আমার ভারত কি আপনার ভারত? আপনার ভারত কি ওঁর ভারত? তাঁর ভারত? আদৌ ভারত বলে কি কিছু আছে?
ভারত যে কী , সত্যি আজ অব্দি বুঝিনি। ভৌগোলিক সীমানাই কি ভারত? এই দোলায়মানতা থেকে
শুরু করে, বুঝিনা এখনও
দেশপ্রেম আসলে কী। ভারতীয় সংস্কৃতির সংজ্ঞাতেও এখন ধোঁয়াশা আমার। এমন কি ১৯৫০ এ যে
ভারত আমরা বুঝতাম, সত্তরের দশকের পরবর্তীতে কি সেই ভারতই বোঝা যেত? নাকি ২০১৪ র পরে
অন্য কোন ভারতীয়ত্বের ধারণা গড়ে উঠেছে আমাদের? নব নব রূপ পরিগ্রহ করছে কি ভারত নামক ধারণা? ভারতীয়ত্বের ধারণা? তাহলে এতদিন যা সব
বুঝতাম তা কি নেহাতই ভাসাভাসা কিছু একটা নয়?
ষাটের শেষে বা সত্তরের দশকের শুরুতে, ইশকুলে পড়াকালীন, পনেরোই আগস্টের ভোরে চোখ জলে ভরে আসত জনগণমন গাইতে, গলা আজো বুজে আসে
সিনেমাহলে ও গান গাইতে। যদিও জানি সে আমার অবচেতনের ক্রিয়া। অথচ মুশকিল এই যে, সচেতনে দেশপ্রেমের প্রমাণ রাখায় বিশ্বাসী নই। এই যে প্রতি ছবির আগে দাঁড়িয়ে
উঠে দেশভক্তির প্রমাণ রাখা, এটা নিছক আনুষ্ঠানিক এক ধরণের বিব্রত করা দেখানেপনা বলে মনে হয়। আর এখন, এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও ত হয়নি। প্রতিদিনের কাগজ পড়ে বুঝতে হবে, সিনেমার আগে ও গান
বাজবে কি বাজবে না। বড় ক্ষীণ সুতোয় ঝুলছে আমার দেশপ্রেম আজ। অথচ সেই সে স্বর্ণিল
ছোটবেলা থেকে এই কদিন আগে অব্দি ছিলাম অজ্ঞতার স্বর্গে। একটা না বোঝা ভারতবর্ষের
গর্ভে।
এখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় এই ভেবে , যে, জীবনের এতগুলো বছর
যে ভারত কী, না বুঝেই কেটে গেল, এও ত খুব বড় এক
পাওয়া আমার। কেননা, আজকে যে শিশু বড় হয়ে উঠছে তার পক্ষে বোধ হয় এত সহজ
হবে না এসব না ভেবে পার পাওয়া। কী বাড়িতে, কী পাড়ায়, কী ইশকুলে। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, বাক্যটা বোঝা প্রায়
অসম্ভবই দাঁড়াবে তার পক্ষে। এত বেশি বিভেদ, ভাগাভাগি, এত বেশি দেওয়ালের মধ্যে সে জন্মাচ্ছে, যে নিজের হাউজিং
সোসাইটির বাইরেটাই তার কাছে বিদেশ। নিজের পরিবার পরিজনের বাইরে অন্য কোন মানুষকে
আর একজন স্বদেশবাসী বলে বুঝতে শিখছে কি সে, না সে হয়ে উঠছে দেওয়ালের ওপারের আর একজন অচেনা, সন্দেহজনক অপর?
