Saturday, August 11, 2018

‘স্বাধীনতা, প্রজাতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের করমর্দন ’ : শুভদীপ নায়ক

 ক্রোড়পত্র







চার অধ্যায়ে’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দেশটা মাটি দিয়ে গড়া নয় , দেশ মানুষে গড়া । ’


‘স্বাধীনতা’— এই শব্দবন্ধের মধ্যে লুকিয়ে থাকে একটা দেশ, একটা জাতি, এবং একটা দীর্ঘ ইতিহাসের কথা । যে কথা আড়াল করে না সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আধিপত্যকেও । কিন্তু স্বাধীনতার অস্তিত্ব শুধুমাত্র একটা তারিখ কিংবা একটা দেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল দিন হিসাবেই লিখিত আছে, এমন নয় । স্বাধীনতা মূলত দেশের সামগ্রিক জনসাধারণকে সর্বস্তরে প্রসারিত হওয়ার রাস্তা উন্মুক্ত করেছে কিনা, সেটাই বিচার্য । প্রায় দুই শতক ধরে চলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষের মানুষ স্বাধীনতা পায় । কিন্তু তীব্র হিন্দু জাতীয়তাবোধ ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে প্রবল সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে । ফলে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করলাম তা আর ‘অবিভক্ত  ভারতবর্ষের স্বাধীনতা’ হিসেবে রইল না । 


কিছুদিন আগেই আমার এক ছাত্র এদেশে ফিরেছে আফ্রিকা থেকে । কর্মসূত্রে আইভরি কোস্টে বহুদিন কাটিয়ে সে দেশে ফিরেছে । ঘানা ও লিবিয়ার নিকটবর্তী উত্তর আটলাণ্টিকের তীরে অবস্থিত এই দেশের স্থানীয় নাম ‘রিপাবলিক অব কোট দি আইভরি’ , যা বিশ্বের তৃতীয় কফি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত । ১৮৪২ থেকে ১৮৮২ অবধি ফরাসিদের একাধিপত্যে থাকা দেশটি থেকে সংগ্রহ করা হত উৎকৃষ্ট মানের প্রকৃতিক সম্পদ ও পর্যাপ্ত পরিমানে দাস এবং শ্রমিক । এই আফ্রিকানরা তখন ইউরোপীয় বণিকদের জাহাজে শ্রম দিত , দিনমজুরের কাজ করত । ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে ১৯০৪ সালে ‘কোট দি ভেয়ার’ নামে পশ্চিম আফ্রিকার রাষ্ট্রে পরিণত হয় । ‘কোট দি আইভরি’ নামটিও ফরাসিদেরই দেওয়া । এখানে একটা প্রসঙ্গ না লিখে এড়িয়ে যেতে পারলাম না । প্রসঙ্গটিকে বলা যেতে পারে আফ্রিকানদের ‘ক্ষুধার ইতিহাস’ কিংবা ‘খাদ্যের স্বাধীনতা’ । সেইসময় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে আফ্রিকানরা । মুক্তির মিছিল নামছে পথে পথে । শাসকের পতাকা, কুশপুতুল দাহ হচ্ছে । ব্যারিকেড ভেঙে গ্রেপ্তার হচ্ছে হাজার হাজার আফ্রিকান শ্রমিক,কৃষক,যুবকেরা । প্রশাসকের নির্দেশে  মেরে ফেলা হল বহু আফ্রিকান বিদ্রোহীদের । রেহাই পেল না শিশু ও নারীরাও । যুদ্ধের সময় শাসকের তরফ থেকে মিলত বেঁচে থাকার জন্য যৎসামান্য খাদ্য । শাসিতের ওপর শাসকের করুণাও একপ্রকার শাসন, পরাধীনতার শৃঙ্খল, এ কথা আফ্রিকানদের বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল । বিদ্রোহীদের ঐটুকু করুণা করলে তারা হাতে তুলে নেবে প্রয়োজনের শৃঙ্খল, সরে দাঁড়াবে সংগ্রামের পথ থেকে । এবং, এর মাধ্যমে টিকে যাবে শাসকের উপনিবেশ । যুদ্ধের শেষে তাই ট্রাকভর্তি পাউরুটি (ব্রাউন ব্রেড) আসত অপেক্ষাকৃত গরিব আফ্রিকানদের কলোনিতে । একটুকরো পাউরুটির আশায় ন্যাংটো আফ্রিকান শিশুরা লাইন দিত ট্রাকের পিছনে । এসে জড়ো হতো কৃষক,শ্রমিক সহ আরও দরিদ্র আফ্রিকানরা যারা মূলত দাসপ্রথায় নিযুক্ত ছিল । যুদ্ধের সময় প্রবল খাদ্যসংকট আফ্রিকানদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে পিছিয়ে দেয় আরও কয়েকদশক । পরিশেষে ১৯৬০ সালের ৭ই অাগস্ট ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় আইভরি কোস্ট । নব্যগঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম হয় ‘রিপাবলিক অব কোট দি আইভরি’ । ৭ই অাগস্ট তাই সেজে ওঠে ‘ইয়ামোসুক্রো’ (আইভরি কোস্টের রাজধানী—আবিদজান প্রশাসনিক ), কিন্তু ১৯৯৯ এর শুরুতে বিশ্ববাজারে কফি ও কোকোর দাম পড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক দিক থেকে ধাক্কা খায় রাষ্ট্রটি, খর্ব হয়ে আসে তাদের বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা । ফ্রাঙ্কের দাম পড়ে যায় (ফ্রাঙ্ক হল আইভরি কোস্টের মুদ্রা) । ফলে অর্থ উপার্জনের তাগিদে পুনরায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আফ্রিকান এই দেশটির নাগরিকরা । তবে, আজও প্রাতরাশের টেবিলে একটুকরো ব্রাউন ব্রেড তাদের চোখে জল এনে দেয় । 



