বীজের অধিকারে জড়ানো জীবন
পাপী ও পাপিয়া
পাপী ও পাপিয়া
অরিজিৎ চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ ও চিত্র- সমীর আইচ
আবহমান
৮০টাকা
‘কেন উপনিষদের’ প্রথম খন্ডের পঞ্চম শ্লোকের বঙ্গানুবাদে একটি জায়গায় পাওয়া যায়,
‘ যিনি বাক্যদ্বারা প্রকাশিত হয় না, (পরন্তু), যাঁহার দ্বারা বাক্য প্রকাশ পায় তাঁহাকেই
তুমি ব্রক্ষ্ম বলিয়া জানিও।’ এই উপমহাদেশে কবিতার ঘন রহস্যের মধ্যে
ডুব দেবার প্রথম ক্ষণটি থেকেই আমরা এই বোধ ও স্ফূরিত-চেতনা সঞ্জাত দার্শনিক
উপলব্ধিকে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বহণ করে চলি। এটি আমাদের পবিত্রতম নিয়তীর এক রূপ।
আমাদের অহং ও অহং ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হয়ে থাকে এটি, সারা জীবন।
একজন
কবির সারা জীবনের সাধনাও বোধহয় সেই ‘যাঁহার দ্বারা বাক্য প্রকাশ পায়, তাঁহাকেই’
খুঁজে চলা। পথের সব বাঁকেই তিনি সেই সন্ধান করে চলেন। বারবার পথ বেঁকে যায় তার।
কিন্তু তিনি উঠতে চান সেই নির্জন পাহাড়শীর্ষেই। যেখানে তিনি একা। যেখানে তার
একমাত্র সঙ্গী বাক্য। বাক। শব্দ। ক্রমশ কি শব্দের ভিতর থেকে তিনি আরও আরও আলো খনন
করে তুলে আনতে চান? চান, নিশ্চিত ভাবেই তিনি তা চান। চান বলেই তাঁর প্রকাশ হয়ে পড়ে
ইঙ্গিতময়। সংকেত-প্রায়। আলো-আধাঁরির মাঝখানে অসীম কল্পনার যে মুক্তাঞ্চল, সেখানে
তিনি স্বাধীন রাজার মত বিচরণ করেন।
কথাগুলি
বলার প্রয়োজন হল এই কারণেই যে, কবি অরিজিৎ চক্রবর্তীর ‘পাপী ও পাপিয়া’
কাব্যগ্রন্থটি এই ধারণাটিকেই পুষ্ট করেছে। অরিজিতের এই পুস্তিকাটি তার কবিতা–যাপনের
একটা বাঁককেও সূচিত করেছে বলেই আমার ধারণা। ‘দীর্ঘ কবিতা’ লেখায় তার দক্ষতা
কবিতা-পাঠকের কাছে ধরা দিয়েছে। জটিল অনুসঙ্গ ও তৎসম শব্দের ব্যাবহারে তিনি সাবলীল।
কিন্তু এই কবিতার বইটি সেই সব থেকে যেন দূর। বহুদূর। এখানে অরিজিৎ যেন বাতাসে
অতি-সঙ্গোপনে মিশিয়ে দিয়েছেন তার শব্দগুলি। ঠিক যে ভাবে বাতাসে মিশে যায় জলকণা।
অরিজিতের এই ক্ষীণকায় কাব্যপুস্তিকাটি কি শুধুই প্রেমের আর্তি নিয়ে ফুটে আছে? রবীন্দ্রনাথের
বহুকথিত প্রেম ও পূজার মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্কের আবিষ্কার, তারই যেন এক সম্প্রসারিত
অংশের দিকে ছুটে চলেছেন অরিজিৎ। ‘সেতু’ কবিতায় তিনি লিখেছেন
‘পৃথিবী কোথাও দূরে উড়ে চলা
চাঁদটির
মতো।
দু’জনের দেখা হয় হোক...
সম্পর্ক ভেঙ্গেছে, তাই
দুয়ারে ফুটেছে ক্ষমা ...
প্রকৃত
অশোক।’
এই কবিতাটির সব
থেকে মায়াবী পঙতি নিশ্চিতভাবেই শেষের পঙতিটি। কিন্তু সব থেকে সংগোপনে লুকিয়ে রাখা
মেধাবী পঙতি অবশ্যই তৃতীয় পঙতিটি। দু’জনের দেখা হয় হোক। কিন্তু না দেখা না হলেও
হয়তো ক্ষতি নেই তেমন। কারণ সম্পর্ক ভেঙ্গে গিয়ে সেখানে এতদিনে ফুটে উঠেছে প্রকৃত
অশোক। সব শোক ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়েছে সে।
মিত-কথনের উৎসব আসলে এই বইটি। মাত্র পনেরোটি শব্দে অরিজিৎ
কী লিখলেন দেখা যাক,
‘হামিং বার্ডের মতো
যদি ওড়া যেত
পিছনের দিকে ...
ভাবো এই অসীম প্রবোধ
তোমাকেও চেনাতো নিঝুম!’ (দাম্পত্য)
দু’টি মানুষের
মধ্যে নিবিড় সংযোগ থাকা সত্যেও হয়তো তাদের কেউই কাউকে পুরোপুরি চিনে উঠতে পারে না
কোনওদিন। একে অপরকে অন্ধের লাঠির মত ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে। শুধু তাদের মধ্যে শুয়ে থাকে
একটা ‘নিঝুম’ কিছু।
অন্য একটি কবিতায়, যা অনেকটা হাইকুর মতই অমোঘ, অরিজিৎ
লিখছেন,
‘আমার ভিতরে ফুল নেই
শুধুই
পরাগ
এক ঝাঁক পোকা উড়ে এল ...’ (পাপ)
পরাগ
নিশ্চিতভাবেই পুরুষ যৌনতার প্রতীক। Christianity-তে যাকে বারবার Sin বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাই যেন পোকা হয়ে উড়ে আসছে
ঝাঁকে ঝাঁকে। তারা কি এবার সেই পরাগের ওপর এসে বসবে? কবি কি এই পরাগজন্ম পেরিয়ে খুঁজে
পেতে চাইছেন অন্য এক জীবন? সে দিকে তাকালেই ফুটে ওঠে অনন্ত রহস্য। পাঠককে সম্মোহিত
করে রেখে দেন অরিজিৎ শুধু ইঙ্গিতমাত্র দিয়ে।
এ জীবন হয়তো শেষমেশ এক ব্যার্থ প্রেমের ধারাপাত। অরিজিৎ লিখেছেন,
‘না-লেখা
কবিতা, সে তো তুমি!
একদিন মনে হল
তুমি এক পরজন্মটিলা …’ (মৃগয়া)
এই পরজন্মটিলাটির দিকেই দীর্ঘক্ষণ
চেয়ে থাকি। দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ। শুধু মায়া নয়, তাকে ছাপিয়ে ওঠা এক বিষন্নতা, হাহাকার,
অসহায়তা।
ক্ষতবিক্ষত জীবনের দিকে চুঁইয়ে পড়ে একবিন্দু জল। তার শব্দও শোনা যায়। নির্জনে,
একা হয়ে গেলে।
আর প্রখ্যাত শিল্পী সমীর আইচের
ছবিগুলি সম্পর্কে আমার কিছুই লেখার ধৃষ্টতা নেই। বইটি হাতে নিয়ে পাঠককে ডুবে যেতে হবে
তা তে।
No comments:
Post a Comment