Saturday, August 11, 2018

গ্রন্থ আলোচনা বেবী সাউ





               ' তোমার দুঃখের দিন তুমি কেন একা যাবে বলো?'


খইয়ের ভিতরে ওড়ে শোক
পৃথ্বী বসু
ভালো বই
প্রচ্ছদ- সঞ্জীব চৌধুরী
৫০টাকা


অনেকের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়, তাদের খুব তাড়া আছে। হয়তো ভোঁ বেজে গেছে কারখানার। না, তারা সেখানকার শ্রমিক নয়, বরং যন্ত্র। এইবার চলতে হবে তাদের, রুদ্ধশ্বাস সেই চলায় হয়ত কোনও ট্র্যাফিক জ্যাম নেই। অকারণ কোনও চশমা তার ঝাপসা কাচ নিয়ে চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে নেই অস্বচ্ছ শব্দগুলোর দিকে। অনেকের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়, তাঁরা জেনে গেছেন কবিতা কী, কবিতা কীরকম হওয়া উচিত, কবিতার ক্রমমুক্তি কোন ভাষায়। কবিতা বরং জেনে যাওয়ায় থাকে না, না জানাতেই থাকে। এই সাধারণীকরণ না করেই তাই বলা যায়, কবিতা যে অপ্রত্যাশিত ভাবে কার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করবে, তা স্বয়ং মহাপ্রকৃতি একমাত্র জানেন। কারণ 'আমরা'-ই লিখছি, এ এক ভ্রম মাত্র। লেখাই লিখছে নিজেকে। আমরা তার আধার মাত্র।
তরুণ কবি পৃথ্বী বসু। কিন্তু তাঁর কলম পরিণত তুলির মতো। তাঁর দেখার চোখ ও অনুভূতিমালা জগৎকে বাইরে থেকে নয়, অন্তর থেকে দেখতে শেখায়। কারণ এই জীবন, বাইরে হয়ত রয়েছে তার আপাত খণ্ডবৈচিত্রের দিনগুলিকে নিয়ে। কিন্তু অন্তরে রয়েছে মহাজাগতিক সত্যগুলিকে নিয়ে। আমরা সেই সত্যিগুলির সঙ্গেই বসবাস করছি। সহবাস করছি। কিন্তু আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে সেগুলি। একজন কবির কাজ এই চোখের সামনে অথচ অন্তরালে থাকা সত্যের জীবনকে জাপ্টে ধরা। তাকে লেখা। খণ্ডবৈচিত্রের দিনগুলির মধ্যে খণ্ডবৈচিত্রের অখণ্ড যাপনগুলির মর্মার্থগুলিকে লেখা।
পৃথ্বী বসুর প্রথম কবিতার বই 'খইয়ের ভিতরে ওড়ে শোক' সেই মর্মযাপনগুলির নিখুঁত উচ্চারণ।

আমার ঘুম, তুমি কয়েকবারই মাত্র
কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়িয়েছিলে-

তার পর থেকে দুটো চোখ
কীরকম ঘোলাটে হয়ে গেছে

তোমার ভিতরে ঢুকে, আস্তে আস্তে আমি
জেগে থাকা অভ্যেস করেছি

                                                (রাত্রি)

এই 'জেগে থাকা'-ই কবির ধর্ম। 'স্বভাববশত মন্ত্রমুগ্ধ বালক'-এর মতো, জেগে থাকা, অথচ আড়াল করা। এই যে তিনি লিখেছেন " চোখ তুলে তাকাও যখন/ মনে হয় বেপাড়া থেকে বল এল হাতে", - এই  হল সেই মন্ত্রমুগ্ধ বালকের সঙ্গে অপ্রত্যাশিতের দেখা হওয়ার সময়। এ সেই কবিতার মুহূর্ত, যা কবিকে প্রতিনিয়ত জাগ্রত রাখে।
পৃথ্বীর কবিতার বৈশিষ্ট্য হল, শান্ত তথা ধীর রসের কথোপকথন। মনে পড়ে যায় কবি দেবাশিস তরফদার-এর আপেলের বিকল্প-এর কবিতাগুলির কথা। মনে পড়ে যায় প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত-র অন্তর্গত কথোপকথন এবং জগতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা। কাবাডি নামক কবিতাটির কথা এক্ষেত্রে বলা যায়। একটি সাধারণ বিষয়ে যে অসাধারণ রয়েছে, তাকে দেখার চোখ পৃথ্বীকে পৃথ্বী করেছে।

