Saturday, August 11, 2018

ক্রোড়পত্রের লেখা : কস্তুরী সেন





  ' পাগল একজন আমাকে বলেছিল/ জানেন ছোটবাবু আমার ছুটি নাই!'


টালিগঞ্জে আমাদের পাড়ায় ছোটবেলায় গান শেখাতেন একজন আমাদের ছোটবেলা বলতে নব্বইয়ের মাঝামাঝি, নব্বইয়ের শেষ সে সময়টায় বেশ নিয়ম করে সন্ধেবেলা গানের রেওয়াজের শব্দ ভেসে আসত পাড়ার কিশোরীসমন্বিত পরিবার গুলির একতলা দোতলার পর্দা ওড়া জানালার ওপার থেকে কিশোরসমন্বিত পরিবার থেকেও, কদাচিৎ তো এই, সুতপা বসু বা অমন একটা কিছু হবেন, পদবী তত মনে নেই, আমাদের চলতি ডাক ছিল 'সুতপামাসি'তাঁর কাছেই 'ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো' অথবা 'যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে/স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি' ইত্যাদি সুরে বেসুরে গেয়ে আমরা দু তিনটে পাড়ার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠছি যখন, দুর্গাপুজোয় অষ্টমী কি নবমীর 'বিচিত্রানুষ্ঠান'-এ মহোৎসাহে গলা মেলাচ্ছি স্টেজে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে, পাড়ার পুজোর স্যুভেনিরে 'কণ্ঠসঙ্গীতেঃ' হেডিং দিয়ে আরও জনা পনেরোর সঙ্গে ছেপে বেরোচ্ছে ডাকনাম, তখন এই সুতপামাসির গান শেখানো বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ কারণ? কারণ তাঁর জরায়ুতে ধরা পড়েছে ক্যান্সার, দীর্ঘ চিকিৎসাপর্ব সামনে সে সময়টায় আশ্চর্যজনক ভাবেই ক্যান্সারের রোগী চোখে পড়ত কম ফলত যেটুকু পড়ত, তা আত্মীয়পরিবার পাড়াপড়শির কাছে প্রকৃত অর্থেই আতঙ্ক, বেদনা, নৈরাশ্যের কারণ হয়ে দাঁড়াত
                                     সুতপামাসি আমার জীবনে দেখা প্রথম ক্যান্সার সার্ভাইভার কলকাতায় এবং রাজ্যের বাইরে লম্বা চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন যখন সে এক সত্যিই আনন্দের ঘটনা ছিল 'স্বাধীনতা' সংখ্যায় লিখতে বসে সুতপামাসির এই রোগের কাহিনিটি অবতারণার পিছনে যে উদ্দেশ্য রয়েছে তাতে পৌঁছবার আগে সেরে ফেলতে হবে গল্পের বাকিটা অত দীর্ঘ রোগভোগের পর সুস্থ হয়ে ফিরে এসে আশেপাশের প্রত্যেকের কাছেই যথোচিত সমাদর সসহানুভূতি পেয়েছিলেন সুতপামাসি তাঁকে নিয়ে একটি চাপা কৌতুকের আবহ তৈরি হতে দেখলাম এর পরের পর্বে, যখন আবার তিনি গান শেখাতে বেরোতে শুরু করলেন, অথবা আগের মতোই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অন্যান্য জায়গায় কৌতুকের প্রধান কারণ তাঁর অসুস্থতা পরবর্তী চেহারা চিকিৎসা করতে গিয়ে কেমোথেরাপি, ওষুধ ইত্যাদির প্রভাবে মধ্যত্রিশের সেই বধূটি তাঁর চুলগুলি খুইয়েছিলেন, তিনি ফিরে আসেন প্রায় কেশহীন একটি মাথা নিয়ে এবং ভয়ের কোন কারণই নেই যে ব্যাঙের গল্পের ছেলেদের মতো পাড়াপড়শি তাঁর সেই প্রায় মুড়োনো মাথাটি থেকে একটি একমাত্রিক সাদাকালো কৌতুক লাভ করেছিল
                                        কৌতুক এজন্য যে মাসি তাঁর চুলগুলি ফেরত পাবার অপেক্ষায় বসে না থেকে একটি দীর্ঘলম্বিত উইগ ব্যবহার করতে শুরু করেন এবং হতে পারে তিনি যে ন্যাড়ামাথাটি দ্যাখাতে স্বচ্ছন্দ নন, সে কৃত্রিমতা তাঁকেও একধরনের সঙ্কোচ দিয়ে থাকবে, যে সঙ্কোচ এড়াতে তিনি পূর্বেকার তুলনায় সাজগোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দেন অনেকটাই রোগের আক্রমণের মালিন্য স্বীকার করতে পারার মধ্যে একটি দৃঢ়চিত্ততা থাকে তার