আমার শরীর থেকে
ছিঁড়ে ফেল স্বাধীনতা নামের পতাকা – নির্মলেন্দু গুণ
ছোটবেলায় আমি খুব পতাকা আঁকতে ভালবাসতাম। প্রথমত এটা আঁকা বেশ সোজা, দ্বিতীয়ত তেমন তো
ভালো আঁকতে শিখি নি কখনো। প্রত্যেক স্বাধীনতা দিবসের দিন আমার আঁকা সেইসব পতাকা, দিয়ে সাজিয়ে তুলতাম আমাদের একতলা ভাড়াটে বাড়ির একচিলতে উঠোন। আমাদের গলির আকাশে তখন উজ্জ্বল উড়ছে দড়িতে ঝোলানো গোছা গোছা
কাগজের পতাকা , যার অধিকার নিয়ে পরের দিন আমাদের অনিবার্য মারামারি বাধবে। সেই হাফপ্যান্টের বয়েসেই কিন্তু আমার মনে হতো রাস্তায় ঝোলানো পতাকাগুলো সব একরকম কেন ? কেন বিভিন্ন পতাকার
মধ্যে বিভিন্নরকম ছবি আঁকা থাকে না ? আরও মনে হতো রাস্তার ওপর ঝোলানো এই সারি সারি পতাকাগুলো কেন
শুধু একদিনের জন্যই ঝোলানো হবে ? সে যাই হোক, আমার
আঁকা পতাকাগুলোর বুকে কিন্তু থাকতো কখনো বাঘ, কখনো জলে নৌকা চলছে, কখনো পাখি ওড়া মেঘেদের
ডানা। আমার একটা বন্ধু, আমারই মতো কালোকুলো, বোকাসোকা, নাকে সিকনি ঝরা, ছেঁড়া হাফপ্যান্ট, একবার বললো আমি কেন ওইসব পতাকা এঁকেছি, পতাকা নাকি শুধু একরকম
ছাড়া হয় না। শুধু বললো না, আমার সঙ্গে ঝগড়া করে ছিঁড়ে দিল আমার আঁকা পতাকাগুলোকে। আমিও ছাড়িনি। খিমচে ঘুষিয়ে রক্তারক্তি করে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলাম আমার নিজস্ব স্বাধীনতাকে। কতোটা পেরেছিলাম আজ আর স্মৃতিতে নেই।
কথাগুলো কিন্তু মনে ঠোক্কর খায় এই বয়েসেও। আজও কি আমার নিজস্ব একটি পতাকার
স্বাধীনতা আছে ? ভারত পাকিস্থানের খেলায়
আমি কেন দল হিসেবে পাকিস্থানকে সমর্থন করতে পারবো না ? এটা কি শুধুমাত্র একটা খেলা
নয় ? কই, ব্রাজিল আর্জেন্টিনার খেলায় তো এ প্রশ্ন ওঠে না। কাশ্মীর নিয়ে, সেখানের সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়া নিয়ে ফেসবুকে প্রশ্ন করলেই
কেন আমাকে ভয়াবহ ট্রোলের শিকার হতে হবে ? এন-আর-সির বিরুদ্ধে কথা তুললে, আমার মা, মাসি থেকে শুরু করে মেয়ে, বউয়ের গুষ্ঠি উদ্ধার করার স্বাধীনতা পেয়ে যাবে কিছু
গোষ্ঠীবদ্ধ লোক। একলা আমি আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাব না ।
স্বাধীনতার এই পতাকাটা তাহলে আসলে কার পতাকা ? শুধু বিশেষ কিছু মানুষের, কিছু গোষ্ঠীর ? কিছু ধর্মের ? হতে পারে
তারা সংখ্যায় বেশী, অনেক, অনেক বেশী। কিন্তু আমিও তো এই সিস্টেমেরই
একটা জিভ, একক জিভ। আমার মতো অনেকগুলো জিভকে জড়ো
করেই তো সিস্টেমের গোষ্ঠীতন্ত্র।
এই ভৌগলিক ভূখণ্ডে আমি ১৯৪৭ সালের পরে জন্মানোর জন্য ‘বাই ডিফল্ট’ কিছু অধিকার
পেয়েছি। কিন্তু সেই অধিকারগুলো তো আমার ক্ষেত্রে ‘বাই চয়েস’, বা ‘বাই
ডিজাইন’ নাও হতে পারে। যতক্ষণ না আমি অন্যের স্বাধীনতার ধারণায় আঘাত করছি ততক্ষণও
কী সেই অধিকারগুলো ভোগ করার পূর্ণ স্বাধীনতা আমার আছে ? এই মুহূর্তে, এই দেশ কালের সীমায়িত সঙ্জ্ঞায় ?
