Sunday, August 12, 2018

আহ্ স্বাধীনতা.....কী বিস্ময়কর! : পম্পা দেব






'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়। দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে পড়িবে পায় হে কে পড়িবে পায়।'...কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন । সে ছিল স্বাধীনতার প্রকৃত প্রস্তাব। তাহলে আজ, স্বাধীনতার অর্দ্ধশতাব্দী পরেও কোথায় সে বাণী, কোথায় সে বজ্রনিনাদ। চক্ষু উন্মীলিত হলে দূরের রাস্তায় ক্যানেস্তারা বাজানো ছেলের দলের হিল্লোল কোথায় ফিকে হয়ে যায়? কোন রঙরুটে ? আর ঐ যে একাকী বেহালা বাদক নির্জন সুর তোলে ভুট্টা আর গমক্ষেতের ভেতর?
আমরা সেই শ্রেণীর প্রাণী, যারা বিশ্বাস করি ভীড়ে , একলা হতে চাইছে যে তাকে আরও প্রবল বৃত্তের মধ্যে ফেলতে হবে। আর সে যদি সেই মনস্তত্ত্বে বিশ্বাস না রাখে তাহলে তার পিঠে বসিয়ে দাও তকমা । ফালাফালা করে দাও তার সামাজিক সম্মান । যেহেতু তুমি এসে পড়েছ এই আলোকবৃত্তে , তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে এই হাজার হাজার ওয়াটের নীচে । তোমার এক টুকরো মনখারাপ, এক মুহূর্ত বিষন্নতা, তোমার অন্তর্গত রক্তমাংসের স্বতন্ত্র স্বত্তাকে প্রয়োজনে হত্যা করেও জীবীত রাখতে হবে বাইরের এই অবয়ব। যতই তোমার মনের মধ্যে তোলপাড় হোক তোমার ঠিক বা ভুলের মেপে নিতে থাকা ছবি গুলো  ।এই কাঠিন্যের মরা গাঙে চোয়ালে এক টুকরো কেঠো হাসি ধরে রাখতেই হবে। এই হলো স্বাধীনতার প্রথম শর্ত । হে মান্যবর ।
বিষাক্ত সাপ প্রতিপালিত হচ্ছে একেকটি খাঁচায়, তাদের মুখে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ল্যাবরেটরিতে  লালিত গিনিপিগ, পোষ্য স্যাঙাতরা নিয়ম করে এই খাদ্য আর খাদকের সাইক্লিক অর্ডার নিয়ন্ত্রণ করে ঘড়ি ধরে । আর নৈঋতে এইসব কিছু মনিটরে খুঁটিয়ে দেখে নেয় যে রোজ প্রত্যেক মিনিটে মিনিটে, তিনি চতুর্থ ঈশ্বর । রাষ্ট্রসংঘের মাথা । এই হলো স্বাধীনতার আরেক শর্ত। তোমার বাঁচা তোমার মরা অন্যের নিয়ন্ত্রণে। তোমার সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য বিন্দু বিন্দু  চালান হয়ে যাচ্ছে ঈশ্বরের মহাফেজখানায়। এই  হলো স্বাধীনতার আরেক শর্ত । যা ব্যক্তিগত পরিসরেও মর্যাদা দিতে জানেনা মানুষের ব্যক্তিগত মর্যাদাবোধ কে। কারণ তোমাকেও হতে হবে আমাদেরই মতো। এই হচ্ছে আমাদের অলিখিত সংবিধান । ইওর অনার।
আপনার অজান্তে, কখনও বা আপনার জ্ঞাতসারেই আপনার লেখার বা বক্তব্যের মূল সুরটি অন্য সুরে বাজবে ।  সোস্যল মিডিয়ার সামনে আপনার মনোভাব নিয়ে ব্যবসা করবে আরেক মাধ্যম । তার নাম সংবাদ মাধ্যম । যাদের কাজ এন্টারটেনমেন্ট ভ্যালুকে মেইনটেইন করে খবরকে আরেক পরতে প্রস্তুত করা । তো স্বাধীনতার এও আরেক রকম।
টুকরো টুকরো কথায়  ধরা পড়ে সব? সাপের চলন আর মূর্খের বাচালতা কি ধরা যায় নাবালক পৃষ্ঠায়। তবুও এ পৃথিবী, হায় পৃথিবী, তার গ্রহজন্ম ঘোর লেগে থাকে ভূপৃষ্ঠের শিরায় ধমনীতে। গোখরো সন্ত্রাস চালায় পদ্মবনে..পদ্মমধুর লোভে।
ভয় কী মারাত্মক শব্দ । যার শুরু আর শেষে লেগে থাকে পোকামাকড়ের শুঁড়িপথ । এই আমাদের মেরুদন্ড বেয়ে কখন সে উঠে আসে সরীসৃপের মতো।

পৃথিবী জুড়ে হানা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত ফ্যাসিবাদ। সংবাদ মাধ্যম থেকে,  গণমাধ্যম, লেখক , কৃষক, প্রেমিক ও সন্ন্যাসী, যে যেখানে আছে নারী ও পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ, আপামর জনসাধারণ, যে আছে জেলখানায় , যে আছে ইস্কুলে, কারখানার মাঠে কিম্বা কবরখানার বাগানে....কোনো ছাড়পত্র নেই সেই বিপন্নতার । 'শোলে' সিনেমার সেই পিন ড্রপ সাইলেন্স চুরমার করে দিচ্ছে বন্দুকের সশব্দ বেয়নেট। তুমি কী  লিখছ? রাষ্ট্র তার প্রুফ দেখবে কড়ায় গন্ডায়। তোমার প্রতিটি ভোরবেলাকার প্রার্থনা রিনিউ করে দেবে গৈরিক ঈশ্বর । তোমার সমস্ত সিলেবাস জুড়ে সেঁটে থাকবে রামনবমীর উপাখ্যান । তোমার রাধা , মীরা, গেয়ে উঠবে রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত । সেই ঠিক করে দেবে  তোমার নিজস্বতা মানে কার্তুজের ঘোষিত চীৎকার ।

