Saturday, August 11, 2018

গ্রন্থ আলোচনা- হিন্দোল ভট্টাচার্য




          তিন ভিন্ন ব্যক্তিত্বের অন্তর্গত কবিতা



সিদ্ধার্থ ও তিন যুবক
অরণ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
হাওয়াকল
১৫০টাকা

আমার নগ্নতা ঢাকো
বরুণ দে
প্রতিভাস
১৫০টাকা

উড়ন্ত ডলফিন
উৎপল চক্রবর্তী
সিগনেট
১০০টাকা







গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ বইমেলা ২০১৪। তার পর আবার প্রকাশিত হয়েছে হাওয়াকল থেকেই ২০১৮তে। কবি অরণ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'সিদ্ধার্থ ও তিন যুবক'। নিঃসন্দেহে এই কবিতার বইটি বাংলা কবিতার বইয়ের জগতে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দাবী করে। কিন্তু কেন? এ সব বিষয়ে আসলে, তাত্ত্বিক আলোচনার দিন ফুরিয়েছে বলেই মনে হয়। তার অন্যতম কারণ যদি হয় আলোচনা নামক বিষয়ের প্রতি অনাস্থা, তবে আরেকটি কারণ হল, তত্ত্ব বা আলোচনা সত্যিই কোনও সৃজনশীল কাজকে কতটা ধারণ করতে পারে, সে সম্পর্কে হয়ত নান্দনিক এক বিতর্ক উঠেই গেছে। তবে, যাই হোক, বিনয় মজুমদার বলেছিলেন- নিষ্পেশণে ক্রমে ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে/ হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত। অরণ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধার্থ ও তিন যুবক কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি সেরকম। এক একটি কবিতা এক একটি হীরক। কিন্তু এই কাব্যের হীরকজন্মের পিছনে রয়েছে বহুদিনের নিষ্পেষণ। যন্ত্রণা সহ্য করার অসীম শক্তি ও সাধনা। বর্তমান সময়ের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের যুগে এই সাধনা খুব কম কবির মধ্যে পাওয়া যায়। হয়ত সেই অপ্রত্যাশিতের স্পর্শ পেয়েছেন কবি, যে কারণে এই কবিতাগুলি এত অনায়াসে উঠে এসেছে।

কথা ও কথা বলার অভিনবত্ব- এই দুইয়ের সহাবস্থান বাংলা কবিতায় অরণ্যকে স্বতন্ত্র করেছে সন্দেহ নেই। কথা কি আর অনেকগুলি হয়? কথা হয় সীমিত। কিন্তু সেই সীমিত কথাকেই নানারূপে দেখার নাম-ই কবিতা।  বিভাব কবিতায় যেমন ফুটে ওঠে-" জন্মের পুনর্বাসন দিয়ো/ রুটি আর ফল দিয়ো দয়ার ঝুড়িতে/ দোঁহা নিয়ো, প্রেম নিয়ো, নিয়ো অন্তর্যাম/ গেলাসে গেলাসে পান করো যদি-/ তবেই তো পূর্ণ হব/ মৃত্যুকেও জানব সেদিন/ পুনর্জন্ম নাম"। এই ভাবনাই তাকে এক অবধারিত জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের কবিতে পরিণত করে, যিনি দুই দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকেন এক নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে। কিছু অদ্ভুত এপিফ্যানিক মুহূর্ত তৈরি হতে থাকে তাঁর এক একটি কবিতায়। কী বলছি মিলে মিশে যায় কীভাবে বলছি তার সঙ্গে। 'এমনো তো হয়' কবিতায় যেমন তিনি লেখেন- " এমনো তো হয়, নিজেকে ভিক্ষা নিতে এসে ভিখারি দিয়ে গেল সবই"।