সুতরাং, স্বাধীনতা কেবল একটা তারিখ নয় , কিংবা সাম্রাজ্যবাদ শক্তির হাত থেকে মুক্তি পাওয়াটাও একটা জাতির পক্ষে শুধুমাত্র স্বাধীনতা অর্জন বোঝায় না । আমরা দেখেছি, গণতান্ত্রিক সরকারের স্বৈরাচারী মুখ ।  দেখেছি, স্বাধীনরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক পরাধীনতা কীভাবে পাশাপাশি বিত্তশালী ও দরিদ্র শ্রেণীর জন্ম একইসঙ্গে দেয় । একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের কোণায় কোণায় দেখেছি জাল বুনছে বর্ণবিদ্বেষ, গজিয়ে উঠছে নারীর ওপর যৌন অত্যাচারের বিষাক্ত উদ্ভিদেরা । দেশ হয়তো আক্ষরিক অর্থে স্বাধীনতা পেয়েছে, কিন্তু মানুষকে আজও লড়তে হচ্ছে তার অধিকারের লড়াই । মেয়েদের অধিকার প্রত্যহ অবদমিত হচ্ছে , গরিবের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত থাকছে, প্রশাসক আজও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে চলেছে বিরোধীদের ওপর । মানুষের যা কিছু ব্যক্তিগত  তা কেড়ে নিচ্ছে সার্বভৌম আখ্যা দিয়ে । যিনি শাসনকর্তা , তার কাছে প্রশ্ন করা, প্রাপ্য চেয়ে নেওয়া অথবা জানতে চাওয়া কিংবা যুক্তি তুলে ধরার অধিকার যেন শাসিতের নেই । আর এসব নিরন্তর ঘটে চলেছে স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে , যার কিনা মূলভিত্তিই হল প্রজা, অর্থাৎ খেটে খাওয়া সংগ্রামী সাধারণ মানুষ । এখন প্রশ্ন হচ্ছে ,যে দেশে কিনা একাধিক বিমানবন্দর, শতাধিক রেলস্টেশন,যে দেশ বিশ্ববাজারে বাণিজ্য তথা সামরিক শক্তির দিক থেকে বড় বড় দেশগুলির সঙ্গে এক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত , সেই দেশে সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার কতটুকু ? মেয়েদের নৈতিক স্বাধীনতা কি অবাধ না কি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রিত ? সেই দেশে লেখকদের স্বাধীনতা কতটুকু , অন্তত লেখার বিষয়ে যদি প্রশাসনের ব্যর্থতা জড়িয়ে পড়ে ? সেই দেশে চিত্রকরা কি ন্যুড ছবি আঁকতে পারেন প্রকাশ্যে ? বিরোধী রাজনৈতিক দলের জমায়েতে সেই দেশের সামরিক বাহিনী কি গুলি চালায় ? তেমনটা যদি হয় , তা হলে প্রজাতন্ত্র বলতে কোনও শিশুই আর জন্ম নেয় না সেই দেশের স্বাধীনতার গর্ভে । আমরা তাকে আর উচিত অর্থে স্বাধীনরাষ্ট্র বলতে পারি না । কারণ , স্বাধীনতার নিচে চাপা পড়ে গেছে মানুষের স্বাধীনতা পাওয়ার মূল  আন্দোলনগুলি । ‘আন্দোলন’— যা একমুখী, যা উঠে আসে সমাজের একেবারের নিচুতলা থেকে , যা উঠে আসে অধিকার রক্ষার দাবি নিয়ে ।  আন্দোলন , যা প্রবাহিত হয় শাসকাভিমুখী । তা এক অর্থে স্বাধীনতারই প্রেক্ষিত । কেননা, স্বাধীনতা তো ভূ-খণ্ডের নয় । স্বাধীনতা মানুষের । পৃথিবীর যে কোনও প্রদেশেই তাই ছবিটা এক । পরাধীনতার অবক্ষয় থেকে ভেসে আসলো যে স্বাধীনতা, গঠন করল যুক্তরাষ্ট্র কিংবা প্রজাতন্ত্র , মানুষকে বসবাসের জন্য আশ্রয় দিল, সীমানায় পৃথক করল , তা সত্যিই কি মনুষ্যসহায়ক রইল শেষ পর্যন্ত ? গণতন্ত্র কি শেষপর্যন্ত রাজতন্ত্রের চেহারা নিল না ? গণহত্যা, বন্দীশিবির, যৌননির্যাতন, রাজনৈতিক গুপ্ত হত্যা , ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জাতিবৈষম্য, লিঙ্গতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা,— এসবের প্রত্যেকটিতেই মানুষ কি এখনও পরাধীন নয় এই স্বাধীন ভারতবর্ষে ? তা হলে ’৪৭ এর ১৫ই আগস্ট যে স্বাধীনতা এসেছে আমাদের ভারতবর্ষের নাগরিক অধিকারে ,— সে কি উচিত অর্থে স্বাধীনতা ?

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...