অতি সম্প্রতি শহর কলকাতার পাতালরেলে একটি তরুণ -তরুণীর প্রণয়জনিত চুম্বনকে কেন্দ্র করে তোলপাড় হলো সোস্যল মিডিয়া থেকে পাড়ার চায়ের দোকান। ফিরে এল চণ্ডীমণ্ডপতলা, প্রায় শূলে চড়ানো অবস্থা । এই দু’হাজার আঠেরোয় দাঁড়িয়েও সেই তালিবানি সংস্কৃতি বেনজির বহাল। সেই সমাজে বাস করছি যেখানে প্রতিমুহূর্তে এক শ্রেণীর মানুষ বাঁচে নীল ছবির নির্জনে , মোবাইলে শুধু চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করলেই হলো। সেইসব নাগরিক হতাশাগ্রস্ত সুশীল সমাজ যারা একটা পত্রিকা বন্ধ করে দিতে পারে, একটা থিয়েটার বন্ধ করে দিতে পারে, একটা মেয়েকে  নষ্ট বলে দাগিয়ে দিতে পারে, এমনকী পুরুষকেও। যদি সে হয় যথার্থই পুরুষোচিত, পুরুষোত্তম ।
চায়ের দোকানে অবারিত  মজলিস,
নৌকা বোরের বাহান্ন দান ছক,
মেয়েটার যত চরিত্রগত দোষ,
ওরা দাগ দেয় আজও এই ইস্তক।
আমরা বিকেল বেলায় দাঁড়াই ব্যালকনিতে । দুই বিনুনি মেয়েটি হারিয়ে যায় রেডিও স্টেশন সংলগ্ন উপত্যকা থেকে । চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বুঝতেই পারিনা কখন বদলে গেছে নেটওয়ার্ক ।
আসলে মোদ্দা কথাটা হলো সেই পুরনো কথাটাই । আমাদের একেকটা না হতে পারা , একেকটা সম্ভাবনার মৃত্যু আমাদের পরিণত করেছে পাশবিক প্ররোচনার নিহিত কয়েদে। আমরা নিজেদেরই অজান্তে পড়ে ফেলেছি বর্ণিল মুখোশ । আয়নায় নিজের মুখের ভেতর খুঁজে পাইনা হারিয়ে ফেলা ভাষা ।  যে ভাষা প্রবল  আপত্তিতেও অপার সম্ভাবনার কথা বলে । যে ভাষা হতাশার ভেতরেও কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো উজ্জ্বল, যে ভাষা দিনান্তে পায়ে হাঁটা পথের দেবতা হয়ে উঠতে পারে, যে ভাষা ঘুচিয়ে দিতে পারে একাকী গ্রহের শতসহস্র দৈন্য ।

অথচ স্বাধীনতা আমাদের দিয়েছিল পতাকা।
বইবার শক্তি নাহি দিল দীনের শরীরে। যে ফ্যাসিস্ট শক্তি দুর্বিত্তপরায়ন হয়ে উঠছে দিনে দিনে, যা কিনা লাখ চল্লিশ মানুষকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে বসতের অধিকার, তারা পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে সন্দেহের গুঁড়ো গুঁড়ো হাওয়ায় , রিফিউজি শব্দের গায়ে ঢলে পড়ছে তাদের বিষাদঘন ছায়া, তারা সন্দেহ করছে নিজেদের । কী সেই নথি? যা ছিন্নভিন্ন করে দিতে এসেছে তাদের বিন্দু বিন্দু ঘাম, রক্ত , শ্রমের মর্যাদায় ফলিত শস্যক্ষেত। এতদিনকার লালিত নাগরিক অধিকার । কোথাও সুরক্ষিত নেই নিজস্ব স্নানাগার। লুণ্ঠনকারী নিদান হেঁকেছে ভয়ঙ্কর । কখন কার পরিচয় অমূলক হয়ে যাচ্ছে এহেন নৈরাজ্যে।
রাজপথে লুটিয়ে পড়ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ।
হত্যা করা হচ্ছে গণতন্ত্রের আওয়াজ । গোমাতা গোচনা হয়ে উঠছে এই শতাব্দীর নাগরিক বলয়।
এই হলো স্বাধীনতার আরেক শর্ত । মহত্তম শর্ত।
তোমাকে হতে হবে যোগ্য যোগী। যোগসাধনার সাধ্বী ।
তোমাকে হতে হবে গোমাতার একনিষ্ঠ ভক্ত সন্তান । তোমাকে হতে হবে রাষ্ট্রের ডিজিটাল নজরবন্দী নাগরিক । তোমাকে হতে হবে হিন্দু মৌলবাদী । তোমাকে হতে হবে রামের উপাসক। হনুমান চল্লিশার নির্মল পাঠক। আদতে তোমাকে মৌনতা দেবে রাষ্ট্র ।
তোমার আজীবন সেন্ট্রালী কন্ট্রোলড। তোমার উত্তরাধিকার তোমার অভিশপ্ত নীরবতা ।
ইতিহাস ডুকরে কাঁদে নাকি ঈষৎ বাঁকা হাসি হাসে। কেনা জানে ক্ষমতা লেখে ইতিহাসের সমকাল। তবুও
লোকায়ৎ । তবুও মহাকাল ।
'এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে '...(!)

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...