ইশকুলের বইতে সাদা গেরুয়া সবুজের ফালি ফালি রং, বা সারে জাঁহা সে
আচ্ছা, বন্দেমাতরম লেখা
পাতা… ঝাপসা ম্যাটমেটে ছাপা ছবিতে গান্ধিজি মৌলানা আজাদ ভিমরাও আম্বেদকর… সব
ঘেঁটেঘুঁটে থাকা আমার ভারতেতিহাস চেতনা এখন আর কজনের পোষাবে ? উচিত কি আদৌ এমন
ঘেঁটে থাকা? তাকে তো বুঝতে হবে , এই সব দেশনেতাদের বিশ্বাস-ভাবনার মধ্যেও কত না আলাদা আলাদা চোরাস্রোত
বয়ে যাচ্ছে । ‘নানা ভাষা নানা মত’ থেকে ‘বিবিধের মাঝে দেখ
মিলন মহান’ - এ সমীকরণ অনেক বেশি
কঠিন সেই ‘সরল কর’-নামক বেজায় জটিল
অংকগুলোর থেকে। যেগুলোর উত্তর শূন্য আসার থাকলেও, আমার সর্বদাই আসত ৪.৫৬২ ধরণের বিটকেল কিছু। আর এত
ঝাপসা হয়ে গেছে এই বীতসত্য বা পোস্ট ট্রুথের দুনিয়ায় সব একত্বের সংজ্ঞাই। সত্য কী
আর মিথ্যা কী… তাও ত বার বার পরখ করতে হবে ।
ইশকুলের বইগুলো নাকি সব কথা ঠিক লেখেনা, এমন বেয়াক্কেলে কথা
কে কবে শুনেছে, কিন্তু আজকের শিশুকে
তাও শুনতে হবে। কিশোর কিশোরীদের আজ জানতে হবে, বইতে লেখা আছে একরকম, কিন্তু সত্যি আর এক রকম। একটি দেশ, তার হরেক রাজ্য , হরেক রাজ্যের মধ্যে
হরেক জাতি… জাতপাত, ধর্ম পরিচয়ের রকম ফের। ইতিহাসের আলাদা আলাদা বয়ান
এভাবে তার বহুরূপ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে আমাদের ওপর, কে ভেবেছিল! কোন একরঙা , মেটে মেটে ভারতবর্ষের আদল আর সম্ভব নয়।
আপনি যদি মহারাষ্ট্রের মাহার কমিউনিটির হন, আপনার কাছে যে
ভারতেতিহাস, আপনি যদি ব্রাহ্মণ
হন, অন্য। গৌরবে বহুবচন
শব্দযুগল ব্যকরণ থেকে উঠে এসে এখন সত্যি গৌরবের বহু-বাচনে পর্যবসিত। প্রতি মানুষ তাঁর
স্ব স্ব জাত, গোষ্ঠী , ধর্ম অনুসারে
গৌরবকে সংজ্ঞায়িত করবেন। এমন কি দুর্গাপুজোর সময়ে আপনাকে প্রশ্ন করা হবে, তুমি কোন দলে? অসুরের, না দেবতার? অথচ সিংহ থেকে
মহিষাসুরকেও, লক্ষ্মী সরস্বতী
দুর্গার সঙ্গেসঙ্গে মিষ্টি খাইয়ে বিদায় করতেন যে মা মাসিরা, তাঁদের মনে এত সব
প্রশ্ন ছিল না তো!
আমাদের ছোট বেলায় কত সহজ ছিল, অবনীন্দ্রনাথের রাজকাহিনির প্রতিটি গল্প নিয়ে বিভোর
হয়ে স্বপ্নকল্পনা করতে। পদ্মিনীকাহিনিও তারই ভেতরে একটি। কোন দ্বিধা ছিল না, ভাবনার ক্ষেত্রে
কাঁটাকাঁটা খোঁচাখোঁচা সংশয়ের কন্টক ছিলনা। এখন , এসব পড়তে পড়তে এও জানতে হয়, কোন সামাজিক প্রেক্ষিত থেকে লেখা রাজকাহিনি, দেশের গৌরবের
ইতিহাস যে পর্যায়ে এসে জ্যোতিরিন্দ্র-রবি ঠাকুর-অবন ঠাকুরদের হাতে রচিত হচ্ছে, তখন ত আসলে জরুরি
ছিল ইংরেজ শাসনের বিপরীতে প্রতিস্পর্ধী এক জাতীয় গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনাই। কেন
পদ্মাবতীর দীর্ঘ ঈ কাটা যায় তা বোঝাও জরুরি হয়ে পড়ছে না কি তাই?
