ক্রোড়পত্র
স্বাধীনতা! যে শব্দের
মধ্যে বসে আছে অধীনতা স্বয়ং। অন্তত নিজের চাকরগিরি করে যেতেই হবে। চাইলেই আপনি
উইন্ডো সিট পাচ্ছেন না, বস্। আপনি নিয়ম, সময়
এবং অবশ্যই কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্তের অধীনস্থ। এ তো গেল বাহ্য। আপনার
ভিতরে যে লক্ষ-জনায় বসত করছে, যদি তাদের কারোর একজনের ইচ্ছে
না হয়; তাহলে জানালার ধার তো বহুদূর, আফনে
এক কদম আগুইয়া দ্যাহান! আজন্ম নিজের কথাতেই তো উঠছি বসছি। এ যেন এক অনতিক্রম্য
পর্বত। পাথর ঠেলে কিছু ওঠার পরই, ঢাল বেয়ে সে পাথর গড়িয়ে
ভুঁইয়ে। আবার তোলো। এই সিসিফাসের মুক্তি কোথায়? কিভাবে,
কোথায় পাবো নিজের থেকে মুক্তির সন্ধান? মনে
পড়ে The Eagles-এর Hotel California গানের
সেই দুর্নিবার লাইন: "We are all just prisoners here, of our own
device".
জন্মসূত্রেই কি আমরা
পরাধীন নই? আমরা তো কেউ আর স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মা নই। নই
কোনো প্রাথমিক কণাও (elementary particle), যে শূন্য থেকে
জন্মাবো। অবশ্য সেখানেও এক কল আছে। শূন্যের গর্ভ থেকে একা জন্মানো যায় না। জোড়ায়
জোড়ায় জন্ম (pair production), বিপরীত গুনের সমাহার। একজনের জন্ম অপরের ওপর নির্ভরশীল। মৃত্যুতেও তাই। কণা দুটি একসাথে মিলিত
হয়ে শূন্যে বিলীন (pair annihilation)। অর্থাৎ একে
অপরের অধীনস্থ। অবশ্য ব্রহ্মার জন্মের জন্যও প্রয়োজন ছিল সহস্রদল কমল এবং বিষ্ণুর
নাইকুণ্ডল। লালন সাঁই গেয়েছেন, 'কেমনে ঘর
বান্ধিনু আমি শূন্যের মাঝারে'। আমাদের আধার চাই। এই শরীর ও তার অবয়বহীন মনের বাস্তব
কায়া। একটা form. ওইটেই আবার পরাধীনতার বেস নয় কি?
একটা খাঁচা। যার ভিতরে বসে পাখি ভাবে, এই আমার
আকাশ, আমি মুক্ত। আমার কোনো বাঁধন নেই, পায়ে শিকলি নেই। আমাদের দিবাস্বপ্নে আমরা পালটাপালটি করে ফেলেছি পরাধীনতার
সঙ্গে স্বাধীনতাকে। 'পাখি আমারই আঙিনায় থাকি আমারে মজাতে
চায়! একটা বদ হাওয়া..."
এবার আপনাদের শোনাই একটি
গল্প। Déjà vu বোঝেন তো? ট্রেনে
যাচ্ছেন। কয়েকটা স্টেশন’পরে উঠল নীল শালোয়ার। আপনার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল,
'এই ট্রেন অমুক স্টেশনে থামে?' এবং তক্ষুনি
ঝেঁপে বৃষ্টি। আপনার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল ন'বছর
আগের দিন। হুবহু এক। যেন রিপিট টেলিকাস্ট। এমন হয়নি আপনার সঙ্গে? আমার তো বহুবার হয়েছে। হয়। মনে হয় যেন স্বপ্নের ভিতরে আরো একটা স্বপ্ন
দেখছি। তখন নিজেকে শুধোই, 'বাস্তব কী?' জেগে থাকা বলে যা ভাবছি, যা পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে
প্রত্যক্ষ করছি, তাই কি বাস্তব? তাই
যদি হয়, তাহলে স্বপ্ন কি? কেন অনুভব
করি এ আমার প্রথম জন্ম নয়, এর আগেও আমি ছিলাম, পরেও থাকবো। অন্য কোনো ভাবে। হয়তো নুড়ি হয়ে, তুমি
হয়ে, পতঙ্গ বা ঝরা পাতা হয়ে। একই দৃশ্যাবলী, ঘটনা যে বারবার ঘুরেফিরে আসে; তা কী? বাস্তব বোঝার প্যারামিটার কী?
একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, আমাদের জীবন কেমন কোডেড। অ্যালগোরিদিমে বাঁধা। মৈথুন,
আহার, নিদ্রা। এই তিনটে যেন কঙ্কাল। তার ওপর
একটা ব্যাক স্টোরির পরত। অর্থাৎ একটা পরিবার, সেখানে আপনার
জন্ম, সেই সূত্রে কিছু মানুষ আপনার আপনজন, বাবা-মা-দাদা-দিদি-ভাই-বোন ইত্যাদি ইত্যাদি। তৈরি হলো হাড়-মাস। তার ওপরে
ত্বক। আপনার সো কলড ইচ্ছে, ভালোলাগা, মন্দ
লাগা, আপনার 'চয়েস'; মানে রবীন্দ্রসঙ্গীত না এমিনেম, ব্লন্ড না ব্রুন্টি,
ওয়েস্টার্ন না ড্রামা, কত্থক না হিপহপ,
মাটন না চিকেন, ধার্মিক না নাস্তিক... এমন
বিবিধ বাইনারি চয়েস বেসড সিস্টেমে তৈরি হওয়া মন, যা আপনাকে
ডিফাইন করে, অন্তত আমরা নিজেরা তাই মনে করি। কঙ্কাল, তার ওপরে হাড়-মাস বসে একটা পোক্ত অবয়ব দিয়েছে, তার
ওপর ত্বকের প্রলেপ দিয়েছে ফিনিশিং টাচ, পরিপূর্ণতা। এবার
দেবীর প্রাণ সঞ্চার। চক্ষুদান। তৃতীয় নয়নে কুশ ছুঁইয়ে মন্ত্রোচ্চারণ। বেসিক ড্রাইভ,
আমাদের চালনা শক্তি। পাওয়ার সোর্স। দেখবেন নিজেকে খেয়াল করে,
কেন আপনি ঘুম থেকে ওঠেন, একটা কিক, যা আপনাকে জাগিয়ে দেয়, বলে, 'উঠে
পড় বাছা, প্রভাত হইল, মেলা কাজ বাকি,
যেতে হবে হোথা, পৌঁছাইতে হইবে বেলা থাকিতে
থাকিতে'। ঐ যে ভিতরের আকুতি, জেগে ওঠার নেশা, এক
এক জনের এক এক রকম, আমরা অধিকাংশই ঠাওরই করি না, ধরতেই পারি না নিজস্ব বেসিক ড্রাইভ। পাল্টানোর তাগিদ তো দূর অস্ত। তবু
রুটিন মাফিক জীবন চলতে থাকে... সবশেষে আসে কবির নিজস্ব ভাষার জাদু। ওরিজিনালিটি।
পোয়েটিক টাচ। আমাদের কর্নার-স্টোন। কোন ভূত আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়? মনে পড়ে কোন আবছায়া মুখ, অবয়ব? দ্বারা-পুত্র-পরিবার-বাবা-মা-ইয়ার-দোস্ত-অফিস-কাছারি; কিছু না কিছু, কেউ না কেউ, আপনার
দুর্বলতা। আবার সেটাই আপনার শক্তির জায়গা; যে জন্য মার খেয়ে
মুখ থুবড়ে পড়েও ঘুরে দাঁড়ান, ঠোঁট থেকে রক্তের কষ তালু উলটে
মুছে। 'কোন বাগানের ফুলে আমাদের হাসি!' ভেবে দেখবেন, একটা মানুষের জন্য, একটা কিছুর জন্য, আমাদের সর্বস্ব। নার্সিসিস্টের
কাছে এই মানুষটা, সে নিজেই (এই ফাঁকে বলে রাখি, আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি নার্সিসিস্ট, নিজেকেই বোধহয়
সবথেকে বেশি ভালোবাসি!)। সন্ন্যাসীর কাছে পরহিতায় চ, সমষ্টিগত
ব্যক্তি। সংসারীর বউ-বাচ্চা। রোমিওর জুলিয়েট, রাধার কানু।
এইরকম।
তো এই অব্দি পড়ে যাঁদের
মনে হচ্ছে, এর সঙ্গে স্বাধীনতার সম্পর্ক কী?
