শ্রীরামপুর ১৯৯০
সন্ধ্যা
ঘনালে দিনেমার গির্জায়
আমরা
কজন ফিরে গেছি শেষ বাসে,
কাঠের
হরফে ছাপা বোটানির নোট
মিশনারিগণ
তখনও বিলান ক্লাসে।
কলেজের
ক্লাস নয়, আমাদের প্রিয়
একটাই
ঠেক ছিল এ মহল্লায় –
কালী-কেবিনের
চেয়ারও বোটানি বোঝে
ক্লাস-কাটা
কটি ছাত্রের পাল্লায়।
ফাঁকা
হয়ে গেছে মেহগনি গাছতলা,
ঝাঁপ
নেমে গেছে কলেজ ক্যান্টিনের,
আঠারো
শতক কখন যে ফুরিয়েছে
গল্পের
ঘোরে আমরা পাইনি টের।
লাইব্রেরি
রুমে যদিও নেভেনি আলো,
কারা
কথা বলে চুপি চুপি, ফিস ফিস –
‘কেরি
সাহেবের বাংলার পিরিয়ডে
কালকে
আমার প্রক্সিটা দিয়ে দিস’।
বিংশ
শতক, সাল ছিল নব্বই।
আমরা
অবাক, টেবিলে ঝুঁকিয়ে মাথা,
একমনে
কেরি নিজহাতে লিখছেন
শব্দকোষের
পুড়ে যাওয়া কটা পাতা...
মসলিন
মেঘের
বদলে আকাশে তখন পেঁজা পেঁজা তুলো উড়ত,
জীবনের
বহু জ্ঞান ছিল ভাসা-ভাসা।
বই
পড়া সব কাহিনির ছবি বাস্তবে হত মূর্ত,
মগজে
ছিল না ‘অন্ন-চিন্তা’ ঠাসা।
তখনও
তোমার পুজোর ফ্যাশনে পলি-এস্টার আসেনি,
কোম্পানি-রুল
কায়েম হয়নি দেশে,
বাংলাদেশের
একলব্যেরা তখনও বুনেছে মসলিন,
মাকু
আর তীরে তফাৎ ছিল না বিশেষ।
মাটির
দেওয়াল, টালির ছাউনি, নোনা ধরে যাওয়া মেঝে,
স্বর্গ
তবুও এখানেই ছিল, এখানে।
চাঁদের
আলো না, প্রকাশ্য দিনে ঘন্টা উঠলে বেজে
সশরীরে
পরী নামত মাটির টানে।
গৌরবময়
সেইসব দিনে আমরা তখনও ছাত্র,
মাথা
নিচু করে কাটিয়েছি গোটা ক্লাস।
শাজাহানই
একা দেখেছিল, তা-ও কয়েক পলক মাত্র,
মসলিন-পরা
ভারতের ইতিহাস।
ভাষা
তুমি
যখন ডাকটিকিটের রঙিন ডানায় ভেসে
অনেক
দিনের পরে আবার ফিরে আসছো বাড়ি
আমি
তখন দূরের পথে ঝর্নাকলম হাটে
নতুন
কোনও ভাষার খোঁজে খুলেছি ডাইরি
যে
সব ভাষা সদ্য-ফোটা, যে সব ভাষা প্রাচীন
যে
ভাষাতে তর্কে মাতে ভোরের গঙ্গা ফড়িং
যে
সব ভাষায় পাড়ের সঙ্গে নদীর আলাপ চলে
আকাশ
জুড়ে মেঘ লিখেছে আষাঢ় দিনের হোর্ডিং
তুমি
যখন এনভেলাপের ভিতর থেকে নেমে
আলতো
করে বসছো আমার কিশোর বয়স ঘেঁষে
ঘাসের
ভিতর লুকিয়ে থাকা পতঙ্গদের ভাষা
আমি
তখন কুড়িয়ে নিচ্ছি পাখির ছদ্মবেশে
সেই দিনটি
দিনটি
ছিল মেঘলা, সেই দিনটি ভীষণ রোগা,
সেই
দিনটির সঙ্গে আমার অনেক দিনের আলাপ।
রোদের
হিমোগ্লোবিন কমায় আবছায়াতে ভোগা
সেই
দিনটির শরীর চিরকালই ছিল খারাপ।
তার
সঙ্গে ঘুরতে গেছি অনেক নদীর ধারে -
অনেক
বিকেল তার জন্যই বন্দিজীবন যাপন
করেও
তার মন বুঝিনি, বুঝব কী প্রকারে,
দিনটি
আমার কেউ ছিল না, আমিও কি তার আপন?
কখন
যে সে আমার জন্য আঁচল পাতে ঘাসে,
কখন
আবার গুমরে থাকে, বুঝি না কী কারণ,
কেবল
যেদিন হাপুস নয়ন কান্নায় সে ভাসে,
বুক
ভেঙে যায়, কিন্তু আমার বৃষ্টি ভেজা বারণ।
ফেরা
আমরা
যখন ফিরে আসছি বাড়ি
কুয়াশা
মুড়ে ঘুমিয়ে ছিল পাহাড়।
আলতো
হাতে গীয়ার বদল করি
শব্দে
যাতে ঘুম না ভাঙে তার।
আমরা
যখন ফিরে আসছি বাড়ি
পিছনে
ফেলে অবিস্মরণীয়
দিনগুলিকে
রূপকথার দেশে,
ঘুমিয়ে
ছিল গহীন বনানীও
পাহাড়
বা বন ঘুম ভাঙেনি কারও
কেবলমাত্র
বিষণ্ণ এক নদী
খানিকটা
দূর সঙ্গে এসেছিল,
সারা
জীবন সঙ্গী হত যদি,
আমরা
যখন বয়ে আনছি বাড়ি
বুকের
মধ্যে ঘুমন্ত পাহাড়ই!
@
No comments:
Post a Comment