Saturday, August 11, 2018

স্বাধীনতা এখন রুপোর কনক-হার : প্রসূন মজুমদার







 রবীন্দ্রনাথের একটা গান কয়েকদিন ধরে আমার মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে।কাজে, অকাজে,এমনকি ঘুমের মধ্যেও এই বহুশ্রুত গানটা মাথায় বেজে উঠছে। আমি ধীরে ধীরে যতই গানের কথায় আর সুরে বাঁধা পড়ে যাচ্ছি, গানটা ততই বলে উঠছে ' হারে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দে রে দে রে।' গানটায় ছেড়ে দেওয়ার আকুতি আছে। ছেড়ে দিতে বলছে মানে আমি ভাবছি যে নিশ্চয় কেউ তাকে ধরে রেখেছে। মানে সে বন্দী। এখন কথাটা হল যে,কে বন্দী?  কেউ নিশ্চয়ই বলবে কবি বন্দী, আবার কেউ এক ধাপ এগিয়ে শঙখবাবুর মতো বলবে এখানে 'আমি' শব্দটা বড় আমিকে বলতে চাইছে।এই 'বড় আমি '- ই আসলে আমরা। আমরা বন্দী।আমাদের আকুতিই এই গানে কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু আমি আরও একটু ভাবছি।আমি ভাবছি যে,কবি শব্দটার সংজ্ঞা কী?কবির আভিধানিক সংজ্ঞা আর গ্রিক দার্শনিকদের আদি কবিভাবনা দেখা যাবে একইরকম। সেখানে কবি অর্থে সর্বজ্ঞ,ক্রান্তদর্শী।  আর কবিতা ব্যাপারটা কবি - লিখিত একথা মোটেই আমাদের দর্শনবিদ্যার চিন্তাবিদেরা মনে করেন না।এমনকি রবীন্দ্রনাথ নিজেও মনে করতেন না। কবিতাকে তিনি বৈদিক ঋষিদের মতই 'অপৌরুষেয়' মনে করতেন। অপৌরুষেয়। অর্থাৎ কবিতা কোনো মনুষ্যরচিত টেক্সট না। কবিতা বরং কবির কাছে দৈববাণীর মতো নেমে আসে। একথার বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য না। এই লেখায় আমি বরং ভাবছি যে কবিতাকে যদি দৈবী প্রেরণায় লিখিত বলে মনে করি তবে কয়েকদিন ধরে মাথার মধ্যে বাজতে থাকা এই গীতিকবিতাটি যে ছেড়ে দিতে বলছে তার মূলে নিশ্চয়ই বক্তার বাঁধা পড়ে থাকার একটা ব্যাপার কাজ করে চলেছে।এখন বক্তা যদি অপৌরেষেয় হয় তাহলে এই গানে বোঝা যাচ্ছে যে ক্রান্তদর্শী, সর্বজ্ঞ দৈবী শক্তিও কোথাও পরাধীন, আর তার আকুতি স্বাধীন হবার। এবার আমি ভাবছি যে এমন তো একটা কথা আমরা সকলেই জানি যে,'পঞ্চভূতের ফাঁদে ' ঈশ্বর বাঁধা পড়ে কাঁদেন।তাহলে ধর্মদর্শন অনুসারে যে ঈশ্বর আমাদের মুক্তির পথ দেখান  তিনি নিজেই বাঁধা পড়ে আছেন।এইরকম একটা বোধের সামনে এসে দাঁড়ালে এটাই কি মনে হয় না যে,'মুক্তি ওরে মুক্তি কোথায় পাবি...'?