আমাদের ইশকুল জীবনে সবুজ খেলার মাঠের সবুজতা যতটাই
ছিল গভীর, অজ্ঞতার স্বর্গ
ততটাই ছিল নিশ্চিত, আর শিবাজী-শায়েস্তা খাঁয়ের লড়াই অবাধে পুনরভিনয় করাও
ততটাই ছিল সহজ। যে কোন দ্বৈত কত সপাটে ঢুকে পড়ত আমাদের মাথায়। ভাল খারাপ, সাদা কালোর মত।
শত্রু মিত্রও। ইতিহাসবই থেকে জীবনে ঢুকে পড়ত নাটক। অথচ, এখন আবার ফিরে পড়তে
হয় অতিপ্রিয় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিও, দেখে নিতে হয়
ধর্মের একপেশেমি-চড়ানো কাহিনিসূত্রকে… তুঙ্গভদ্রার তীরে, যা আমার ১৪-১৫ বয়সের চোখে ছিল কেবলি প্রেমের আখ্যান, আজ তার বয়ানে
বিজয়নগর বনাম গোলকোণ্ডার গল্পটা কতটা এক তরফা,সে কথাও সচেতনে দেখে নিতে হয়।
অর্থাৎ সর্ব ক্ষেত্রে স্বর্গ হইতে পতন অনিবার্য। আর এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সেদিন শুনে ফেললাম আবার , বিবিধ ভারতী।
আমার রেডিও ছিল না
বহুদিন । সহসা খুঁজে পাই
এক অল ইন্ডিয়া রেডিও অ্যাপ। এখন মোবাইল ফোনেও রেডিও বাজে। অল ইন্ডিয়া রেডিও। বিবিধ
ভারতী।
বিবিধ ভারতী নামটাইকে কেমন যেন গা ছমছমে ধরণের মনে হয় , অলৌকিক। বিবিধের
মাঝে দেখ মিলন মহান। আবার, আবার। সত্যি, আর যেই না রাতবিরেতের এই গানের অনুষ্ঠান চালু, আমিও ভাবি, আমাকে গতজন্মে নিয়ে গেল কে যেন। এখনকার বিভ্রান্ত, বীতসত্য, গোলমেলে
ভারতীয়ত্বের বাইরে। পলিটিকাল কারেক্ট আর ইনকারেক্টের বাইরে, এক স্বপ্নময়
ভারতবর্ষে।
কী সব পুরনো গান বাজে। জালি নোট ছবির গান বাজে আশা ভোঁসলের গলায়। মহম্মদ রফির
গলায় বাজে কালা বাজার ছবির আর এক গান। মধ্যরাতের সরু তার রিনরিন করে। গান শুনতে চেয়েছেন কারা? আউরঙ্গাবাদ থেকে
গিরিশ ও তবসসুম। মোতিহারি থেকে বিপিন আউর সুমিত। রামদেওড়া থেকে ইমতিয়াজ আলি। ১৯৪৮
এর শহিদ ছবির গান। শুনতে চেয়েছেন ঝুনঝুনু থেকে দশরথ মাথুর। ইটারসি থেকে মুহম্মদ
আলম। তাতিসিলওয়াই থেকে লখমন চৌবে।
আমি ঘুমের অতলে তলিয়ে যাই। ট্রেনের ভোঁ বাজে। বি-বি-ধ
ভা-র-তী। সময়ের সিঁড়িগুলো পেছনের দিকে দ্রুত ঘুরছে আর অন্ধকারের ভেতর তলিয়ে আমি
খুঁজে নিচ্ছি ভূগোল পড়া, পাশের বাড়ির থেকে ভেসে আসা বিবিধ ভারতীর গান। আমাদের
বাড়িতে চলত না ওটা। পানের দোকানে বা পাশের বাড়িতে ছাড়া কোথাও চলত না। টিং টং
বিজ্ঞাপন , খুব খারাপ
শিশুমনের ওপর নাকি। তাই মা বলত...কিন্তু কান ত বন্ধ হতনা। ঘেষো চৌকো দু ভাঁজ করে
ত্রিকোণাকৃতি কান- ঢাকা রুমালের ফাঁকে ঢুকে আসত গান। পেনসিল আরো ছুঁচলো করতে করতে
আমি শুনছি...ঝুমরিতিলাইয়া থেকে রুকসানা বেগম, পাঠানকোট থেকে গুরশরণ কাউর শুনতে চেয়েছেন ১৯৫২ সালের
বেওয়াফা ছবির গান। তালাত মাহমুদ। তু আয়ে না আয়ে তেরি খুঁশি।.কত যে অজানা সব জায়গা
মনশ্চক্ষে ফুটে ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়। মানচিত্র ঘেঁটে যায়, ঝাপসা হয়ে যায়। ভারত বর্ষের ম্যাপে পেনসিল বোলাচ্ছি।
ত্রিকোণাকৃতি... পরোটার মত ভারত।
ওহ... ২০১৮ র
জানুয়ারি মাসের রাত্তির দীর্ঘ সাপের মত পেঁচিয়ে নিচ্ছে আমায় । কী নিশ্চিন্তি , কিচ্ছু
