Monday, August 13, 2018

হয় 'গ্ল্যামারাস পরাধীনতা', নতুবা মুহূর্তের স্বাধীনতা সংগ্রামী : কিশোর ঘোষ








Freedom can be three types... The first is freedom from, the second is freedom for, and the third is just freedom.
(Osho, The book of wisdom, chapter 3.)

আমি চাপা স্বরে নিজেকে বললাম, কাল রবিবার, কাল স্বাধীনতা দিবস
কুনাল বলল, কী বলছ?
তখন সন্ধে যাচ্ছে রাতের দিকে সাড়ে আটটার কাছাকাছি বাজে অফিস ছুটির পর আমি আর আমার আড়াই মাসের অফিস-বন্ধু (কলিগ) কুনাল যাচ্ছি ফুলবাগানের হরিয়ানা মোড় সেখান থেকে বাস হাউসিঙ স্টপে নামব তারপর উত্তরায়ণের গা ধরে ট্রাম লাইনের উপর দিয়ে অনেক স্বাধীনতা আর পরাধীনতার দোকান-বাড়ি, মানুষ, শিশু, কুকুর, গাড়িঘোড়া দেখতে দেখতে হাঁটব লাইন টপকে উল্টোডাঙা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরব দু'জন কুনাল যাবে বালি আমি মধ্যমগ্রামের বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে... কেন? কারণ বাড়ির দিকে, বাড়িতে মাঝে মাঝে টুকরো স্বাধীনতার মুহূর্ত ওড়ে!
হরিয়ানা মোড়ে এসে কুনাল বলল, 'চলো, দেরি যখন হয়েইছে, তখন একটু চা-সিগারেট খাব'
আমি বললাম, 'হ্যাঁ, মুহূর্তের স্বাধীনতা!'
চায়ের দোকানে দু'কাপ চা বলে ভারী গলায় কুনাল বলল, 'কী বলছ বুঝতে পারছি না!'
আমি রুমালে মুখের ঘাম মুছে বললাম, 'প্র্যাকটিস করছি আগামীকাল রবিবার পাঁচদিনের পরাধীনতার পর তো, কাল মুহূর্তের স্বাধীনতা নিয়ে লিখব হিন্দোলের ওয়েবম্যাগের জন্যে'
'হিন্দোল কে?'
'কবিতার প্রেমিক'
'মানে তোমার কবি বন্ধু হেয়ালি করছ কেন?'
'এখন তো অফিসে নেই, ইন্টারভিউ দিচ্ছি না, দোকান বাজার করছি না, 'বড়' কবিদের সঙ্গে কথাও বলছি না মানে শরীরের স্বার্থ নেই ফল মনকে চান্স দিচ্ছি যদি সে খানিক ক্ষণ আত্মা হতে পারে'
চা এগিয়ে দিল কুনাল চুমুক দিলাম আমি গরম চায়ে জিভ পুড়ল আমি জোরসে বললাম, 'পেয়েছি পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি শাল্লা!'
কুনাল অবাক হয়ে জানতে চাইল, 'কী?'
'শরীর থেকে মন, মন থেকে আত্মা হতে পারলেই স্বাধীনতা গো ফর গোলের (লক্ষ্য) জীবনে বেশিক্ষণ হবে না হয়তো এক মিনিট, না না অতটাও না, ধরো সেকেন্ড তিরিশেক, তারচেয়েও কম এক তারা-খসা মুহূর্ত সময় ছেড়ে সময়হীনতায় যেতে পারলেই 'অ্যাবসুলুট ফ্রিডম'
চায়ের ভাড় ডাস্টবিনে ফেলে সিগারেট ধরালাম আমরা হাওয়ায় ধোয়া ধোয়া স্বাধীনতা ছেড়ে বললাম, এই যে সময়টায় দাঁড়িয়ে আছি এটাই স্বাধীনতা। অফিসের দায়িত্ব আর বাড়ির কর্তব্যের মাঝখানে ভেসে ওঠা চর, যার নাম হরিয়ানা মোড়। তোমার কী মনে হয়?'
কুনাল বলল, 'ঠিকই।'
আমি ভাবি, কুনাল কি ধরতে পারল যা বললাম। ধরার কথা। কারণ সে মাঝে মাঝে ট্রেক করে। বেড়াতে যাওয়ার অভ্যেস আছে। বাঘ-দেখা-টুরিস্ট না। বরং সে শহরে হারিয়ে ফেলা নিজের সঙ্গে দেখা করতে যায় পাহাড়ে, সমুদ্রে। তাছাড়া মুখের উপর সোজা কথা বলতে জানেকথা বলার সময় এক রকমের স্বাধীনতা নেয়। অফিসের বড় কর্তাদের সঙ্গেওকুনাল হাই হ্যালোকে নয়, এফিসিয়েন্সিকে গুরুত্ব দিতে চায়। কিন্তু কর্মসংস্কৃতি পরাধীন হচ্ছে দিকে দিকেভালো বাঁচার স্বাধীনতা দিচ্ছে কৌশল। প্রশ্ন উঠতে পারে---ভালো বাঁচা কাকে বলে? উত্তর যদি হয় 'স্বাধীন ভাবে বাঁচা'তবে পরের প্রশ্ন---সেই বাঁচা কি কৌশলে মেলে? উত্তর---না। কারণ ঘর থেকে কর্মজীবন, আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠায় যাকে প্রতি মুহূর্তে 'রাজনীতি' করতে হয়, সে তো পরাধীন! মায়া-মোবাইলের কাছে পরাধীন, দোতলা বাড়ি, মার্বেলের মেঝে, সোনার গয়না, পাসবুকের আপডেট অংকের কাছে, পুরস্কার মঞ্চের কাছে, প্রতিদিন বিউটি পার্লারে যাওয়া বউয়ের স্তনের কাছে সে পরাধীন ইগোর পুরুষ। সে জানে না, কিন্তু তার স্বাধীনতা হল 'গ্ল্যামারাস পরাধীনতা!'

