Saturday, August 11, 2018

গল্প এণাক্ষী রায়




কায় ভাসি যায়!

পাছার ফোঁড়ার ব্যথাটা খুব টনটনায়  মাঝেমধ্যে। বছরে দু-চারবার করে আসে যায় গত কয়েক বছর ধরে। একেকটা ফোঁড়া  ঠিক যেন  একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত বাড়তে বাড়তে যায় তারপর পূর্ণিমার চাঁদের মতো টসটসে হয় ফোঁড়াটা, আবার একটু একটু করে কমতে কমতে অমাবস্যায় ফিরে আসে। প্রথম যেদিন শুরু হয়, সেদিন সামান্য ব্যথা ব্যথা  করে শুধু। তার পরদিন থেকে একটু একটু করে বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত কোথাও পাছা ঠ্যাকানোও অসম্ভব হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে ফুলে ঢোল হয়ে যায়, রস গড়ায় জামা কাপড়ে। শেষ অব্দি ষোলকলা পূর্ণ করে, ব্যথাটা  আবার ধীরে ধীরে অমাবস্যার দিকে রওনা দেয়। গাদলিমাসির মনে হয় পাছায় শিকড় বাকড় গজিয়ে যাচ্ছে। ওই ফোঁড়ার গর্ত থেকে লম্বা লম্বা আকঁশি বেরবে এবার।  একটার পর একটা ফোঁড়া হয়েই চলেছে, বেছে বেছে সব লজ্জার জায়গায়। শিকড় গজাচ্ছে। পাথারু বলত এক জায়গায় অনেকদিন থাকলে শিকড় গজায় যায়।
বয়সের গাছ-পাথরের হিসাব পায় না গাদলিমাসি।  নিজেকে পাকুড় গাছটার মতো মনে হয়। পাছায় শেকড়বাকড় গজিয়ে- যাওয়ার ভয়ে দিনরাত টুকটুক করে হেঁটে বেড়ায় গাদলিমাসি। কোত্থাও বসতে চায় না বেশিক্ষণ। ফোঁড়ার সময়গুলো তো বসার উপায়ই থাকে না। থাকলেও কখনো ডাইনে কাত করে, কখনও বাঁয়ে কাত হয়ে বসতে হয় তখন।
    বসুক না-বসুক গাদলি মাসির গল্পের রাজারানী রাজপ্রাসাদ সব ঝকঝক তকতক করে হাজির হয় চোখের সামনে। রাজবাড়ির বাঁধানো দীঘির পারে নিজেই রাজকন্যা হয়ে বসে থাকেন তিনি। গল্প চলে। তাঁর গল্প চলে অবিরাম। রূপকথার ডালপালা এলিয়ে দিয়ে তিনি প্যাঁচানো শাড়ির ওপর দিয়ে টসটসে ফোঁড়াটাতে হাত বোলাতে বোলাতে আফশোস করেন, সব নাকি কপ্পুরের মতো উবে গেছে। ছেলেপিলেদের রগড় হয় খুব, দেখতে পেলেই উস্কে দেয় গপ্পটা।

-কী য্যান উড়ি গেইল মাসি। কপ্পুরের নাখান কীবা উড়ি গেইল?
- আজবাড়িটারে। আজাবাড়ি সিল এইঠে একখান। গড় সিল আজার, হুই উঁচা দেওয়ালটার ওই পারত। নদীর ওইপারত সিল।
- ওই উঁচা দেওয়ালখান! ওইঠে তো মিলিটারি ক্যাম্প গো। আজবাড়ি কুত্থেকে আসিল আর  উড়ি গেইল!
- উড়ি গেসে না পুড়ি গেসে কায় জানে! অইখানে আগৎ আজবাড়ি সিল একখান, গড়ের মইধ্যে আজবাড়ি। সিল তো লিচ্চয়ই।   তালমা নদীখান  প্যাঁচায় প্যঁচায় চলি গ্যাসে  মইধ্যে।
- যাও ক্যানে  একবার দেখি আসো! চক্ষু সারার্থক করি আসো। হেঁ হেঁ
- এলায় অইদিকে পাওখান আগাইলেই পোড়ারমুখো পুলিশগুলান চলি আসে,আন্দাগুন্দা বন্দুক চালায় দিবে। আজাবাড়িটা গলা নম্বা করিও দেখা যায় না বাউ। মন্দির,  দীঘি, সব কপ্পুর।
-— পুলিশ না হয়, ওইগুলান মিলিটারী মাসি।