একটা ঘটনা তুলে আনি। আমার এক ছোটবোন একটু দস্যি, ট্রেকার, পাহাড়প্রেমী। বরাবর
একাই বন্ধুজনের সঙ্গে বহু পাহাড়ে বেড়ানো। বিয়ের পরে একদিন
জানলাম, তার শাশুড়ি বা শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পছন্দ করেন না একা বেরোনো। স্বামীর ছুটি ও
সখ কোনটাই নেই। তাই তার বেড়ানো
বলতে এখন এভারেস্ট বেস ক্যাম্প বা রূপকুণ্ডের বদলে সাউথ সিটি মল, বড়জোর তাজমহল বা
জয়পুর। সে তো এখন পাঠ নিয়েছে, ‘লক্ষ্মী বউদের একা বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যেতে নেই।’
আর এক আত্মীয়া চাকরী করতেন যাদবপুরে।
ব্যান্ডেল থেকে লোকাল ট্রেনে রোজ হৈহৈ করে ছিল অফিস যাওয়া। বিয়ের পর তার স্বামী তাকে রোজ পৌঁছে দেন সন্তোষপুর থেকে
অটো করে। ফিরিয়েও আনেন ঠিক পাঁচটায়। দড়িটা অদৃশ্য কিন্তু
প্রকট।
অন্দরটাই যে মেয়েদের স্বাভাবিক জায়গা, বিশেষ প্রয়োজন না হলে যে বাইরে যাওয়া অস্বাভাবিক, কর্মরত মেয়েরা সেই পরাধীনতার বোধটা বয়ে নিয়ে আসে অফিসেও । গত দশকে একটি
সমীক্ষা হয়েছিল,
যেখানে দেখানো হয়েছিল কী ভাবে পুরুষ ও মহিলারা অফিসটাইম ও তৎসন্নিহিত সময়কে
ব্যবহার করেন। ছেলেরা একবার অফিস বেরোলে বাইরের সব কাজ সেরে এমনকি আড্ডা মারা পর্যন্ত শেষ করে
তারপর বাড়ি ফেরে । মেয়েরা কিন্তু
শুধু অফিসের সময়টুকু বাড়ির বাইরে কাটিয়ে
যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে ফিরে আসে। এ একরকম স্বেচ্ছা আরোপিত অবরোধ যার প্রকৃত গুরুত্ব
মেয়েরা নিজেরাও টের পায় না। ‘লক্ষ্মী মেয়েরা অপ্রয়োজনে কখনো বাড়ির বাইরে থাকে না’
কিম্বা ‘ওই সময়ে কী করছিল? ’ কিছুটা অজান্তেই তার উত্তর মেয়েরা সব সময়ে তৈরি করে রাখে। কখন কোন প্রশ্নটা
ওঠে,
কে জানে?
কাল রাতে আমার বউয়ের মুখে শুনছিলাম, ফ্ল্যাটের এক পরিচিত প্রতিবেশিনী
সন্তানসম্ভবা। আমি প্রশ্ন করলাম ‘ওর তো
অলরেডি দুটো যমজ মেয়ে আছে ?’ উত্তর পেলাম, ওর শাশুড়ির খুব ইচ্ছে, একটা
নাতির। তাই মেয়েটির একদম ইচ্ছে না থাকা বা
শরীর সঙ্গ না দেওয়া স্বত্বেও আবার গর্ভধারণ। একটি পরিচিত মেয়ে পুনেতে নতুন চাকরী
পেয়েছে। তার মা ঠিক করেছেন সেখানে গিয়ে
থাকবেন, অন্তত যতদিন না তার বিয়ে হয়। বিয়ে হলে মালের জিম্মাদারি নতুন ক্রেতাকে
বুঝিয়ে দিয়ে তাঁর ছুটি।
এই তাহলে আমাদের অর্ধেক আকাশের স্বাধীনতা ? চিন্তার ও শরীরের স্বাধীনতা ?