সেরকম-ই 'হ্যাঁ' শীর্ষক কবিতায় লেখেন- " সমস্ত 'না'-এর মধ্যে একটি একাকী 'হ্যাঁ' পড়ে আছে"
আশ্চর্য এক প্রেরণার জগৎ রয়েছে অরণ্যের কবিতায়, যেখানে মনে হয় এক অন্তর্লীন ভালোবাসার প্রজ্ঞা তাঁকে ক্রমশ করুণরসে প্লাবিত করছে। তিনি বর্তমান থেকে ইতিহাসের পথে, অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ইতিহাসচেতনার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সময়চেতনা। পাখিদর্শন কবিতাটি ঠিক এমন। ব্রথেল, বাস্তুতন্ত্র, বরাহ অবতার- কবিতাগুলিতে তেমন।

এই কবিতাগুলির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত, সময়চেতনার ক্যানভাস যেমন তাঁর কবিতাকে এক চিরকালীনতার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, তেমন ভাবেই কিছু এমন কবিতাও আছে, যেগুলি মানব-অভিজ্ঞতা ও মনের এক চিরকালীন বেদনা ও সত্যের জগতের কাছে নিয়ে যায় আমাদের।
নীচে রইল তেমন একটি কবিতা-

নদীকে বলি ঢেউ খেলো, পাহাড়কে বলি, বমি করো ঝর্না,
রাস্তাকে বলি, জঙ্গলে হারিয়ে যেয়ো না, তুমি কারো প্রেমিকা নও!
তবে আমার বলার অনেক আগেই তারা একা একা সব কাজ ক'রে ফেলে

অনেক রাতে যখন বাড়ি ফিরি, দেখি--
নদী, পাহাড়, রাস্তা, আমাদের দুই ভাই এক বোনের মতো
ছোট্ট চৌকিতে ঘুমোচ্ছে।
                                                         ( বাবার মতো)

সিদ্ধার্থ ও তিন যুবক শীর্ষক কবিতাগুলি, প্রকৃত অর্থেই আমাদের এক গভীর গহন ইতিহাসের কাছে নিয়ে যায়, যখন আমরা জগতের এক দুঃখময় সত্তার কাছে আত্মসমর্পণ করি। ন্যারেটিভের মাধ্যমেও যে অব্যক্তের কাছে পৌঁছনো যায়, এই কবিতাগুলি তার প্রমাণ। হৃদয় ও মেধার সবটুকু নিংড়ে কবিতা লেখেন অরণ্য। সেই কবিতাগুলির মধ্যে ছায়া ফেলে জীবনদেবতার আশ্চর্য এক নিষ্ঠুর বেদনা। সেই বেদনায় চোখের জল ফেলার মধ্যেই যেন থাকে জীবনের প্রতি গাঢ় মমত্ববোধ। যেমন এই নির্জনতা লেক শীর্ষক কবিতাটি-

এই অব্দি এসে আর কোনো বাস নেই, গেস্টহাউস নেই
দোয়েল পাখির মতো সাদাকালো রাস্তা উড়ে গেছে আপন খেয়ালে
তার ডানা থেকে ঝরে পড়ছে খেলনা বাড়িঘর, নদীর ড্রেন
কাঁচাপাকা ঘাসওলা ফসলের মাঠ

এরপর অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা
তুমিও আমার কথা ভাবো
পার্স থেকে ফেইস-পাউডার খুলে সামান্য ব্রাশ করো
নিজের মুখের দিকে দ্যাখো-
নির্জনতা লেকে কিছু অতিথি পাখি উড়ে এসেছিল একদিন
ভিনদেশি আবহাওয়া থেকে

জীবনের মাঝে যে অপ্রত্যাশিত সত্য সহসা মানুষের মনকে চিরকালীন সত্যের দিকে নিয়ে যায়, সেই সব সত্য অতি সহজ ভাবে ধরা দিয়েছে অরণ্যের হাতে। যেমন-

