা, ধনঞ্জয়কে পলাতক-প্রতিপন্ন করলে তাঁর প্রতি সন্দেহ আরও দৃঢ়প্রোথিত হয়। খুব-সহজেই তাঁদের সেই উদ্দেশ্যসাধন হয়েছিল। পুলিশ পলাতক-ধনঞ্জয়কে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বারবার কুলুডিহির বাড়িতে গিয়ে ধনঞ্জয়ের পরিবারের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়, ধনঞ্জয়ের স্ত্রী পূর্ণিমার তোরঙ্গ থেকে তাঁর নতুন অব্যবহৃত নতুন-জামাপ্যান্ট প্রায় কেড়ে নিয়ে যায় পুলিশ, যা পরে আদালতে পেশ হয় খুনির সে-দিনের পোশাকহিসাবে। পুলিশ ‘চোরাই মাল’ দাবি করে ধনঞ্জয়ের স্ত্রীর নিজস্ব-গয়না ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে বলেও অভিযোগ করেছিলেন পূর্ণিমা। তারা ধনঞ্জয়ের বাড়িতে তল্লাশির নামে রীতিমতো গুন্ডামি চালায়। সবেচেয়ে অবাককাণ্ড, তল্লাশির সময় আইনানুযায়ী স্থানীয় কাউকে সাক্ষী হতে ডাকেনি পুলিশ। এই সময় লালবাজার নিয়মমাফিক ছাতনা-থানার সাহায্য নিলেও, পরে তাদের মামলা থেকে দূরে রাখে। এমনকী, কুলুডিহির কাউকে তারা মামলার সাক্ষীও করেনি।
    মামলায় পুলিশের সবেধন-অবলম্বন ছিলেন আবাসনের লিফটচালক রামধন যাদব। তিনি নাকি ঘটনার অব্যবহিত আগে ধনঞ্জয়কে পারেখদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিল পুলিশ। এমনকী, ধনঞ্জয়ের (তাঁর ডিউটি শেষ হয় দুপুর-দুটোয়) বদলি-নিরাপত্তারক্ষী দশরথ মুর্মুকেও ধনঞ্জয় জানিয়ে যান তিনি হেতালদের ফ্ল্যাটে যাচ্ছেন, তাঁদের নিরাপত্তাসংস্থার কর্তাকে একটি ফোন করতে। ফ্ল্যাটে তখন একাই ছিলেন হেতাল। পরে, ওই লিফটচালক আদালতে বিরূপ হয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি আদৌ তেমনকিছু করেননি। আবার, দশরথ মুর্মু নাকি পুলিশকে জানিয়েছিলেন, খুনের পরে (সময়ানুযায়ী) তিনতলার ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে ধনঞ্জয় তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু, আবাসনের সবকটি ব্যালকনিই গ্রিল-দিয়ে-ঘেরা। সেখান থেকে ঝুঁকে কথা বলা সম্ভব নয়। ব্যালকনির ধনঞ্জয়ের সঙ্গে নীচ থেকে কথা বলতে হলে পদ্মপুকুর রোডে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কথা বলতে হয়। সবচেয়ে বড়কথা, ধর্ষণের উদ্দেশ্য নিয়ে ধনঞ্জয় যদি পারেখদের ফ্ল্যাটে যায়, তাহলে তিনি এক-সহকর্মীকে জানিয়ে, আর-একজনের সাহায্যে লিফটে চেপে তিনতলায় যাবেন, পরে সেখান থেকে প্রথমজনের সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলবেন. তা মোটেই বিশ্বাস্য নয়। পারেখদের ঘরে রক্তের দাগ ছিল। কিন্তু, কেউই এমন দাবি করেননি যে, তারা ধনঞ্জয়ের পোশাকে রক্তের সামান্যতম-দাগও দেখেছেন। হেতালের যোনিতে বীর্যচিহ্ন মিললেও, তা ধনঞ্জয়ের বীর্যর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়নি। এমনকী, হেতালের দেহমিলন যে কোনওভাবেই বলাৎকার নয়, তা বোঝা গিয়েছিল ময়নাতদন্তের রিপোর্টে। কেননা, হেতালের যোনিতে বা নিম্নাঙ্গে বিন্দুমাত্র আঘাতচিহ্ন ছিল না। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট-প্রতিরোধচিহ্ন থাকাই স্বাভাবিক। এমনকী, হেতালের স্তনেও কোনও দাঁত-নখের চিহ্ন ছিল না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে তা প্রায়শই সাধারণ-ঘটনা।
    ঠিকই যে, হেতালের সতীচ্ছদ অক্ষত ছিল না। বোঝা যায়, সেই ছিল হেতালের প্রথম-মিলন। সম্মতিমিলনেও সতীচ্ছদ ছিন্ন হতে পারে। হেতালের যৌনকেশ জমাট বেঁধে ছিল বীর্যে। কেবল সম্মতিমিলনেই, গর্ভধারণের শঙ্কায়, যৌনাঙ্গের বাইরে বীর্যপাত সম্ভব। কোনও ধর্ষকের সেই দায় নেই। এইসব তথ্যে বোঝা যায়, হেতালের মিলন ছিল স্বেচ্ছায়। বোঝা যায়, সেই মিলনের সঙ্গে খুনের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। কেননা, ধনঞ্জয়ও যদি হেতালের সম্মতিতে (পুলিশকে প্রণয়সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন রামনাগর, তাঁর অনুমান, হেতালই দরজা খুলে দিয়েছিলেন ধনঞ্জয়কে) তাঁর সঙ্গে মিলিত হন, তাহলে তো খুনটাই হয় না। আইএসআইয়ের গবেষকদের সূত্রানুযায়ী, মিলন হয়েছিল আবাসনের বাইরে কোথাও। তারপর ফ্ল্যাটে ফেরার পরে খুন হয়েছেন হেতাল। গবেষকরা জানিয়েছেন, হেতালের মুখাবয়বের আঁচড়গুলি দীর্ঘ-নখের, যা মেয়েদের হওয়াই সম্ভব। খুবই তাড়াহুড়োয় আনাড়ি-হাতে খুনটি হয়েছিল। খুনি সম্ভবত কোনও মহিলা, তার আঙুলে দীর্ঘ-নখ ছিল। তেমন-নখ ছিল যশোমতীরও। যশোমতী সন্ধ্যায় মন্দিরে যাওয়ার আগেই হেতাল খুন হয়েছিলেন। মৃতদেহের অবস্থানুযায়ী, হেতালের মৃত্যুসময় সাড়ে-তিনটের আগে। তখন যশোমতী ও হেতাল-ছাড়া ঘরে আর-কেউ ছিলেন না। ধনঞ্জয়ের তখন ঘরে থাকার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে অদ্ভুতভাবে খুনের সময়োল্লেখ নেই। কোনও সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারক বা বিচারপতি তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। কেননা, তাঁরা সকলেই ছিলেন খুনের সিদ্ধান্তে ও ধনঞ্জয়কে খুনিসাব্যস্তে অবিচল।
     হেতালের বাবা দাবি করেছিলেন, স্কুলে যাওয়ার পথে হেতালকে নিয়মিত ‘উত্যক্ত’ করতেন ধনঞ্জয়। এই   মর্মে তিনি ধনঞ্জয়ের নিয়োগসংস্থায় লিখিত অভিযোগও করেছিলেন। কিন্তু, দেখা গেছে, সেই অভিযোগপত্র সম্পূর্ণই অতীত-ক্রিয়াপদে লেখা (‘ধনঞ্জয় আমার মেয়েকে উত্যক্ত করত’)। বোঝা যায়, হেতালের মৃত্যুর পরে পুলিশের যোগসাজশেই চিঠিটি বানিয়ে লেখা হয়েছিল। মিথ্যার সত্যনির্মাণ যেহেতু অসম্ভবসাধ্য, সেহেতু ব্যাকরণের সামান্য-কালবোধ লুপ্ত হয়েছিল পুলিশ ও পারেখদের। কিন্তু, আদালত সেই সহজ-ব্যাকরণও খতিয়ে দেখেনি। খুনের কারণ-হিসাবে পুলিশ আদালতে বলেছিল, হেতালকে