   এইসব ভাবনা যখন মনটাকে কুরে খাচ্ছে তখন কাছেপিঠে ১৫ই অগাস্টের গন্ধ। ভারতবর্ষ নামের যে দেশটায় আমি বাস করি সেই দেশের স্বাধীনতা দিবস।রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিবসের এই আদেখলেমো এই সময় খুব একটা কাজ করে না।এই সময় মানে যখন ভাবতে থাকি আপনি প্রভু সবার কাছে বাঁধা পড়েছেন বলতে রবি ঠাকুর যেই অনুপম পরাধীনতার ইঙ্গিত করেছেন সেই ভাবনা। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যাপারটাও ভাবলে বেশ মজা লাগে।ইংরেজ তার কলোনিয়াল কালচারের সমস্ত দূষিত আবর্জনা ঢেলে দিয়ে ১৫ই অগাস্ট, ১৯৪৭-এ ভারতকে স্বাধীন দেশের মর্যাদা দিল। সেই আনন্দে আমাদের লাফালাফি।এখন ব্যাপার হচ্ছে যে ইংরেজ আসার আগে ভারত কি স্বাধীন ছিল?  তারও আগে প্রশ্ন আসে যে ইংরেজ আসার আগে ভারত কি ভারত ছিল?এই ভারত নামের যে দেশটার কথা বলা হচ্ছে তার ঐতিহাসিক ফর্মটা ঠিক কী? ভারত তো ইংরেজ আসার আগে বেশ কয়েকটা অঙ্গরাজ্যে ভেঙে ছিল।  এখন ইংরেজ ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোকে একই বিধির আওতায় এনে এক দেশে পরিণত করলো।আমার ভাবনার সমস্যাটা হল এই যে, আমার ভিতরে দেশ ব্যাপারটা খুব একটা কাজ করে না। তামিলভাষী বা হিন্দিভাষী কোনো মানুষের থেকে আমি অনেক বেশি আত্মীয়তা - বোধ করি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে।বাংলাদেশ বলতে আমার নিজের দেশই মনে হয়।বাংলাদেশের কথা মনে পড়তেই মনে এল যে কয়েকদিন আগে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধর উপরে হুমায়ুন আহমেদের বানানো দুটো টিভি -নাটক দেখতে দেখতে আমার মন ভরে গিয়েছিল।তাদের মধ্যে একটা নাটকে দেখানো হচ্ছে যে মুক্তিযুদ্ধ - এর সময় একটা নৌকোয় একদল মানুষ তাদের সন্তান,ভিটেমাটি হারিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারির হাত থেকে বাঁচার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকৃত মুক্তাঞ্চলে পৌঁছানোর আশায়।পথে রাজাকার,মিলিটারিদের ভয়াবহ আক্রমণ পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকে মুক্তিযুদ্ধ -এ অংশ নিয়ে তারা পেয়ে গেল মুক্তাঞ্চলে পৌঁছানোর পথ।সেখানে স্বাধীনতার স্বাদ বোঝাতে ডিরেক্টর শেষদৃশ্যে স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ার দৃশ্য তৈরি করেছেন।এ স্বাধীনতাও রাজনৈতিক স্বাধীনতা,সে অসহায় দেশবাসীকে শান্তির নীড়ের স্বপ্ন দেখায়। আবার আর একটি টেলিফিল্মে হুমায়ুন আহমেদ যে স্বাধীনতার ইশারায় নিয়ে গিয়ে ছবিটি শেষ করেন সেটি স্বাধীনতার একটি পরিপূর্ণ আইডিয়া হয়ে ওঠে। কারণ সেখানে শেষদৃশ্যে মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অপেক্ষা করতে থাকে সকালের। সকাল এলে শহরে কার্ফু উঠবে। ডাক্তার নিয়ে আসা সম্ভব হবে। অনেক উৎকণ্ঠার মুহূর্ত পেরিয়ে ঈপ্সিত সকাল আসে। মুক্তিযোদ্ধার প্রায় মৃত শরীরকে জাগিয়ে তোলে তার প্রেমিকার আকুতি।সে আলোয় হাত পেতে দেয়। ওই যে আলো,ওই আলোই হয়ে ওঠে স্বাধীনতার প্রতিবিম্ব। প্রথম টেলি-নাটকের থেকে দ্বিতীয়টাই আমাকে বেশি ভাবাতে থাকে।ভাবতে ভাবতে যাই।এই যে  মুক্তিযুদ্ধ, এ তো আমার নয়। কিন্তু এই স্বাধীনতার কথা আমারই হয়ে ওঠে যেন। এমনকি ভারতের স্বাধীনতার থেকেও অনেক বেশি আমার।এই কথা শুনলে অনেক উগ্র ভারতপ্রেমী নিশ্চয় আমাকে বাংলাদেশে রেখে আসার পরামর্শ দেবে।আমার তাতে কিছুই হবে না। কারণ ওই যে বললাম দেশ ব্যাপারটাকে কয়েক ইঞ্চি জমি দিয়ে মেপে ফেলার অভ্যেসটা আমার নয়। আমি বরং দেশ বলে ভাবতে ভালোবাসি একটা গোটা পৃথিবীকে। এই ক্ষেত্রে জন লেননের সেই গানটার মতোই আমার বলতে ইচ্ছে করে ' Imagine there is no nation '।  আমার এই জমি মেপে আর ধর্ম মেপে দেশমুক্তির পরিকল্পনাটাকেই অপ্রয়োজনীয় আর ভ্রান্তনীতি বলে মনে হয়। মিশেল ফুকোসহ একগাদা দার্শনিক বিভিন্ন সময় বলেছেন যে আসলে আমাদের সংস্কৃতিকে গড়ে তোলে আমাদের ভাষা।  ভাষাগতভাবে পৃথক রাজ্যগুলো নিয়ে একটা দেশ গড়ার পরিকল্পনাই আমাদের আত্মিক পরাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা দিল। অথচ আমরা স্বাধীনতার আনন্দে উদবেল হয়ে থাকলাম শুধু অকারণ পুলকে!