ফুটির কী খেয়াল, সে বেলে মাটির হৃদয়ে গিয়ে ফলে
তুমি জানো এইসব ফসলের আত্মকথা

যে রোপণ জানে, সে তো অন্ধ
বীজ তার চোখ নিয়ে মাটি ফুঁড়ে ওঠে
                                                            (কী খেয়াল)

তবু কী সংযত তাঁর কাব্যভাষা! যেন প্রকৃতির মধ্য থেকে বাছাই করে নিয়ে আসছেন এক একটি কাব্যমুহূর্ত। কাব্যভাষায় এই সংযত আত্মপ্রকাশ-ই তাঁর কবিতার এক অসামান্য বৈশিষ্ট্য। উচ্চারণের সংযম, দৃশ্যকল্পের সংযত প্রকাশ, তথাকথিত জটিল চিত্রকল্পেও রয়েছে সহজ নির্মাণ। এমন নির্মাণ, যেখানে মনে হয় না তা নির্মাণ বা ক্র্যাফটসম্যানশিপের খেলা। মনে হয় সহজ সাবলীল ভাবে দৃশ্যটিই তৈরি হয়েছে।
একজন কবি যখন জানেন কী বলতে চাইছেন এবং কীভাবে সেই কথাগুলি বলতে হবে, এবং সেই কবির যদি সে কথাগুলি বলা ছাড়া আর উপায় থাকে না, তখন সৃষ্টি হয় প্রকৃত শিল্পের।
আরও একটি কথা এই বইটি সম্পর্কে মনে হয়, আর তা বাংলা কবিতায় বহুকাল পরে উঠে এল বলা যেতে পারে। তা হল, মহাকাব্যিক নিরভিসন্ধি।
অরণ্য-র এই কাব্যগ্রন্থের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল বাচ্যার্থের অভিনবত্ব। যেন তিনি পরিপ্রেক্ষিতটিকেও সম্পূর্ণ উলটো করে দেখেন। পরিপ্রেক্ষিতকে অন্যদিক থেকে দেখার ভাষাই তাঁর কবিতাকে এক অন্য জায়গায় নিয়ে যায়।
একটি কবিতা তুলে দিয়ে ব্যাপারটি বলা যায়-

শিস বেলুন

চিৎকার ফুরিয়ে চুপসে
                            নিচে নেমে আসছে
                                                     যুবকের ফুসফুস

প্রচ্ছদ ভাবনা ও রূপায়ণ থেকে কবিতা-- সবক্ষেত্রেই সর্বাঙ্গসুন্দর এই বইটি প্রকৃত অর্থেই নতুন কবিতার দিকে বাংলা কবিতাকে নিয়ে যাচ্ছে বলা যায়।



" বোড়ের চাল অসম্ভব কঠিন বলে
যে বন্ধু চুপচাপ অন্ধকার বুকে নিয়ে
নির্লিপ্তভাবে ঢুকে গেল কবরে,
অন্ধকার কবরে সে এখনও দাবা খেলে...
                                                     নিজের সঙ্গে"
                                                                    (বোড়ের চাল)