উত্যক্ত করার কথা মা-বাবাকে জানিয়ে দেওয়ায় এবং তিনি তা নিয়োগসংস্থায় জানানোয় সংস্থা তাঁকে পাশের আবাসনে বদলি করায় ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ ধনঞ্জয় প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই হেতালকে ধর্ষণ ও খুন করেছিলেন। কিন্তু, এই যুক্তিরও কোনও সারবত্তা নেই। কেননা, পাশাপাশি-আবাসন থেকে হেতালকে উত্যক্ত করার সমসুযোগ ধনঞ্জয়ের ছিল। তাছাড়া, তাঁর বদলি এমন-কোনও সাংঘাতিক শাস্তিও (নিম্ন-বেতনের ঠিকাকর্মীদের এর চেয়েও বেশি সংস্থাপীড়িত হতে হয়) ছিল না যে, সে-কারণে একটি তরুণীকে ধর্ষণ ও খুনের ঝুঁকি নিতে পারেন নিম্নবিত্ত ধনঞ্জয়। তাছাড়া, তাঁর চাকরি খোয়ানোর আশঙ্কাও ছিল। কিন্তু, গোয়েন্দাপ্রধানের তাৎক্ষণিক-সিদ্ধান্ত প্রমাণ করতে ব্যগ্র হয়েছিল সংবাদমাধ্যম ও আদালত। সাংবাদিকরা কার্যত পুলিশের মুখপাত্ররূপে কাজ করেছিলেন। আর, পুলিশের ভূমিকা ছিল পারেখদের মুখপাত্রের।
     পক্ষান্তরে, হাইকোর্টের রায়ে বিচারপতি বলেছিলেন, ধনঞ্জয় খুন করেছিলেন প্ররোচনাবিনাই। পুলিশ দাবি করেছিল, ৫ মার্চ বিকেল ৫.২০ থেকে ৫.৪৫ মিনিট পর্যন্ত হেতালের মা ফ্ল্যাটে ছিলেন না। মাত্র পঁচিশ-মিনিটে চারতলায় যাওয়া, হেতালের দরজা খুলে-দেওয়া (হেতাল কেন ‘উত্যক্তকারীকে’ ঘরে ঢুকতে দেবেন), নিজের ও হেতালের পোশাক খোলা, হেতালের প্রতিরোধ, বাইশটি আঘাত, ধর্ষণ, খুন, পোশাক পরা ও পরানো, আলমারি খুলে হেতালের হাতঘড়ি-চুরি, বারান্দা থেকে সহকর্মীর ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো এতগুলি কাজ যে অসম্ভবই, তা সাধারণ-বুদ্ধিতেই বেশ বোঝা যায়। সে-জন্য কোনও ব্যোমকেশ বক্সী হতে হয় না। কিন্তু, পুলিশ, সংবাদমাধ্যম, তিনটি আদালত কেউই তখন এসব খতিয়ে দেখেনি। পুলিশ পারেখদের কথা, আদালত ও সংবাদপত্র পুলিশের কথাই ধ্রুব বলে মেনে নিয়েছে।  মেয়ের খুনের এক-সপ্তাহের মধ্যে যশোমতীকে ও এক-মাসের মধ্যেই অন্যদের পুলিশ কেন কলকাতাছাড়ার অনুমতি দিয়েছিল, সে-প্রশ্নও করেননি কোনও দায়বদ্ধ-সাংবাদিক। তাঁরা কেবল মুখ বুজে প্রসূনের দেওয়া তথ্য টুকে গেছেন, আর আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে সে-সব সংবাদপত্রে পরিবেশন করে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির দাবিতে সরব হয়েছেন।
    অথচ, ঘটনার পূর্বাপরবিচারে যে-গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি পরিষ্কার হয়, তা হল, বাড়ির বাইরে হেতাল কারও সঙ্গে সম্মতমিলনে লিপ্ত হয়েছিলেন, খুন হয়েছিলেন বাড়িতে ফিরে। সে-কারণেই তাঁর হত্যা তথাকথিত পারিবারিক- সম্মানক্ষার কারণেই হওয়া সম্ভব। যেমন, পরে দিল্লিতে আরুশি তলোয়ার ও পরিচারক হেমরাজের মিলন ও খুন।