" এই যেও ফেরত আসা, একে ভয় নিয়ন্ত্রণ করে
এই যে চুক্কি দিই, সেটা ইচ্ছাকৃত

যেদিন আর পারব না,
আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে"

বা ব্যাডমিন্টন কবিতাটিতে,-

" গত শীতকালে শেষ আমাদের দেখা হয়েছিল

এখন সে সব স্মৃতি, কত না সুখের মনে করে
তোমাকে পাঠাতে গিয়ে, দেখি তুমি প্রতিযোগী ভাবে
আমার কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সে সব স্মৃতি
ফেরত পাঠাও"

কখনও কখনও মনে হয় জীবনের প্রতিটি ঘটনাই প্রতীকি। এক চিরায়ত প্রতীকের মত চলছে নানা ঘটনা। আমরা সে সব ঘটনাগুলির সঙ্গে বাস করতে করতে চিনতে পারছি না প্রতীকগুলির নিহিতার্থের শব্দ ও সত্য। কিন্তু আস্তে আস্তে জীবনের এই সত্যগুলি   নিজেদের ভিতরে থাকা আবরণ উন্মোচন করে দেখিয়ে দেয় সত্যের মুখ। হয়ত সেই মুখ ভাঙাচোরা, হয়ত সেই মুখে ডিপ্রেশনের ছাপ, আবার হয়ত বা সেই  মুখ নির্জন, নিদ্রিত, উদাসীন। রিক্সা কবিতার মতো। যেখানে কবি বলছেন-" জীবনে শান্ত হলে , মানুষ যা দেখে, সবই ঠিক"।
এমনই আশ্চর্য সব কবিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথ্বীর কবিতার বইটিতে। জ্যোতিষ, ডিপ্রেশন, ডুয়ার্স, শ্রাদ্ধ, স্নেহ, পিপাসার্ত, আমার জটিল মুখ ইত্যাদি নানান কবিতার কথা বলা যায়। কবিতাগুলি তুলে দিলে এখানে বইয়ের ক্ষতি। তাই শুধু তাদের নাম উল্লেখ করলাম।
তবু একটি দুটি কবিতা এখানে না তুললেই নয়। কারণ জেন গল্প বা জেন কবিতার মতো সিদ্ধি স্পর্শ করেছে সেই সব কবিতাগুলিকে।
যেমন সন্তান কবিতাটি। কী অদ্ভুত সত্য। কী নির্মেদ সেই সত্যের ভাষ্য!

সন্তান

একটা ঘুড়িকে ওড়ানোর জন্য,
লাটাই তার সমস্ত সুতো দিতেই প্রস্তুত থাকে।

শুধু ঘুড়ি যত উপরে ওঠে
নিয়ন্ত্রণ কেমন যেন আলগা হয়ে যায়।

এই ছোট কবিতার বইটিতেও একটি না-বলা সীমান্ত আছে। আর সেই সীমান্ত খুব নিপুণভাবে বইটির এক পর্যায়কে আরেক পর্যায়ের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে বলে মনে হয়। 'আমার জটিল মুখ' শুধু একটি সিরিজের নাম হয়, বরং একটি পর্যায়ের নাম। আর তা একপ্রকার সন্ধিক্ষণের পর্যায়। আর কী নিপুণ সেখানকার নির্মেদ নিপুণ শব্দের ব্যবহার। আমার জটিল মুখ- এই সিরিজের দ্বিতীয় কবিতায় এসে টের পাওয়া যায় কীভাবে একটি শব্দের ব্যবহারে সম্পূর্ণ কবিতাটিকে বদলে দেওয়া যায়।