দুই
'By freedom is not meant any political, social or economic freedom. By freedom is meant freedom from time, freedom from mind, freedom from desire. The moment mind is no more, you are one with the universe, you are as vast as the universe itself.  
' (Osho, The dhammapada: The Way of the Buddha, Vol 1, chapter 9)
 
সোনা বল করল। বিল্টু ব্যাট চালাল। ব্যাটের কানা নিয়ে বল শূন্যে উঠল লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে। আমি পয়েন্ট থেকে শরীর ছুড়ে দিলাম অনন্তে। বাঁ হাতে তালুবন্দি বল কিংবা একটা মুহূর্ত। ক্যাচ লুফে আছড়ে পড়লাম পাড়ার মাঠের সবুজ ঘাসে। আউট। আনন্দে বন্ধুরা ঝাপিয়ে পড়ল আমার উপর
ছোটবেলা থেকে প্রথম বড়বেলা অবধি এরকম কত স্বাধীন মুহূর্ত চেখেছিব্যাট করতাম খুব খারাপ, বল করতাম মোটামুটি। কিন্তু দুর্দান্ত ফিল্ডার ছিলাম। শার্প আই সাইট। ইনবর্ন বডি রিফ্লেক্স। আর আগুপিছু না ভাবা সাহস। (কারণ তখনও ভয়-অভিজ্ঞ নয় 'আমি')। যাক গে, আসল কথা হল ক্যাচ লোফার ওই সময়। মানে ওই সময়হীনতা!
আজ বুঝতে পারি খেলার মাঠেই পেয়েছিলাম প্রথম 'সঙ্গমসুখ'। ক্রিকেটে ক্যাচ ধরার সময়। ওই যতক্ষণ আমি আর বল আল্ট্রা মোশানে দু'জনে দু'জনের দিকে এগোচ্ছি...। বল যতটা যোনি, আমিও ততটা লিঙ্গ। হাতবন্দি বীর্যপাত। স্বাধীনতার চরম। ওই দুই কী তিন সেকেন্ড মহাশূন্যে কাটানো। ওই হল 'নো মাইন্ড'। চিন্তার বাইরে, চেতনার স্বাধীনতা। তখন আর জন্ম নিয়ে ভাবিত নই, মৃত্যু নিয়ে ভাবছি না। স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স ভুলে মেরেছি। কেবল ইগো থেকে অনন্তে উঠে, ক্ষণিকের অনন্তকাল সাঁতরে ইগোর অভিকর্ষে নেমে আসা। ফুটবল মাঠে, রাইট আউট দিয়ে দৌড়চ্ছি, দৌড়চ্ছি কিন্তু স্বাধীনতার দিকে। ডিফেন্ডারদের লাথি খেয়েও থামছি না। ১১টা থেকে ৪টে অবধি স্কুল করেছি। স্কুলই বটে। বিদ্যালয় তো গোটা পৃথিবী---বিশ্ববিদ্যালয়। পরাধীন সিলেবাস নেই যেখানে। নিজের মতো পড়। উঠোনের পোকাধরা গন্ধরাজ পড়ছি, লেবুতলার ছায়া, দড়িতে ঝোলানো খুটতুতো বনের টেপ জামা, মেজো জেঠির ঘোমটা দিয়ে ফুল তোলা দৃশ্য, বর্ষাকালে কেন্নো হাঁটছে দেওয়ালে, বাবার মুখাগ্নি করলাম নিমতলায়। সারাদিন অফিস ঠেঙিয়ে রাতে রান্না করছে অন্নপূর্ণা