মতো সদর্থক কিছু নেই কিন্তু আজ, এই দুহাজার আঠেরো সালে এসে আমার সেই পাড়াটিকে মনে পড়লে, পুজোপ্যান্ডেলে নকল চুল এবং মেক-আপ শোভিতা সুতপামাসিকে দেখে অপরাপর জনের কিঞ্চিৎ ঠোঁটমুচড়োনো হাসিগুলি মনে পড়লে,  সামান্য হতাশ লাগে রোগের অনুজ্জ্বলতাকে স্বীকার করে স্বচ্ছন্দ যিনি তাঁর দার্ঢ্যের সামনে মাথা নোয়ানো অবধারিত, কিন্তু সেই দার্ঢ্য নেই যাঁর? যিনি সুতপামাসির মতোই গোপন করতে চাইবেন তাঁর আপাতকুরূপতাকে? প্রকাশ্যে না হোক, জনান্তিকে আমরা তাঁকে মানুষ হিসেবে ন্যূন ভাবব বুঝি? যেমন ভাবতেন সাতানব্বই সালে অনেকেই, এবং যেমন হয়ত আমরাও অনেকেই, আজও
                                      ফিরে আসা যাক গল্পের নেপথ্যের উদ্দেশ্যটিতে উদ্দেশ্য না বলে বলা ভাল নেপথ্যের জিজ্ঞাসাটিতে বরং বা এমনকি জিজ্ঞাসাও নয়, ধোঁয়াশায়--'স্বাধীনতা', আক্ষরিক রকমে শব্দের অর্থ তবে কী? স্বাধীনতা একমাত্র কি তাই যা কখনোই সমাজ/সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখে যা ইতিবাচক, তার বিরুদ্ধে যাবে না? গেলে তার নাম হবে পশ্চাদপসরণ? নাম হবে সীমাবদ্ধতা, এমনকি অনাচারও?
                                      সুতপামাসির গল্পটি উদাহরণ মাত্র একমাত্রিকও অবশ্যই তবুও, বহুমাত্রিক আরও নানা উদাহরণই ছড়িয়ে আছে আমাদের এই একুশ শতক দুনিয়াদারিরই কোণায় কোণায় অতিসাম্প্রতিক #MeToo মনে পড়ছে যেমন ফেসবুকে এক পরিচিত মহিলার পোস্ট পেয়েছিলাম, মী টু'র কোন বিরোধিতা না করেই যিনি বলছেন তিনি মনে করেন না প্রতিটি মেয়ের জীবনেই বাধ্যতামূলক রকমে এমন ঘটনা ঘটেছে, দু একটি সৌভাগ্যময় ব্যতিক্রম আছে বইকি, সে কথাগুলি সামনে এলেও জোর পাওয়া যায় বড়, স্বাভাবিকতা তো সেগুলিই তাঁকে অপদস্থও হতে দেখেছিলাম ভালরকমে, তৎক্ষণাৎইএকাধিক প্রশ্ন, যা উড়ে এসেছিল, ব্যঙ্গও, তা এক করলে দাঁড়ায় এই যে তিনি আদতে মেয়েদের এই অকপট স্বীকারোক্তির জায়গাটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না, বরং বলছেন এগুলি সবই অতিকথন সামান্যকে অলোকসামান্য করে দেখানোর প্রয়াস এবং মহিলা হয়েও তিনি ধার করেছেন মূলত দমনপন্থী পিতৃতন্ত্রেরই স্বর
                                       'স্বাধীনতা' শব্দটিকে 'দিবস' জাতীয় শব্দের অনুষঙ্গ থেকে খসিয়ে এনে যদি ভাবতে যাই আজ, তবে আদৌ কি দেখব না, তা আসলে এই দিনানুদৈনিক অজস্র সাধারণীকরণের গণ্ডি ভেঙে ফেলার কথাই বলছে কোথাও? সাদা এবং কালো, ভাল এবং মন্দের এক লাইনটানা ধারণার মাঝপথে দাঁড়িয়ে একটি এমন ছাইরঙা অঞ্চলের, একটি এমন দিগন্তের কথা বলছে, যা মানুষকে নিজস্ব রকমে ভাববার, নিজের মতটি ধরে চলবার অধিকার দেয় বহুদূর হয়ত শেষ পর্যন্তই, যদি না তার সে ভাবনা, তার সে মত, অপর বহুজনের ক্ষতি করে সরাসরি? এবং প্রাতিষ্ঠানিক বা সংখ্যাগরিষ্ঠের হিতকামিতা তথা সদর্থকতার বিপরীতে গিয়েও কখনও কখনও তার সেই নিজস্ব মতের 'ছুটি' দিচ্ছে তাকে? দিচ্ছে ব্যক্তিগত ইচ্ছেয় নিজের দুর্বলতাগুলিকে, নিজের প্রথাসিদ্ধ না হওয়াগুলিকে, তথাকথিত রকমে 'যথাযথ' না হওয়াগুলিকে প্রকাশ করার মতোই প্রকাশ না করারও অধিকার?
                                          শ্রাবণ পেরিয়ে শরতে প্রবেশ করতে চলল বছর, কাছে তো আসছেই বাঙালির আনন্দময় ছুটির দিনগুলি গণ্ডিবদ্ধতা থেকে ছুটি মিলুক সামান্য, যে কোনরকম


No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...