" খইয়ের ভিতরে ওড়ে শোক

দধিকর্মার দিন ভোরবেলা বাড়ির পুজোতে-
মা-কে দেখি এককোণে, চুপচাপ মরণের দলা
মাখে আর ডাকে বসে ঃ আরেকটু নিবি? নিলে আয়-
'বল হরি, হরিবোল' আমার মাথায় ঘোরে স্মৃতি"

বোধের শ্মশানে যে কবি পড়ে থাকা চেতনার হাড়-কে প্রত্যক্ষ করেন, তিনি যে নীরব হয়ে যাবেন, তা-ই তো প্রত্যাশিত। ঠিক তেমন-ই প্রত্যাশিত ছিল এক আচমকা জাম্প কাটের। যা এই কবিতার বইয়ের দ্বিতীয় পর্যায় বলে মনে হয়। 'সুধা তোমাকে ভোলেনি'। প্রথম ও এই শেষ পর্যায়ের মধ্যবর্তী ধূসর অঞ্চলটি হল ' আমার জটিল মুখ'।  এক থমথমে প্রেম, অথচ তাতেই মুক্তির রেখা। আবার এই কবিতাগুলি কবির অন্তর্গত জার্নাল বলাও যায়। 'একুশ বছরের ছেলে বিকেলের গড়ের মাঠ আর গঙ্গার ধার ফেলে রেখে 'কথামৃত'-র দিকে চলে গেল'। শোক এখানে প্রকৃত বেদনা, দুঃখ এখানে 'বড় দুঃখ' হয়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। সুধা তোমাকে ভোলেনি-সিরিজের দ্বিতীয় কবিতাটি এক দার্শনিক, এক ভক্ত এবং এক কবিকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। অনুপস্থিতি যে একপ্রকার উপস্থিতি, ভক্তি ও প্রেমের এই হাত ধরে থাকাতেই জগতের সমস্ত সুধা নিহিত আছে বলে মনে হয়। কিন্তু সব শব্দের সব যন্ত্রণার, সব কাব্যের শেষে এক ফোঁটা চোখের জল ছাড়া মনে হয় আর কিছুই থাকে না। কী চরম মমতায় তাই লেখা হয় এই কাব্যগ্রন্থের সমস্ত কবিতা। কাফকার প্যারাবেলের মতো এই সব কবিতার কথন, অথচ তা কাফকাস্ক নয়। বরং অনেকটাই ভারতীয়, মীরা বা রাবেয়াকে মনে পড়ায়। তাই কবি লেখেন-" তোমাকে গাছের সামনে দাঁড়াতে দেখলেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন হু হু করে আমার। আমি জানি তুমি যাও পাখির বাসার খোঁজে। এক-একটা পাখি উড়ে গেলে তোমার মনে পড়ে বাবার মুখ। মায়ের মুখ। মনে পড়ে সেই কবে একসাথে বেড়াতে যাওয়ার দিন"।
এমন এক ভাষা, এমন এক ভাষ্য বা বলা যাক এমন এক সুর কবি এই বইতে বেঁধেছেন, তা পাঠক হিসেবে আমাকে মনে পড়ায় প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত-র কথা। এক্ষেত্রে বলা ভালো, আমি আবহর কথা বলছি। যে আবহ ধীরে ধীরে বাজে। যে আবহ জানে, সেও নিমিত্ত মাত্র। তার আবাহন নেই, বিসর্জনও নেই।

সঞ্জীব চৌধূরীর প্রচ্ছদে যে নির্জনতা আছে, তা এই বইয়ের সুরটিকে বেঁধে দিচ্ছে।

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...