Monday, August 13, 2018

আমার ভারত তোমার ইন্ডিয়া : বিকাশ গায়েন






আমাদের মত যাদের জন্ম ঊনিশ শ সাতচল্লিশের এক দশকেরও বেশী সময় পর ,তারও এক দশক পর শুরু জানতে বুঝতে শেখা তাদের কাছে দেশের স্বাধীনতার আস্বাদ হোল বেশীরভাগটাই তো  লোককথা আর ইতিহাস বই এর নির্যাস । সেই লোককথার মধ্যেও তো মিশে থাকে অনেক অতিকথন ,বিভিন্ন ব্যাখ্যা ।
            লিখিত ইতিহাসেরও তো নানান স্তর ,বহু পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা ।প্রথাগত বিদ্যাচর্চার প্রাঙ্গনে পঠিত ইতিহাসের জ্ঞান যখন অতিরিক্ত পাঠের পরিসরে এসে অন্য রকম তথ্যের মুখোমুখি হয় তখনই বিভ্রান্তি বাড়ে ।যত দিন যাচ্ছে এই বিভ্রান্তি তো বেড়েই চলেছে ।বর্তমান প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার আবেদন যতটা না অনুভূতিগ্রাহ্য তার চাইতে অনেক অনেক বেশী চিন্তাগ্রাহ্য একটি বিষয় ।ফলে তাদের কাছে আজ স্বাধীনতা দিবস মানে অন্যান্য উৎসবের মত নিছকই একটি উৎসব ।স্কুল ,কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে,সরকারি -বেসরকারি  প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হবে ,বিউগলের তালে স্যালুট এর জন্য হাত কপালে উঠবে ,সকাল থেকে বেতারে দূরদর্শনে দেশাত্মবোধক গান এবং সিনেমা সম্প্রচারিত হবে ।পথে পথে ফেরিওয়ালাকে ঝাঁকায় করে তার দিয়ে তৈরী সুদৃশ্য চাকা সমন্বিত কাগজের তেরঙা ফেরি করতে দেখা যাবে । এর বেশী সত্যিই কি কিছু হয় ? আনুষ্ঠানিকতার অতিরিক্ত আদৌ কি কিছু ঘটে?
            বৃহত্তর সাধারণ মানুষের অনুভূতিদেশে  আদৌ কি আলো ছড়াতে পারে আমাদের এই চিন্তাগ্রাহ্য স্বাধীনতা?  চোখের সামনে দুর্নীতিগ্রস্ত,কুসংস্কারগ্রস্ত ,স্বার্থান্ধ একজন মানুষ কেবলমাত্র বাহুবল প্রয়োগে পঞ্চায়েতপ্রধান , সভাধিপতি ,পুরপিতা ,বিধায়ক ,সাংসদ হবার সুবাদে পতাকা উত্তোলনের মত পবিত্র কাজটি অবলিলায় সম্পন্ন করে যখন  সাত বাসি কথার পুনরাবৃত্তি করে মঞ্চ থেকে নেমে যান আর সামনে দাঁড়ানো বা ঘিরে থাকা প্রসাদভিক্ষুকদের প্রশংসা বর্ষণে সিক্ত হতে হতে আত্মশ্লাঘা বোধ করেন তখন স্বাধীনতা দিবসের অর্থ কারো কারো কাছে জমিদারের কাছারি দর্শন মনে হতেই তো পারে ।
           স্বাধীনতা শব্দটির বিস্তার অসীম ।তার আগে আসে দেশ এবং রাষ্ট্র ।ব্যক্তির স্বাধীনতা বরাবর খর্বিত হয় রাষ্ট্রের দ্বারা ।রাষ্ট্র তো রাষ্ট্রই ।নাগরিকের কাছে তাকে দেশ হয়ে উঠতে হয় ।দেশ এর ধারনা ব্যক্তির আবেগ ও অনুভূতি সঞ্জাত ।রাষ্ট্রের ধারনা চিন্তাপ্রসূত বলা ভাল কষ্ট কল্পিত । ব্যক্তির আবেগের কাছে তার দেশ সময়ান্তরে  বদলে বদলে যায় । ছুটিছাটাতে সুদূর কর্মস্থল থেকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার মধ্যে যে দেশ এর অনুভূতি কাজ করে সেখানে বহুভাষিক বহুজাতির বহুধর্মের সমন্বিত ভারতবর্ষ থাকেনা ।এটা হল ব্যক্তির অনুভূতির হিরন্ময় স্মৃতি জড়িত ছোট দেশ ।এই দেশ এর পরিধি অঞ্চল মহকুমা জেলা রাজ্য সাপেক্ষে বাড়ে কমে ।সেখানে বস্তুগত চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের তারতম্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনা । সমস্যা তৈরী হয় যখন তার উপর রাষ্ট্রের সীলমোহর পড়ে ।