মা। তারপর ওই দূরে অ্যাডাল্ট সমুদ্র, দেখি ঝাউবনকে কারা প্রাপ্তবয়স্ক করে রেখে গেছে। মদের বোতল আর কন্ডোমের প্যাকেট বালিতে এলোমেলো। বউবাজার দিয়ে হাঁটছি কলেজ বন্ধুর সঙ্গে। রাস্তার দু'পাশে নকল মুমতাজ-মিনাক্ষী-রানি-রম্ভা-ক্যাটরিনারা দাঁড়িয়ে আছে, ওদের খোলা চুল, উন্মুক্ত স্তনের বিষ আঁকছি লুকিয়ে, মিটিং-মিছিল, বৃষ্টিতে আটকে পড়া চায়ের দোকান, ছাদে বসে দেখা রাতের তারাদের আড্ডা, বাস-ট্রাম-অটো, টিভি-কাগজ-ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ, এবং কোন ছোটবেলা থেকে কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা। স্বাধীন হওয়ার অসুখ। ফলে জীবন হলেও কেরিয়ার হল না!
তিন
'To know it is to be free, free from all prisons: the prisons of the body, the prisons of the mind, the prisons that exist outside you.' (Osho, The messiah, Vol 2, chapter 2)
তবু, মুহূর্তকে ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তই বা কজন পায়! এই যে সূর্যদয়ের গন্ধ, বেঁচে থাকার গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জ করছে পাখি-হাওয়া-কাচা রোদ। দুপুরের অবৈধ দোতলায় শাখা-সিঁদুর রঙের স্কার্ট, সাইকেল নিয়ে লাল আপেল, কালো আঙুরের স্কুলে ঢুকে পড়া, জীবন বকা দিচ্ছে মাঝে মাঝে। আর বৃদ্ধ ফেড়িওলার ঘামে যে দুপুর স্নান করছে। রোটি-কাপড়া-মকানের চক্করে লুকোনো কান্না, না বলা প্রেম, ঢেকে রাখতে হয় ধরনের স্নেহ, মুখ খুললে বিপদ রঙের রাগ, ঘৃণা। এবং বিষাদ। এই সবটা লেখার স্বাধীনতা দেয় যে মুহূর্ত তার নাম কবিতা। একটা লাইন। দুটো শব্দ। শব্দব্রহ্ম! যতক্ষণ তার মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকা যায়, ধ্যান হয়ে থাকা যায় ততক্ষণই জীবন।  
Buddha is talking about the reality---the real freedom. He calls it nirvana. The word 'nirvana' is very beautiful; it means cessation of self---consciousness, utter cessation of the self, the naked state of egolessness. It brings great ecstasies, great harvest; inexhaustible treasures it brings.
(Osho, The Dhammapada; The way of the Buddha, Vol 1, chapter 9)
 

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...