যাও না বলে উস্কে দিলেই পোকাটা নড়ে গাদলিমাসির। ফের ওইদিকে যেতে চায়। পরিষ্কার চোখে আরেকবার দেখে আসতে চায় গড়। দেখে আসতে চায় পাথারু আছে কি না। কিন্তু পৃথিবীর সীমানা ছোট হয়ে গেছে।  চক্ষের সামনে দেখেছে গাদলি মাসি, এইখান থেকে ওইখান পৃথিবী  এঁকে দিয়ে গেছে  মানুষজন। সবাই মেনে নিয়েছে সেই আঁক।  ওই পারে কী আছে! কিচ্ছু নেই। ওই পারে কী! তালমা নদীই শেষ। আর এই পারে!  কেন, টাউন!
টাউনে যাও। সবাই চুপ। তালমা নদী পেরও তো, রাইফেল উঁচিয়ে দাঁড়ায় বিদেশি লোক।  এটা তো ছিল না।  গাদলি মাসির পৃথিবী  তালমা নদী সাঁতরে  সাঁতরে গড়ের ভিতর গিয়ে  সেঁধাত। ঘরের মানুষটা ওখান থেকে  একটা ঢিপির ভিরত পরী পেয়েছিল।  
    কামলা খাটত মানুষটা। গা-গতরে জোর ছিল কত। তালমার উঁচু পাড়ের গর্তগুলোয়  হাত ঢুকিয়ে বান মাছ টেনে  বার  করে আনত।  আর নেশার মতো ছুটে যেত গড়ে।  ঘুলঘুলাইয়া গড়টা চিনত ঠিক। এই দেওয়াল ওই দেওয়াল, এইদিক প্যঁচানো ওইদিক প্যাঁচানো। একটা জিনিস শিখাইছিল সে গোধূলিকে --‘যদি তালমা ধরি ধরি যাও, কুনোদিন হারাবা না।  মানুষটার দোস্ত ছিল ফয়জুল মল্লিক। একা মানুষ। গোধূলির নাখান একখান বনুশ পাইলে বিয়া করিব, বলেছিল।
 তো সে আমও নাই সেই অযোধ্যাও নাই। বেবাক পিরথিমি ছোট করি দিসে মাইনষ্যে। ফোঁড়াগুলা পাছা থেকে বগলে চলে আসছে গাদলিমাসির। গাদলিমাসি ভাবে, কাঁটাতারের বেড়াটাও ফোঁড়ার গজিয়ে-ওঠা বিষব্যথার মতো। শিঁকড় গজায় গ্যেসে বেবাক মাইনষ্যের। ফোঁড়াগুলা এখুন বগলৎ আসিবার ধরিসে। তালমার বিরিজে কাঁটাতার লাগাইসে শ্যালারা
   তখনও গাদলিমাসির নামটা এমন বিকৃত হয় নি, তখন সে ছিল গোধূলি, তার স্বামীর নাম পাথারু, সাকিন জহুরী।  কামলার কাজ করতে করতে গড়ের ভিতর গলিঘুঁজির নেশায় পেয়েছিল  গোধূলির স্বামীকে।  শহর থেকে সাইকেলে চড়ে কলেজের ছেলে ছোকরারা এলে গড় ঘুরিয়ে দেখাত।  কামলার বেটা কামলা পাথারুকে তারা নতুন নাম দিয়েছিল, গাইড। পাথারুও ওই টাউনের ছেলেদের  থেকে  জেনেছিল, কামরূপের রাজা পৃথুর রাজধানি ছিল ওই গড়।   ভিতরগড়। ওই দীঘিতে ঝাঁপিয়ে  প্রাণ দিয়েছিল রাজা।  টাকা-পয়সা না-ঠেকালেও পুরানো জামাটামা দিত ওরা। দুই একটা সিগারেট দিত। পাথারুর চেহারাটাই বদলে যেত ওই জামা কাপড় পরলে।  দেখে দেখে আশ মিটত না গোধূলির। সেই টেরিকাটা পাথারুর আবছা মুখটা মনের মধ্যে উথাল-পাথাল করছে কয়দিন ধরে। ঝকঝকে রোদ উঠলে এই গ্রাম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, সাদা ফটফটা। ওই টুকুই এ জায়গার সঙ্গে পাহাড়ের সম্পর্ক। এদিকটা সমতল, তবু কিছুদিন আগের চাষের জমিগুলো দেখতে দেখতে চা- বাগানে পালটে যাচ্ছে। ছোট ছোট চা-বাগান, তার নাই কারখানা নাই কিচ্ছু। জমির মালিক পাতা তুলে বড় চা-বাগানে বেচে দেয় কেজি দরে। ভ্যানকে ভ্যান চা-পাতা চলে যায় অন্য বাগানে।  তার জন্য দালালরা আসে। তারাই কেনে। হাতে কাঁচাটাকা আসে কটা।মাইলকে মাইল ধানি জমি চা বাগান হয়ে যাচ্ছে চক্ষের সামনে। সামান্য কিছু ধানি জমি যা পড়ে আছে তাতেও চাষ হয় না বছরভর। শরিকি বিবাদে মালিকেরা সব চাষ বাস শিকিয়ে তুলে দিয়েছে। আধিয়াররা যা চাষ করে তা নিজের খাবারটুকুর জন্যই। আগে ঢেঁকিতে পার দেবার কাজটা পেত গোধুলির মতো মেয়ে-বনুশরা।লাল লাল মোটা চালের সে কী সুবাস বের হতো ফুটলে। মোটা সর জমানো ফ্যান। একটু সরষের তেল আর নুন ফেলে দিলে, সেই ফ্যান যেন অমৃত। এখন সব ধানকলে দিয়ে আসে আধিয়ার রা। সে চা-বাগানই হোক, বা পরিত্যক্ত জমি, যার যার আধিয়াররা সব দল বেধে থাকে এক একটি পাড়া তৈরি করে। বেড়ার আর ছনের ঘরগুলো এখন পাকা দেওয়ালের ওপর টিনের চাল দেওয়া হয়ে গেছে সবার। শুধু গাদলি মাসিরই অবস্থা ফেরে নি।কোনো রকমে চেয়ে চিন্তে দিন চলে যায় একরকম। পাড়াটার বাড়ি গুলো মাঝখানে একটা রাস্তা রেখে দুপাশ দিয়ে সারি বেধে দাঁড়ানো। সামনেই বড় রাস্তা, শিলিগুড়ি -জলপাইগুড়ি বাইপাস। এই রাস্তা হওয়ার পর থেকে সামনে চলে আসছে শহর। কদিন আগেও টাউনে যেতে গেলে সাইকেলই ছিল ভরসা। এখন বাস যায় হুশ-হাশ। এখন  এইখানে হাই ইস্কুল পাশ দিয়ে কেউ কেউ টাউনেও যাচ্ছে পড়তে।