             একটি নির্দিষ্ট ভূমিখন্ডে জন্মগ্রহন মাত্রই পদবি ভাষা ধর্ম জাতির নানা শৃঙ্খলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ে মানুষ ।এই অধীনতায় নিজের অজান্তেই তাকে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হয় । সেটাকেই তখন সে দেহের ত্বকের মত অপরিহার্য মনে করতে থাকে ।এটিকে পোশাকের মত ছেড়ে ফেলার সচেতন আয়োজনের জন্য যে প্রস্তুতি বা বাইরের উৎসাহ দরকার তার সুযোগ অনেকসময় ঘটেনা বা ঘটলেও অবহেলিত হয় ।এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাষ্ট্র নামক  আরও একটি বিমূর্ত পরিচয় ।
               সদাসদাঞ্চরণশীল মানুষ বিবর্তনের শুরু থেকেই  বাঁচার প্রয়োজনে এক স্থান থেকে অপর স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে । বাসা বানিয়ে এক প্রজন্ম বা কয়েক প্রজন্ম ধরে কোন অঞ্চলে বসবাস করেছে । পারস্পরিক ভাষা সংস্কৃতি আচার আদানপ্রদানের মাধ্যমে নিজেদের একটি সাংস্কৃতিক পরিসর তৈরী করে বা একটি পরিসরের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে ।এভাবেই গড়ে ওঠে তার অনুভূতির দেশ ।পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে যদি দেখে তার খেলার মাঠ ,গোয়ালঘর ,রান্নাঘর খড়ির গন্ডি টেনে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে তখন তার দেশের অনুভূতি ক্ষতবিক্ষত হয় ।অথচ ইতিহাসে দেখা যায়  বারবার রাষ্ট্রশক্তি সেই কাজটাই করে । আর রাষ্ট্র যে আধিপত্যবাদী শক্তিরই প্রকাশ এটা তো বর্তমানে কারও অজানা থাকার কথা নয় ।রাজনৈতিক স্বাধীনতা সেখানে ক্ষমতার হাত বদলের  অভিজ্ঞান মাত্র।               স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনা এবং তার স্বর্ণোজ্জ্বল গরিমা নিয়ে আজও অবশিষ্ট যে আবেগ---খোলা চোখে দেখলে বোঝা যায় তার সিংহভাগই রয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত উচ্চ মধ্যবিত্তদের মনে ।সেটিকে প্রসাশনিক স্বার্থে প্রশাসনিক ভাবে আড়ম্বরের সঙ্গে উপস্থাপিত করা হয় সার্বভৌমত্ব এবং বৈচিত্রের মধ্যে একতার উচ্চনিনাদি প্রদর্শনের প্রতীক হিসেব । কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বহু বিচিত্র গোষ্ঠী ভাষা জাতি বর্ণ ধর্মে আবদ্ধ যে বিশাল জনগোষ্ঠী এবং জলবায়ু ভূমিরূপের বিভিন্নতা নিয়ে অবস্থিত বিপুলকায় ভৌগলিক ক্ষেত্র এখানে জাতীয়তার সদর্থক ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে তা কি কেবলই সংবিধানে লিখিত ঘোষনার দ্বারা সম্ভব! বিশাল দেশের  বিপুলসংখ্যক নাগরিকদের মনে  জাতীয়তাবাদি