'আমার নগ্নতা ঢাকো', কবি বরুণ দে-র কাব্যগ্রন্থ, যার পাতায় পাতায় বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। পুরো কবিতার বই জুড়েই এক অপর-সত্ত্বার খোঁজ। যেন সমস্ত বই জুড়ে বার্গম্যানের দ্য সেভেন্থ সীল-এর চিত্রনাট্য চলছে। স্বভাবতই, প্রতিটি কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মৃত্যুচেতনা। কখনও তা প্রত্যক্ষ, আবার কখনও প্রচ্ছন্ন। গল্প, কবিতা, সুররিয়ালিজম এবং আলো-ছায়ার পরিপ্রেক্ষিত মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে। এক অন্ধকার সময়ের মৃত নগরীর দিকে যেন ছায়ামানব হেঁটে চলেছে। আর তার সেই হেঁটে চলার অভিজ্ঞতার স্বরলিপিই এক কাব্যগ্রন্থের অভিযাত্রা। এ হল সেই অপরত্বের দিকে এক অপর মানুষের যাত্রা। যিনি জানেন- " যিনি চলে গেলেন তিনি কি কষ্ট পেলেন/ যিনি রয়ে গেলেন!" এই অভিযাত্রার সঙ্গেই মিলেমিশে গেছে তাঁর মানুষের দুঃখময় জীবনের এক একটি অধ্যায়। কান্না, ঘোরানো সিঁড়ি, বন্ধ দরজার সামনে- প্রভৃতি কবিতা এতটাই ক্রিটিক প্রুফ, যে সেগুলি সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার থাকে না আর। যৌনতা ও মৃত্যুর এক অপরিসীম তীব্র মৈথুনের কবিতা হয়ে ওঠে 'আমার নগ্নতা ঢাকো' শীর্ষক কবিতাটি। সেখানে কবি বলেন-" নদীর কেউ বন্ধু হয় না, ছিল না আমারও/ শ্ত্রুর মতো মৃত্যুও চেয়েছিল/ নিঃশর্ত আনুগত্য। পারিনি/ একটা বিপরীতমুখী টান অনুভব করেছি/ উপলব্ধি করেছি জীবন আর মৃত্যুর মাঝে সেই/ অনন্ত বিস্ময়।" জীবন আর মৃত্যুর মাঝে অপূর্ব বিস্ময়ের মতোই বরুণ দে-এর এই কাব্যগ্রন্থ।
মৃত্যুচেতনা এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুটে আছে সেই বিস্ময়ের মতোই। অনন্ত প্রতীক্ষা, অশ্বমেধের ঘোড়া, ক্রান্তিকাল, শূন্যযাপন প্রভৃতি কবিতার মধ্যে সেই বিস্ময়ের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। কবির ব্যক্তিত্ব এখানেই, যে হীরের বিভিন্ন তলে বিভিন্ন প্রতিবিম্বের মতো কবির মৃত্যুচেতনার বিস্ময় নিজেকে প্রকাশ করে। কবির প্রায় বেশিরভাগ কবিতাতেই একটি কথা ঘুরে ফিরে আসে- "অনেক তো হল দেখা, এবার ফেরার পালা"।
হয়ত একটা হিস হিস শব্দের মতোই এই ভাবনা কাঁপিয়ে দেয় আমাদের অস্তিত্বের ভিত। মোহনা ( শব্দটি মোহানা হওয়া উচিত) কবিতাটিতে সেই ভাবনার বীজ নিহিত আছে। যেখানে কবি বলছেন
                                    "চলে যায়। এভাবেই ভেসে যায়
                                    অসমাপ্ত কবিতা, খেয়া নৌকো, বিরহী রাত।
                                     নদীর স্রোতে ভেসে যায় পোড়া কাঠ
                                                                                      মোহনায়!"

ইনিফেরনোর মতোই আবার আরেক জার্নি শুরু হয় তাই। এখানে কবি মৃত্যুর সঙ্গে কথোপকথনের সময় বলতে ভোলেন না- ফিরে আসব।
এই কবিতার বইটিতে সম্মিলিত প্রতিবাদ কবিতাটি হয়ত মানানসই নয়।
প্রচুর ভালো কবিতা এই আধুনিক কালের মৃত্যুর সঙ্গে কথোপকথনের বইটিতে আছে। কিন্তু মিশে আছে আবার এমন কিছু কবিতা, যা হয়ত এই বইয়ের কবিতাগুলির রিদম এবং অভিযাত্রার সঙ্গে যাচ্ছে না। তাই বইটি একটু সম্পাদিত হলে আরও নিখুঁত হত বলে মনে হয়।
সুদীপ্ত দত্ত-র প্রচ্ছদ এবং প্রতিভাসের প্রডাকশন যথাযথ।