কালুয়ার ছোটছেলেটা টাউন থেকে পাশ দিয়ে এসেছে। ওকে দেখে অব্দি বুক ধরফড়াচ্ছে গাদলিমাসির। চেহারার ঢকটা পুরো সেই সেই মানুষটার মতো। ছেলেটার চারপাশে সারাদিন থাকতে মন চায়। মিষ্টিপানা হাসে ছেলেটা। তালমা নদীতে সাঁতরায়।  তালমার ব্রিজের থেকে ওপারের চাষাদের সঙ্গে গলা বাড়িয়ে কথা বলে ছেলেটা।  বুকটা টনটনায় গাদলিমাসির। লাউয়ের  মতো ঝুলঝুল-করা লম্বা বুকটা  টানটান করে বাঁধতে মন চায়।। নিজের যৌবনের কথা মনে পড়ে। ছেলেটা যেন ঠিক পাথারুর মতো। সেই রকমই টেরি কাটা, সেই রকমই শহরের জামাকাপড় পরা। আবার একই সঙ্গে মনে হয় নিজের ছেলেটা বেঁচে বর্তে থাকলে আজ এমন ঢকই হতো। গাদলি বুঝে পায় না, কেন যে ছেলে আর ছেলের বাপ দুজনকেই দেখতে পায় কালুয়ার ছেলের মধ্যে। সিগারেট খায় ছেলেটা। গাদলিমাসিকে দেখলে লুকায়। মনে মনে হাসে গাদলি, ঐ সুবাসটাই ওকে টানে। পাথারু শহরের বাবুদের থেকে সিগারেট পেলে একটু একটু করে খেত।  কাছে এসে মুখ হা করে গন্ধ শোঁকাত। ঠিক পাথারুর মতো বাস বেরয় ছেলেটার গা থেকে। নিজের বুকের ধনটা বেঁচে থাকলেও কী এই রকমই হতো? পাথারুর মতো? সেইকালে, কালুয়ার মা-র সঙ্গে নাম জড়াইছিল পাথারুর। পিরিতির বাস নাকি মাটি চাপা দিলেও যায় না। বাস পাইছিল পাড়ার লোকে। গোধূলি কেঁদে কেটে পাড়া মাথায় করলে পাথারু কিরা কেটে বলছিল বেবাক মিথ্যা। গোধূলি তখন পোয়াতি। গোধূলির পেটেরটার নামে কিরা কাটছিল পাথারু।
    কালুয়ার ছেলেটা তালমায় নামলে গাদলিমাসি গড়ের গল্পটা করে। রাজবাড়ি কপ্পুর হয়ে যাওয়ার গল্প করে। ধানিজমি সব সাফ করে গড়ে-ওঠা ঢেউ-খেলানো চা বাগানের  দিকে তাকিয়ে হা হুতাশ করে গাদলিমাসি। মাইনষের তৈরি পিথিমী ভগমানের নদী নালা, বন জঙ্গলের মধ্যে বেড়া উঁচায় কেনং করি!  সব উধাও হয়া যায়।  ঘর বাড়ি দালান মন্দির। বেবাক  ফরসা। ফয়জুল মল্লিকের লগে লোকটার পিরিত ছিল।  দুইজনেই গাইড বলত নিজেদের।  ফয়জুল পড়ল গিয়া পিরথিমির ওই দিকে। ওইদিকে চন্দর সুজ্জি ওঠে কি না  কায় জানে!
    কালুয়ার ছোটছেলেটা  জলে ঝাঁপায়,  দাপাদাপি করে।  ওকে দেখে মায়া জাগে গোধূলির মনে।  গড়ের গল্পটা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে ওকে।   সোনাদানা নাকি  খুঁড়লেই পাওয়া যেতে পারে। ওকে ফুসলায় গোধূলি। কালুয়ার ছেলেটা সেয়ানা হইছে।  গড়টা ওকে টানে।  তালমা ওইদিকে চলে যায় প্যাঁচায় প্যাঁচায়। কোনো গড় দেখা যায় না। চা বাগান শুধু। অনেকদূরে ঢিবির মতো উঁচু পাঁচিল। ছেলেটা তালমায় সাঁতরাতে গেলে, গাদলিমাসিও পিছে যায়।  গাছকোমর করে শাড়ি পরে জলে নামে মাসি। ফোঁড়াগুলা টাটায়, গ্রাহ্য করে না।  ছেলেটাকে মন্তর দেয়। ছোঁড়াটাকে দেখে অন্যরকম একটা পিরিত উপচায় পড়ে। 