তাঁদের বলবো, ভাবুন। তলিয়ে ভাবুন। এক এক সময়
এই ডেলি প্যাসেঞ্জারির গতানুগতিক থোড়-বড়ি-খাড়া খাড়া-বড়ি-থোড় জীবনটাকে স্ক্রিপটেড
মনে হয় না কি? যেন চতুর কোনো ঔপন্যাসিকের সুলিখিত কোনো
উপন্যাসের কুশীলব আমরা। আমাদের ডায়লগ, কর্তব্য-কর্ম
বাঁধাধরা। মাঝে খালি জন্ম ও মৃত্যু, মঞ্চে প্রবেশ ও
প্রস্থান। যেভাবে একটা চরিত্র বোনেন ঔপন্যাসিক, লেয়ারের পর
লেয়ার, শেডের পর শেড বুনে একটা স্পাইরাল; আমাদের জীবন যেন সেইরকম। মজা হলো, কে ভাবে এই ভিতর
বাড়ির কথা? কজন ভাবে? উল্টে আমরা
সারাজীবন 'আমার, আমার আমার; আমি, আমি, আমি..." এই
ডিলেমাতেই থেকে যাই। ফলে খাঁচা ছেড়ে আর বেরোনো হয় না। ওই গারদের মধ্যেই constrained
ওড়াউড়ি, পরাধীনতাকে স্বাধীনতার লাড্ডু ভেবে
চর্বণ ও গলধঃকরণ। মনে পড়ে এই গান: “You can check-out any time you like
but you can never leave!" ফলত আমাদের জীবনচক্র যেন কোনো এক
অদৃশ্য সুতোর টানে নাচতে থাকা পুতুলনাচ। ‘আমি যন্ত্র তুমি
যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী, আমি রথ
তুমি রথী, যেমন চালাও তেমনি চলি। তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে
বলে করি আমি।’ রামপ্রসাদ কিন্তু বুঝেছিলেন, ভক্তিমার্গে।
এইখানে একটা তক্ক উঠতে
পারে এই বলে যে: ‘আমাদের তো নিজস্ব ইচ্ছে আছে। free
will. আমরা স্বেচ্ছাধীন। পরাধীন নই'। তাই কি? এই সমস্যার মীমাংসা দুভাবে হতে পারে। প্রথম সমাধান প্রথম
পরিচ্ছেদে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় সমাধানে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করা যাক নিজেকেই,
'নিজস্ব ইচ্ছে কী?' নিজস্ব ইচ্ছে হলো তাই যা
আমাদের নিজত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে দুবার ভাববে না। নিজের comfort
zone, basic drive-কে খাদের কিনারে ঠেলে দেবে এটা যাচাই করার জন্য,
যা নিজের ইচ্ছে বলে ভাবছি, আদৌ তা নিজেরই তো
নাকি সেই অনাদিকালের অ্যালগোরিদিমের প্রচ্ছায়া! দ্বিতীয়ত, ইচ্ছানুযায়ী
কর্ম এবং কর্মানুপাতিক ফলাফল আমরা পরিবর্তন করতে পারবো। কিন্তু কোনটাই পারি কি?
সম্ভব হয় না, সম্ভাবনার তত্ত্ব চলে আসে। আমাদের
জীবনের প্রত্যেক ভাবনার, কাজের, অসীম
সংখ্যক ফলাফল হতে পারে। লক্ষ-কোটি আলাদা আলাদা সম্ভাবনার বীজ। আমরা যেটাকে
স্বেচ্ছা বলে মনে করছি, সেটা আসলে ওই অসীম সংখ্যক সম্ভাবনার
মধ্যে থেকে কোনো একটি; যা আমরা বেছে নিই, আমাদের অ্যালগোরিদিম অনুসরণ করে। যদি ফ্রি উইলই হতো, তাহলে তো চট করে নেমে পড়া যেত যেকোনো স্টেশনে। যেকোনো সময়ে। তার জন্য
আলাদা করে কোনো অনুঘটকের প্রয়োজন হতো না।
জীবনানন্দ দাশের আট বছর
আগের একদিন কবিতায় আমরা পাই এই আকাঙ্ক্ষিত এবং অনাস্বাদিত মুক্তির কিছু কিছু
ভাবনা! একটা তীব্র আকাঙ্খা; নিজ পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে বেরোনোর
আকুপাকু আকুতি। যে বুঝেছে এই নিজস্ব কারাগারের দমবন্ধ পরিস্থিতি, সে তো চাইবেই গারদ ভেঙে উড়ে পালাতে।
“...বধূ শুয়ে ছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
...