চেতনা সৃষ্টি করতে গেলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রাপ্তব্য অধিকার যথার্থ নিরপেক্ষভাবে  প্রতিটি নাগরিকের  মধ্যে বন্টিত হওয়ার বাস্তবায়নের মধ্যেই সম্ভব । স্বাধীনতালাভের এত গুলো বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরও আজো যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতার উদগ্র প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে এর মূলেই তো হল বঞ্চনার অনুভূতি ।এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর তুলনায় নিজেকে বঞ্চিত মনে ককরছেবঞ্চনার অনুভূতি থেকে হতাশা ।হতাশাই জন্ম দেয় বিদ্রোহের ।
           গণতন্ত্র রক্ষায় বহুদলীয় ব্যবস্থার সুফল যেমন আছে ,কুফলও রয়েছে ।নীতি নির্ভর রাজনীতির জায়গা নিচ্ছে পাইয়ে দেবার রাজনীতি ।সেখান থেকে জন্ম নেয় সুবিধাবাদ ।ক্ষমতায় আসার আগের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত বদলে যাচ্ছে ।সরকার আসে যায় নতুন সরকার তৈরী হয় কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে থেকে যায় । কেউ বিদ্রোহী হয়ে উঠলে হয় তাকে যেনতেন প্রকারে  তাকে দমন কর নতুবা তাকে বড় কোন টোপ দিয়ে চলতি ব্যবস্থার অঙ্গীভূত করে নাও ।সাপও মরলনা ,লাঠিও ভাঙলনা পদ্ধতিটরই চলতি বেশি। বিষফোঁড়া থেকে শরীরের রেহাই নেই ।একজায়গায় বসছে তো পরক্ষণে অন্য জায়গায় উঠছে ।
                ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ ,ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ ভাগ হল তবু ভাগের আকাঙ্খা মেটানো গেলনা ।জাতপাতের রাজনীতি ,ধর্মের রাজনীতি মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে । সম্প্রতি যোগ হয়েছে হিন্দুত্বের ধুয়ো তুলে নির্দিষ্ট কয়েকটি পালিত আচরন ও খাদ্যাভাসের নিরিখে হিন্দুত্ব চিহ্ণিত করণের কূট প্রয়াস ।সাধারণ মানুষের কষ্টোপার্জিত অর্থ লূন্ঠিত হচ্ছে ,জল জমি জঙ্গলের উপর পুরুষানুক্রমিক অধিকার মুহর্তে খর্বিত হচ্ছে । মুষ্টিমেয়র হাতে  কেন্দ্রীভূত হচ্ছে দেশের বিপুল সম্পদ ।এদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মানুষের কাছে কষ্টকর হ্য়ে উঠছে দিন গুজরান ।
              ব্রিটিশ আমলে দমন পীড়নের নায়ক ছিল ব্রিটিশরা এবং তাদের অনুগত রাজা জমিদার জোতদারেরা ।এখন তো মহল্লায় মহল্লায় শাসক দলের অনুগ্রহ পুষ্ট হাজার হাজার মেজ নেতা ,সেজ নেতাদের মনসবদারি ।এরা পুলিশকে বোম মারার হুমকি দেয় ,অধ্যক্ষকে চেয়ার থেকে ঠেলে ফেলে , বাজারের থলিতে ,রান্নাঘরে নজর রাখে,ধর্ষণে পৌরুষ প্রদর্শন করে । একটি স্বাধীন ও গনতান্ত্রিক দেশে  ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য আইনও যথেষ্ট আছে ।কিন্তু বিচারালয়ের দরজা পর্যন্ত পৌছানোর স্বাধীনতাটুকু যে অর্থবল এবং  পর্যাপ্ত সাহসের উপর নির্ভরশীল ।সেটা বহুজনেরই নেই এই দুর্ভাগা দেশে । তাদের কাছে স্বাধীনতা দিবস মানে আজও কেবলমাত্র উর্ধে আন্দোলিত অশোকচক্র শোভিত ত্রিবর্ণরঞ্জিত অসংখ্য পতাকার "জন-গন-মন "ময় ব্যান্ড মুখরিত  কেবল মাত্র একটি দিন । চা বাগানে , কৃষিক্ষেত্রে,বন্ধ কারখানার গেটে অনশনক্লিষ্ট মানুষের গলায় কি আদৌ শোনা যাবে যতখানি তোমার ইন্ডিয়া ততটাই আমার ভারত ।সেই দিনটির দিকেই তো আমাদের যাকিয়ে থাকা ।

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...