বৃষ্টির ফোঁটাগুলা কুয়াসার মতো সাদা হয়ে আসে। নারকেল গাছের মাথাগুলো  পাগলের মতো উথালিপাথালি করলে তালমার রঙ পালটায়। এমনিতে নদীটা খটখটে দিনে কেমন যেন রঙ  ধরে। এদিক থেকে দেখলে সবুজ, অন্য দিক থেকে  হলুদ আবার নীল হয়ে  থাকে। আসল রঙটা যে  কী, বুঝতে  পারে না গাদিলিমাসি। রঙটা কালোবিড়ালটার চোখের মতো, একেকবার একেকরকম মনে হয়। আবার বর্ষার দিনে দুধের নদী হয়ে যায় তালমা। ঢালু পাড় ধরে সড়াৎ করে নেমে পড়ে গাদলিমাসি।  চারিদিক ধোয়াঁয় আঁধার করে এলে প্রতিবার মনে হয় গাদলিমাসির মতো বিদেশি লোকগুলোর চোখেও সাদা কাপড়ের পট্টি বেঁধে দিয়েছে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো। পাথারুর কথা মনে পড়ে, পাথারুর মতোন   কালুয়ার ছেলেটারও গা গতরে  জল আটকায় না, শাপলা পাতার মতো পিছলায় । টুকটুক হেঁটে গাদলি মাসি কালুয়ার বাসায় যায়। কালুয়ার বউ গালি দেয়। শুনতে পায় গোধূলি।
-পিতলা পিরিত দেখাতে আসছে বুড়ি।