‘...জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম—অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
...
জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের
ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত- ক্লান্ত করে;
...”
তাহলে কি আমরা নিতান্তই
পরাধীন? পরান্নভোজী, দাসস্য
দাস? প্রকৃত প্রস্তাবে, হ্যাঁ। কিন্তু
মন মানে না। ‘আমি’ বলে, 'আমি আমার নিজের ইচ্ছের মালিক'। কিন্তু দেখা
যাচ্ছে যে আদপে বস্তুটি তাই নয়। স্বাধীনতা ও বাস্তব, পরাধীনতা ও কল্পনা এই দুই জোড়া ধাঁধা যেন পরস্পর সম্পৃক্ত এক প্যারাডক্স।
বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক মরমিয়া নিজের নিজের মতো করে এর সমাধানের চেষ্টা করেছে সময়ে
সময়ে। ভারতীয় আধ্যাত্ম্যবাদ বলে, আত্মমুক্তি তো গভীর জলের
কালবোস। জলের মধ্যে জল, হাওয়ায় হাওয়া, পাতায়
পাতা, তোমাতে তুমি হয়ে তিনি গোপন আছেন। এই স্বখাত সলিল
বৈতরণী না পেরোলে স্বাধীনতা আর মিললো না এই জনমে। আচার্য শঙ্কর এই আদি সমস্যা,
‘আমি কে?’-এর সমাধানে বলবেন, ‘ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা’। বিবেকানন্দ ‘স্বামী-শিষ্য সংবাদে বলবেন, ঘট ঘট ভাবতে ভাবতে ঘটের আবির্ভাব। মনের মানুষ বলো আর আত্মারামই বলো বা
মহামায়াই বলো, তিনিই তো সেই চালিকাশক্তি। তাঁর নাগাল না পেলে
নিজেকে অতিক্রম করবে কেমনে? অপরদিকে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম
মেকানিক্স ও তৎসহ রিয়েলিটির প্রকৃতি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করবেন, “Is the moon
there when nobody looks?” Bernard d'Espagnat বলবেন, "The
doctrine that the world is made up of objects whose existence is independent of
human consciousness turns out to be in conflict with quantum mechanics and with
facts established by experiment." Werner Heisenberg-এর মতে,
"The atoms or elementary particles themselves are not real; they form a
world of potentialities or possibilities rather than one of things or
facts." রবীন্দ্রনাথ লিখবেন,
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।”
তাই মনে হয়, স্বাধীন হতে হলে আগে নিজস্ব পরাধীনতার বন্ধনকে ছিন্ন করার
মন্ত্রগুপ্তি শিখতে হবে। বাস্তব ও কল্পনার এই প্যারাডক্সের রহস্যজাল ভেদ করতে হবে।
কল্পনার তেমন জোর থাকলে তা বাস্তব হয় বৈকি! আমরা তখনই স্বাধীন যখন সেই স্বাধীনতা
কারোর এবং কোনোকিছুর ওপরই নির্ভরশীল নয়।
অবশ্য, আমি এতশত তো বুঝিনা বাপু। স্কুলে যাওয়ার পথে, বাসের জানালা থেকে দেখতে পাই, বিশাল এক তিনতলা বাড়ি।
প্রায় দেড় মানুষ উঁচু পাঁচিল ঘেরা। তার দোতলায় বসে থাকেন এক বৃদ্ধ। একা, স্থবির। ধূসর চুল ও ঘোলাটে চোখে। পাঁচিলের গায়ে বড় বড় অক্ষরে খোদাই বাড়ির
নাম, "মুক্ত বিহঙ্গ"। আমরা বোধহয় এমনই।
No comments:
Post a Comment