    এখন যে প্রশ্নটা মনে আসে সেটা হল ভাষাগতভাবে সমান হলেই কি আমরা আসল স্বাধীনতা পেতাম?
অবশ্যই না।তা যদি হত তাহলে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মানুষ অনেক বেশি স্বাধীন হত। কিন্তু হয়েছে উলটো।ইউসুফ মালালাকে বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে তার পড়াশোনার স্বাধীনতা দাবি করতে হয়েছে।একটা জাতি স্বাধীনতা-বোধকে কত নির্মমভাবে খুন করলে তালিবানদের জন্ম হতে পারে তা আমরা সহজেই বুঝবো।

   তাহলে? স্বাধীনতা বলে অনুভূতিটা, অত্যন্ত জরুরি অনুভূতিটা আদৌ কি আমরা পাই? তার থেকেও বড় প্রশ্ন স্বাধীনতা ব্যাপারটা আমরা চাই কি আদৌ?এই বারেই কেউ মনে করিয়ে দেবে 'স্বাধীনতা -হীনতায় কে বাঁচিতে চায়? ' আমি এই ভাবনা নিয়ে নিশ্চিত নই। আমার মনে হয় যে স্বাধীনতা - হীনতায় যে কেউ বাঁচতে চায় না,ব্যাপারটা এরকম নয় বরং বেশিরভাগ মানুষই প্রাণভরে স্বাধীনতা চায় না। এই ভাবনাটা আমি এইজন্যেই ভাবছি যে স্বাধীনতা বা সার্বিক স্বাধীনতা বলতে আমরা একটা দেশের স্বাধীনতা দিবসের ধ্বজা তোলাকেই যদি বুঝে নিই তবে সেই ভাবনা ঠিক হবে না। স্বাধীনতা প্রকৃতই একজন ব্যক্তিমানুষের আয়ত্ত্বাধীন হবে তখনই যখন তার নিজের শরীর, নিজের মন নিজইচ্ছায় সে চালাতে সক্ষম হবে। এই নিজেকে সম্পূর্ণ  নিজের ইচ্ছায় চালাতে হলে তার যেসব অঞ্চলে স্বাধীনতার দরকার, সেই দরকারের কতটুকু আমরা পাই,এবং আমরা চাই চলুন সেটা আমরা দেখতে দেখতে যাই ---

১) আমরা চাই দেশ স্বাধীনভাবে চলুক।এই স্বাধীনভাবে চলা বলতে আমরা বুঝি যে অন্যদেশ যেন আমাদের না চালাতে পারে।কিন্তু এই ভাবনার গোড়ায় গলদ। অন্যদেশ আমাদের চালাচ্ছে না এটা হওয়া অসম্ভব -প্রায়। আমাদের মতো যে দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে তারা যদি নিজের মতো চলতে চায় তবে তাদের প্রথম অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ম্ভর হতে হয়।সেই স্বয়ম্ভরতা তখনই সম্ভব যখন আমরা নিজেদের খাবার নিজেরা উৎপাদন করতে  পারব,নিজেদের বাড়ি,নিজেদের পোষাক যথেষ্ট পরিমাণে নিজে বানাতে পারব;  কিন্তু সে কি আমরা পারি? পারি না তার কারণ কি এটাই নয় যে আমরা চাই না? বরংউলটে আমরা চাই ম্যাকডোনাল্ডস,
আমরা চাই মল-সংস্কৃতি,আমরা আম চাষ কমিয়ে ফেলি, অথচ বন্ধুকে খুব গর্ব করে বলি মল থেকে কিনে এনেছি কিউই কিম্বা অস্ট্রেলিয়ান গ্রেপ। কিনলাম তাতে ক্ষতি বড় একটা নেই। সে তো সব খাবারই চেখে দেখতে স্বাদ হয়। কিন্তু ব্যাপারটা যদি চেখে দেখার ওপরে বিলাসিতায় চলে যায় তখন সেই বিলাসিতার জন্যে ট্যাক্স দিতে হয়।অন্যদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়।  স্বাধীনতা খর্ব হয়।স্বাধীনতা- সুখের ভিতরে যে আত্মত্যাগ, যে বেদনা,সে কি আমরা বহন করতে প্রস্তুত?মনে হয় না।অন্তত আমাদের চাল-চলন দেখে তা মনে হয় না।

২) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলে যে ব্যাপারটা সেটা আমরা কতটা বুঝি বা বোঝার চেষ্টা করি?আমরা মানে গোটা মানুষ জাতিটাই জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়ে দিই খাবারের খোঁজ করে।এই খাবারের জন্য আমাদের শ্রমদানের বেশিরভাগটা আবার চাকরি করা অর্থাৎ চাকরবৃত্তি করা।যে চাকর, তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোথায়? সুতরাং মনে মনে  সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রতিদিনই হয়তো বসকে আমরা বলি,'তুমি ছেঁড়, আমি চলি';কিন্তু কাজে সেটা করতে পারি কি? পারি না,কারণ আমাদের খাবার বড় বালাই। সুতরাং ভুখা পেটের কাছে আমরা চিরকাল বন্দী। কয়েকদিন আগে একটা নিউজ -পোর্টালে হাওয়া-বাবার খবর পড়লাম।সে নাকি শুধু হাওয়া খেয়ে বছরের পর বছর বেঁচে আছে।জানি না মানুষের সবার এই ক্ষমতা কবে আসবে।তবে যতদিন না আসে ততদিন তার পরাধীনতা ঠেকায় কার সাধ্য!

৩) রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার থেকেও যেটা অনেক বড় সঙ্কট সেটা হল ব্যক্তি - স্বাধীনতার সংকট। ইংরেজ নামক প্রভুর কাছ থেকে পরিত্রাণ লাভের পরে ভারত দেশটা তার সংবিধান চালু করে বসল।সংবিধান মানে সাধারণ নিয়ম।অর্থাৎ এইদেশে যারা থাকবে, তাদের এইসব নিয়ম মানতে হবে।রাষ্ট্র - ব্যবস্থার খেলাটাই এই যে,নিয়মে বেঁধে একদল মানুষকে এক চ্যানেলে চালানোর পরিকল্পনা করা। এই পরিকল্পনায় যে মানুষ আর মানুষ থাকে না, বরং কয়েদিদের মতো কতকগুলো সংখ্যায় পরিণত হয়, সেটা রবীন্দ্রনাথ তো কবেই সেই রক্তকরবীতে বলে বসে আছেন।লাভ কিছু হয় নি।লাভ কিছু হবে বলে মনেও হয় না। কারণ রাষ্ট্র  খুব পরিকল্পিতভাবে আমাদের একেবারে ভিতরে বসে থাকে গোপন এঁটুলির মতো। রাষ্ট্র তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের বটম--আপ নিয়ম।একেবারে ভিতে সে বসিয়ে রাখে পরিবার নামের প্রতিষ্ঠানকে। পিতৃতান্ত্রিক নিয়মে পরিবার প্রথায় শাসকের আসনে বসে থাকে বাবা। রাষ্ট্র ঠারেঠোরে এই কথাটাই ব্যক্তিমানুষের মগজে পুরে দেয় 'পিতা ধর্ম, পিতা স্বর্গ...'- এর অমোঘ বাণী ছড়িয়ে।ফলে পিতৃনির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা পড়ে ব্যক্তি-মানুষ তার নিজস্ব উচ্চারণ করতেই শেখে না। এরপর ব্যক্তিকে নিয়ে গিয়ে ফেলা হয় বিদ্যালয় নামের একটা মগজ-ধোলাই যন্ত্রর ভিতর। সেখানে রাষ্ট্র তার সুবিধামতো ভাবনাগুলোকে পুরে দেয় মাথার কোষে। মাথা খাটালেই ঝামেলা।আমরাও ঝামেলামুক্ত একটা জীবন কাটাতে বড় পছন্দ করি।বেশিরভাগ লোক জানতেই পারি না যে আসলে সে কি চায়।জানলে সত্যিই বেজায় মুশকিল। তাই মানুষ,  'জানিবার বেদনার ভার সহিবে না'। সে গতানুগতিক - এর বাইরে পা ফেলবে না।কারণ সে দেখেছে নতুন পথে পা ফেলা মানুষরা কিভাবে রাষ্ট্র,সমাজ,পরিবারের দ্বারা মানসিকভাবে সর্বক্ষণ ধ্বর্ষিত হয়ে চলে। তার কী দায় পড়েছে নিজের মতো করে বাঁচার? নতুন পথ খোঁজার?  তাই ভাবনাকে খোজা করে দিব্য-আহ্লাদে সে গোবর-গণেশের মতো দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই সুখী। তাই আম-জনতার কাছে ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিষয়টা সোনার পাথর - বাটি বই কিছুই না। তুমি যদি তার মতো করে দু'পাও না এগোও, তবে তার গাত্রদাহ হবে।তোমাকে সে খাঁচায় পোরার জন্যে হাঁচড়-পাঁচড় করে উঠবে, কারণ রাষ্ট্র তাকে শিখিয়েছে, নিজস্ব চিন্তায় নিজের পথ চলা মানুষকে সন্দেহ করতে,ম্যালাইন করতে।  তাই ফেসবুক মানচিত্রে একটু চোখ বোলালেই দেখা যাবে এমনকি কবি নামধারী অসংখ্য অক্ষর-কারিগর যাদের কবি হয়ে ওঠার প্রথম ক্রাইটেরিয়া ছিল সমাজকে প্রশ্নের চোখে দেখে নতুন ও নিজস্ব ভাবনাবিশ্বের জন্ম দেওয়ার,সেই কবিনামধারী অসংখ্য ভণ্ড বা মূর্খ,  সমাজ,জাতি,দেশ এইসবের কথা বলে রাষ্ট্রনির্মিত ন্যায়,নীতি,এথিক্সের সহজপাঠ খুলে বসেছে।হাততালি পাচ্ছে।কারণ রাষ্ট্র তো এটাই চায়। একটা ভ্রান্ত ভাবনাচক্রে জড়িয়ে ফেলে রাষ্ট্র তার শাসিত প্রজাদের মেধাগতভাবে পঙ্গু এবং পরাধীন করে রাখতে চায়।তাই চিন্তাবিদদের রাষ্ট্র ভয় করে।ছাঁচের বাইরের চিন্তাকে বলপ্রয়োগে বন্ধ্যা করে দিতে চায়। জনসাধারণ স্বাধীন চিন্তা করতে তো পারেই না,সম্ভবত চায়ও না। যেখানে ব্যক্তির নিজস্ব ভাবনার পথ রুদ্ধ সেখানে স্বাধীনতার দুন্দুভি বাজিয়ে মধুর মিথ্যা আওয়াজ ছড়ানো ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে।