পাল্টায়নি। আমার ভারতবর্ষ একই আছে... রামপুর রামদেওড়া রামটহল মহম্মদ গুরশরণ
দশরথ... আউরঙ্গাবাদ..মোগলসরাই… সব জায়গার নামে লেগে আছে সেই গরম চায়ের গন্ধ, উনুনের ধোঁয়ার
কটু চোখ জ্বালা করা বাতাস।
এই জানুয়ারিতেও
তাহলে আছে সেই সব ঝুমরি তালাইয়ার মত প্রান্তিক টাউন, গঞ্জ? সেই সব শুনশান রেল স্টেশন, একটি মাত্র গাছের তলায় পাতা একটি মাত্র দড়ির খাটিয়া।
চোখে মোটা পুরু চশমা লাগানো কোন একাকী স্টেশন মাস্টার বা পয়েন্টসম্যান হয়ত বসে
আছে। কে জানে তার নাম কী। শত্রুঘন না ইসমাইল। সে কি খায়, কীভাবে বাঁচে। তারা কী অধীর আগ্রহে হলুদ পোস্টকার্ড
পাঠায় রেডিও স্টেশনে আর সেই রেডিও খুলে বসে থাকে রোজ, মাসের পর মাস, কখন, কবে , কোন গানের সঙ্গে তার নাম ডাকা হবে। শুনতে চেয়েছেন
অমুক জায়গা থেকে তমুক...।
আহ, লেপের মত আরামে
পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। মনে হয় আমার ভারত একই আছে, এখনো। এখনো সবটা রস ভেতরে অটুট রাখা এক ফলের মত। আমার ভারত নিটোল… তার জনগণের মন ও নিটোল।
একজন বিভ্রান্ত
ভারতীয়ের পক্ষে এখন, এই নস্টালজিয়া আর ঘুম , এটাই ওষুধ। ভুলে যাই, দেশনেতাদের সার দেওয়া ছবিগুলোর মধ্যেও কত না সমস্যার
উদয়। স্বামী
বিবেকানন্দের জন্মদিনেও দু দল যুবক লাঠালাঠি করেছে স্বামীজীর নাম করে মিছিল বার করার অধিকার নিয়ে। ভুলে যাই, স্বামীজির
পলিটিকাল কারেক্টনেস আছে কি নেই, তা। উনিও নাকি নারীবিরোধী, দলিতবিরোধী, সনাতন ভারতবর্ষের ধ্বজাধারী - এমন সব ফেসবুক পোস্ট, অন্যদিকে ওঁকে অ-মানুষী, ভগবান বানানোর চেষ্টা। বর্ণ হিন্দুদের হিরো বানানোর
ছক। …ইতিহাসের এক প্রান্তে উনি আর এক প্রান্তে আমরা, এ মুহূর্তে ওঁকে
আমাদের দেখাটাও যে কত না পলির পরতের তলায় বিকৃত, মলিন… জেগে থাকতে হলে এ সমস্ত কিছু আমাকে বুঝে নিতে
হবে।
আমাদের পরবর্তী
প্রজন্মকে কিন্তু চিনে নিতে হবে কে
কোথায় দাঁড়িয়ে, কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে…
অথবা কোনটা কার সত্য। দুর্ভাগা ওরা, ওদের জন্য গলার কাছে ব্যথা ব্যথা করা কোন ঝাপসা মধুর
দেশপ্রেম আর রইল না।
(পূর্বপ্রকাশিত- আনন্দবাজার পত্রিকা)
অসামান্য লেখা । এত মৌলিক , এত মেদহীন ! অসামান্য লেখা ।
ReplyDeleteভালো লাগলো ।অসামান্য
ReplyDeleteআপনার কবিতাগুচ্ছ বেশী ভালো লাগলো। এই লেখাটির মধ্যে একজন অশিক্ষিত পাঠক হিসেবে কোনো নতুন চিন্তার ঝলক খুঁজে পেলাম না। এমন কোনো তত্ত্ব বা তথ্য নেই যা আমাদের ভাবনাবীজকে উদ্দীপ্ত করবে। আমার ঔদ্ধত্য ক্ষমা করবেন।
ReplyDeleteকিন্তু আপনার দ্বিতীয় কবিতাটি যাতে আপনি লিন্চিস্থান শব্দটি প্রয়োগ করেছেন, অসাধারণ মেধাবী উজ্জ্বল প্রয়োগ। সব কবিতাগুলোই খুব ভালো। চিন্তা উদ্রিক্ত করে। একটি মননশীল চোখের তো এটাই কামনা। কিছু মনে করবেন না। আমি একজন অশিক্ষিত পাঠক মাত্র।
এই লেখাটির সবচেয়ে বড় জোরের জায়গা এই যে লেখাটি কোনও জটিল তত্ত্ব-কচকচির মধ্যে না ঢুকে সহজ আটপৌরে ভাষায় ভারতীয়ত্ব মানে যে বহুস্তর বহুধাবিভক্ত 'এনটিটি', তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। খুব ভালো লাগল।
ReplyDelete