    যদিও, প্রমাণাভাবে নূপুর ও রাজেশ তলোয়ার বেকসুর মুক্তি পেয়ে যান। তাঁরা ধনঞ্জয়ের মতো গরিব ও সহায়সম্বলহীন নন। ধনঞ্জয়ের পরিবার জমি বন্ধক রেখে বা বিক্রি করে আলিপুর আদালতের নামী-আইনজীবী অনিল বসাককে ভাড়া করেছিল। কিন্তু, তিনি ধনঞ্জয়ের কোনও কাজেই লাগেননি। তাঁর শুনানি বরং প্রায়শই ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধেই গেছে। পেশাদারিত্বের অভাব বা জনমতের প্রভাব হয়তো তাঁরও অন্তরায় হয়েছিল। কিন্তু, নূপুর-রাজেশ যথেষ্ট-প্রভাবশালী ও ধনী। তাঁদের আইনজীবীও একশোভাগ-পেশাদার। আরুশি-মামলায় সিবিআইয়ের ব্যর্থতা এই সত্যই প্রতিষ্ঠা করেছে যে, জেসিকা লালের মতো তাঁকেও কেউ খুন করেনি! একইভাবে, হেতালের সংসর্গ  বা খুন, কোনওটিতেই ধনঞ্জয়ের যুক্ত থাকার কোনও সুনিশ্চিত-কারণ ও প্রমাণ ছিল না, ছিল না কোনও প্রত্যক্ষদর্শী। একটি সাজানো-মামলায়, কেবল পারিপার্শ্বিক-অনুমানের উপর ভিত্তি করে, আদালত তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। পুলিশ ধনঞ্জয়কে  লালবাজারে নির্মম-প্রহারে (অনিরুদ্ধ ধরকে দেওয়া সাক্ষাৎকার) তাঁর স্বীকারোক্তি আদায় করেছে। আদালতেও তিনি একই কথা বলেছিলেন। ধনঞ্জয় ইংরেজি জানতেন না। ফলে, ইংরেজিতে-লেখা জবানবন্দিতে তাঁর দুরূহ-স্বাক্ষর একেবারেই নিরর্থক। সব মিলিয়ে আজ বোঝা যায়, বিচারের নামে স্বাধীনতাদিবসের পূর্বরাতে রাষ্ট্র খুনই করেছিল ধনঞ্জয়কে।
     কিন্তু, এই বিস্তৃত-তদন্তেও গবেষকরা সৌজন্যবশে কোনওরকম ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা অস্বীকার করেছেন। তাঁরাও পুলিশের অভূতপূর্ব সামাজিক-বিবেকে আস্থা রেখেছেন। তাঁরা মনে করেছেন, কোনওরকম ঐহিক লাভালাভ ছাড়াই পুলিশ ও সাংবাদিকরা পারেখদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সমাজের ‘বিবেক’ হয়ে বিচারদণ্ড হাতে নিয়েছিল, যা তাঁদের কাজের মধ্যে পড়ে না।
    কিন্তু, সেই বিবেকবান-সমাজ তারপর আর-কখনও অমন-জাগ্রত হয়নি। মীরা ভট্টাচার্যকে পরে কখনও দেখা যায়নি পথে নামতে। তারপরেই ঘটেছে বানতলার ঘটনা। সেই ঘটনায় জড়িত ছিল তাঁর স্বামীর দলের দুষ্কৃতীরা। মীরা টু-শব্দটি করেননি। সুটিয়ার ধর্ষণগ্রামে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর দিদি মালবিকা চট্টোপাধ্যায়কে (প্রাবন্ধিক-অধ্যাপক জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী) দলীয় দুষ্কৃতীরা ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিল জেনেও নির্বিকার ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এখনও চারপাশে রোজই শোনা যায় ধর্ষিতার চাপা-কান্না, অস্ফুট-চিৎকার, অবমাননার হাহাকার, দিন-দিন খুনের সংখ্যা বেড়ে যায়। আমাদের বিবেক ক্রমশ নিথরতর হতে থাকে।
----------------------------------------

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...