তৃতীয় কবিতার বইটি কবি উৎপল চক্রবর্তীর উড়ন্ত ডলফিন। সিগনেট থেকে প্রকাশিত।
সমগ্র কবিতার বইটিতে প্রায় পঞ্চাশের উপর চতুর্দশপদী কবিতা রয়েছে। কিছু কবিতাকে এই কবিতাগুলির মধ্যে সনেট বলা যায়, যেগুলিতে শেক্সপীরিয়ন অন্ত্যমিল কাঠামো রয়েছে। আবার অনেক কবিতাতেই সেই কাঠামো থেকে কবি বেরিয়েগেছেন বলা যায়। কবির দেখার চোখ অনন্য। আধুনিক চিত্ররূপময়তা যদি বলা যায়, তবে তা এই কবির কলমের মাধ্যমে ভাস্বর হয়ে ওঠে বিভিন্ন কবিতায়।
যেমন- শিসমহলে যখন সে চায়, নামে উড়ন্ত দধীচি

বিভিন্ন চতুর্দশপদীতে একটির পর একটি ইমেজ আসে। অভিনব সেই সব ইমেজের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় কবির নিজস্ব অভিযাত্রার জটিল অভিঘাত। বোঝা যায়, কবির অন্তর্গত অভিযাত্রা চলেছে এক দুরূহ পথে, যেখানে আধুনিকতার নাম ভাঙা কুলো ছাড়া আর কিছু নয়।

যেদিকে তাকাই দেখি বাহুল্যের ধূসর বালাই
ঈর্ষাম গর্ব, মান ছুঁতে ছুটে আসে মুঠো মুঠো ছাই।

এক প্রকৃত কবির অন্তর্দৃষ্টি আছে এই কবির। যার চোখে তিনি এক অনন্য ভিশনে দেখতে থাকেন তাঁর চারপাশে থাকা সমস্ত কিছুই। নিজেকে তিনি বারবার ছড়িয়ে দিতে চান অসংখ্য-র মধ্যে। জানতে চান, ঠিক কোন পথে তিনি এক নির্জনতম নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবেন। তাঁর এই আত্মসন্দর্ভ ফুটে ওঠে যখন তিনি লেখেন-

একেকটা ঢেউ এসে মিলিয়ে যায় সমুদ্র তীরে।
কখনও আরেকটা ঢেউ এসে যেই মাথা তুলতে চায়,
তখনই কোনও জাহাজ ঠিক তার ঘাড় মাথা চিরে
অভিমুখ বদলে দেয়। তর্কের ডিঙি ডোবে বিশ্বাসে।

যিনি ভাবুক, তিনি তো কোনও সীমানায় আটকে থাকতে পারেন না, তাই তিনি নিজে হাতেই নির্মাণ করেন সীমান্তের পরিধি। আসলে ছাঁচে বা জ্যামিতিতে বদ্ধ পরিসরের মধ্যে কোনও শিল্পীকে যদি ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে তিনি ছটফট করতে থাকেন। এই ছটফটে আকুতিটি কবির প্রায় প্রত্যেকটি কবিতার মধ্যেই স্পষ্ট । তিনি নিজে বলছেন-

সীমানা তোমার হাতে, তাকে তুমি নিয়ে যেতে পারো
যেখানে যেমন খুশি, ফিতেও তোমার মতে তৈরি

আবার সেই চতুর্দশপদীতেই (সীমানা) তিনি বলছেন- সীমা হারানোর সুরে মিশে থাকে সীমান্তের ছোঁয়া।
এই খানেই তাঁর সমগ্র কবিতার বইটিই একটি ক্লাসিক দ্বন্দ্বের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। ঠুনকো নামক চতুর্দশপদীতে তিনি নিজেই সেটিকে বলেন- " যে কাপে আমি চা খাচ্ছি তাকে ভেবেছি শুধুই ঠুনকো/ যেন অর্থহীন কোনও অসমর্থিত গল্পের প্লট"।