  এখন কথা হল এই ব্যক্তিস্বাধীনতা- বোধের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে ছয়টা খল, তারা কিন্তু রাষ্ট্র না। রাষ্ট্র তাদের ব্যবহার করে মাত্র।এই খলষষ্ঠককে আমরা অনেকেই চিনি।এরা হল মানুষের ছয় আদিম রিপু।যতদিন লোকেরা এই ছয় রিপুর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না ততদিন তাদের পরাধীনতা থেকে নিস্তার নেই। তারা ততদিন নিজের অজান্তে নিজেরই ভাবজগতের কাছে পরাধীন থাকতে বাধ্য।মানুষ যতদিন পরাধীন, প্রকৃতিও অর্থাৎ মানুষের স্রষ্টাও পঞ্চভূতের ফাঁদে পড়ে কাঁদতে বাধ্য হবে। শুধু তেরঙা ঝাণ্ডা তুলে আর অপ্রাসঙ্গিক কিছু লেকচার ঝেড়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে নেমে এসে ঠাণ্ডা শিঙাড়ার অম্বুলে ঢেঁকুরে একটার পর একটা ১৫-ই অগাস্ট কাটিয়ে, শেষে সেই, হাতে পেন্সিলটুকুই পড়ে থাকবে।

   তবে হতাশা শব্দের মধ্যেই যেহেতু আশা শব্দটা আছে, তাই 'মানবের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায় ' টাইপ কিছু বাণীপ্রায় ভাবনা আমাদের টিঁকিয়ে রাখতে হয়তো পারবে;সেই হুমায়ুন আহমেদের 'আগুনের পরশমণি ' ফিল্মের মৃতপ্রায় মুক্তিযোদ্ধার ভোরের আলো ছুঁয়ে দেখার দৃশ্যকল্পের বাস্তবতার স্বপ্ন হয়তো ছেকড়াগাড়ির মতো আমাদের কয়েকজনকে নতুন পথ খুঁজতে উৎসাহিত করবে। নকল ভণ্ড জীবনের করাত সহ্য করতে করতে একদিন সার্বিক স্বাধীনতা পাব, এই খোয়াব বুকে নিয়ে বাঁচার সাহস জাগিয়ে  রাখার জ্বালানিতে আলতো ফুঁ দেওয়ার কাজটা করে যেতে হবে।এছাড়া অন্য পথ নেই।

                                      

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...