বাকী অর্ধেকও কি স্বাধীন ? ডানা মেলে উড়াল দেবার আকাশ ? আখলাখ হোসেন নিশ্চিত জানতো
না তার বাড়ির ফ্রিজে তার নিজের পছন্দের মাংস রাখার স্বাধীনতা তার নেই। একটি বালক
লখনোউ এর ট্রেনে যেতে যেতে জানতো না তার ব্যাগে সে কী বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই প্রশ্নে
তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে কেউ। একজন ট্রাক ড্রাইভার এবং তিনজন খালাসী বৈধ
কাগজপত্র সহ কয়েকটি গরু নিয়ে হরিয়ানা সীমান্ত পেরোবার সময় জানতো না তাদেরকে
জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেবার স্বাধীনতা ভোগ করে অন্য কেউ। একটি তরুণী তার ভিনধর্মের
প্রেমিককে নিয়ে পালিয়ে ঘর বাঁধার সময় জানতো না তাকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার অধিকার
রয়েছে খাপ পঞ্চায়েত নামে কারোর। জ্যোতি বলে মেয়েটি, এক অদ্ভুত কারণে যে নির্ভয়া
নামে পরিচিত তার স্বাধীনতা ছিল না সুস্থ ভাবে বাড়িতে ফিরে আসার ? কাঠুয়াতে আসিফা
নামে মেয়েটির ধর্ষকদের স্বপক্ষে বেরনো মিছিল প্রতিপদে বলে দেয়
‘ছিল না, ছিল না।’
তাহলে এই প্রতি পদে পদে শেকলে বাঁধা স্বাধীনতা আমার কোন কাজের স্বাধীনতা ?
কাদের স্বাধীনতা ? মগজে কারফিউ। মুক্তচিন্তার স্বাধীনতাও আপনার নেই। অন্য কোন
তন্ত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা নেই, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে আছে, এই মতের প্রবক্তরা
এইসব দেখে শুনে আজ কি বলবেন ? রাষ্ট্র যেখানে নিজেই স্বৈরতান্ত্রিকভাবে, অগণতান্ত্রিকতার একনিষ্ঠ উপাসক, যেখানে রাষ্ট্রীয়
পৃষ্টপোষকতায় সার জল পায় ব্রাহ্মণ্য মৌলবাদ, সেখানে কীসের স্বাধীনতা ? আমরা তো আজকাল এসব মেনেও নিই
নির্বিবাদে। শুধু কালবুর্গী
থেকে অভিজিৎ রায়, গৌরী লঙ্কেশদের অজানা আততায়ীর হাতে মৃত্যু হয়। নিজস্ব চিন্তাকে
একটা কার্যকরী বাস্তবতায় রূপ দিতে পারা, অন্তত ছড়িয়ে দিতে পারা কি এতদিনেও আমাদের
অর্জন হতে পারে না ? মতপ্রকাশের
স্বাধীনতার কথা বলে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে রাষ্ট্র কেন মাত্র একাত্তর বছরের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র ধারণ করেছে ? কেন সে মুক্তচিন্তাকে ভয় পায় ? কেন চিন্তার স্বাধীনতাকে হরণ করে ? এক এক বয়সে কী তাহলে স্বাধীনতার
মানে পালটায় ? উত্তরটা কোথায় লুকোনো ?
আমাদের ভাবা উচিৎ। ভাবতে শেখা উচিৎ, ভাবা প্রাকটিস করা উচিৎ। ভাবতে ভাবতে
একদিন হয়তো আমার বা আপনার ছেলেমেয়ে বা তার ছেলেমেয়েরা এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পাবে, কেন
প্রত্যেকটা পতাকায় আলাদা আলাদা রঙ, আলাদা আলাদা ছবি থাকবে না ।
No comments:
Post a Comment