প্রতিটি চতুর্দশপদীতেই তিনি নিজের মতো করে তৈরি করেছেন আধুনিক কাব্যের রেটরিক। সেখানে খেলা করেছে হোটেল, নার্সিং হোম, হাসপাতাল, ইস্তাহার, ফ্ল্যাট, বোমা প্রভৃতি নানান আধুনিক অনুষঙ্গ যেমন, তেমন-ই পুরনো ডায়েরির পাতা আর ভ্রূক্ষেপহীন জাহাজের কথা। যেখানে তিনি লেখেন- " নাবিক সফল জানি কুয়াশায় দৃঢ় আলিঙ্গনে" । কুয়াশার মধ্যেই যেন কবি আটকে পড়ে আছেন সারা কবিতার বইটিতেই। আর তাঁকে বেঁধে রেখেছে সনেটের মতো এক কঠিন শাসনের ফর্ম। তাই তিনি হয়ত সজ্ঞানেই সনেটের প্রচলিত ফর্ম থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়।

কবি উৎপল চক্রবর্তী প্রকৃতই একজন কবি, যিনি অভিনব ভাষা ও ভাবনাপ্রবাহে আমাদের বারবার চমকে দিয়েছেন এই উড়ন্ত ডলফিন কাব্যগ্রন্থে। কিন্তু চতুর্দশপদীগুলি অনেক জায়গাতেই সনেট হয়নি। অন্ত্যমিলের প্রকল্পগুলি তিনি রক্ষা করেননি। শেক্সপীয়র বা পেত্রার্ক বা কামিংস-- কোনও ফর্মেই আনা যায় না। এই প্রকল্পগুলি তাঁর নিজের হতেই পারে। অন্ত্যমিলে এক মাত্রার মিল হয় না। এবং বাংলা ছন্দের বিষয়ে আরও যত্নবান হতে হবে কবিকে। কারণ সনেট বা চতুর্দশপদী হলে অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্রকলাবৃত্তের ছন্দটিকে বজায় রাখা উচিত। যুক্তবর্ণ, মুক্তদল, রুদ্ধদল- কোনও কিছুই অক্ষরবৃত্তের নিয়ম অনুযায়ী রক্ষা করেননি অনেক জায়গায়। অনেক চতুর্দশপদীতে একটি লাইন স্বরবৃত্তে তো তার পরের লাইন অক্ষরবৃত্তে। ৩/৩/২ ফর্মেশনে না গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ৩/২/৩ হয়ে গেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে উপপর্বগুলিতে কখনও তিন বা কখনও দুই মাত্রা। সনেটের ক্ষেত্রে কঠোর ভাবে অক্ষরবৃত্তের নিয়মগুলিকে মেনে চলতে হয়।
কিন্তু এই সব বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও কবিতাগুলি নিজের গুণে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেই। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, কবি গদ্যছন্দতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। এই কবিতাগুলিই যদি সনেটের বা চতুর্দশপদীর কঠিন শাসনের হাত থেকে মুক্ত হয়ে লেখা হত, তাহলে, কবিতাগুলি অন্য মাত্রা পেত সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে আরও সম্পাদনা করে, কবিতাগুলি হয়ত এত দীর্ঘ হত না। চোদ্দ লাইনেই কবিতাকে বাঁধতে হবে, এমন মাথার দিব্যি তো কবিকে কেউ দেয়নি।
শাসন যে অনেক সময়েই ভালো শিল্পের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে কবি নিজেই সেই শাসন ছেড়ে অনেক ক্ষেত্রে বেরিয়ে গেছেন।
      নদীতে প্রবল স্রোত, চোরাবালি আছে তাও জানি-
      নদী ধরে দাঁড়িয়েছি, তবু আমি জলেতে নামিনি।




1 comment:

  1. অসম্ভব ভালো আলোচ। নতুন আলো বয়ে নিয়ে আসে ঘরে। ঘাড়ে করে?
    দুটি ঘাড়েই - কবিতার ও আলোচনার
    আহা!

    ReplyDelete

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...