পিতলা পিরিত শব্দটা শুনে মাথা ঝালাপালা করে গাদলিমাসির। ছাওয়াটার লগে তার পিতলা পিরিত!  আবছা হয়ে-আসা গল্পের মতো একটা মায়া জাগে। কে জানে কতশত বছর আগেকার মায়া। তখন গোধূলির চঞ্চল পায়ের পাতাদুটি হাজায় ভরে উঠত বর্ষাকালে। আঙুল ফাঁক করে করে সাদা হয়ে-যাওয়া পায়ের ফাঁকে মলম লাগাত গোধূলি। সারাদিন চুলকাত পা দুখান। বর্ষাকালে একহাঁটু জল পেরিয়ে খাটা পায়খানা যেতে হতো।ভরা পোয়াতি গোধুলির পায়খানায় কোঁৎ দিতে গিয়ে বাচ্চা বেরিয়ে সোজা গুয়ের টিনে। গু-মাখামাখি বাচ্চাটাকে ছোঁ-মেরে তুলে গলা-ছেড়ে কাঁদতে শুরু-করা গোধূলিকে এখনো আবছা মনে পড়ে গাদলিমাসির। ছাওয়াটাকে বাঁচানো যায় নাই কিছুতেই। মনের মধ্যে সেই স্মৃতির ঝাঁকুনি খেলে বুকখান টনটনায়। যেমন আজকাল টনটনাচ্ছে কালুয়ার কলেজে পাশ ছেলেটারে দেখে।
    ছেলেটারও  কেমন নেশা লাগসে গল্পের, বুঝতে পারে গাদিলিমাসি। সুর করে করে বলে, স্বামীর কাছে শোনা গল্প। কামরূপের আজা পিরথুর আজধানি সিল এই আমাদের চারিপাশ। অইখান থিকা ইট নিয়া নিয়া ঘর তুলসিলাম। সোনা দানা আনি নাই। ঢিবির মইধ্যে মইধ্যে মন্দির। সোনাদানা মনিমুক্তা ঘড়া ঘড়া। আজাবাড়ি তো! গপ্পের উড়াল দেয় গাদলিমাসি। ইচ্ছামতো বানিয়ে বানিয়ে গপ্প বাড়ায়।  কালুয়ার টাউন থেকে পাশ দিয়ে- আসা ছেলেটার চোখ চকচকায়।  
    বৃষ্টি নামলে দুই হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। তালমা নদীটা ডাকতে থাকে গোধূলিকে। ঝপাং করে ঝাঁপাতে পারে না আজকাল। সরাৎ করে নামে। বৃষ্টিতে পাহারাদারের চক্ষে পট্টি বাঁধলে তালমায় গা ভাসায়।

একটা নাকি যুদ্ধ লাগসিল। যুদ্ধটা দেখে নাই গোধূলি। কুনদিকে লাগল! টাউনের দিকে যায় নাই কুনদিন। টাউনত লাগতে পারে। মোটকথা যুদ্ধ লাগসিল। টাউনিয়া  ছেলেরা আসছিল বুকে ব্যাজ না কী যেন লাগায়। গোধুলীর বাপ জোতদারের বাসায় চালের বস্তা দিতে গিয়ে দেখসিল। একখান যুদ্ধ লাগসে। সাহেবদের সাথে। তখনো গোধূলি গাভুর হয় নাই। ফমেও নাই কিসু।
চারিপাশের ধানিজমিতে চা গাছ বসায় নাই কেউ। যুদ্ধ থেমে গেলে নাকি ওদিকে মুসলমান আর এদিকে হিন্দু থাকার ঠিক হলো। ওদিকটা যে কোথা থেকে শুরু। এদিকটাই বা কোত্থেকে বোঝে নাই গোধূলিরা। ফয়জুল পড়ল ওইদিকে। মাঝিখানে ধানক্ষেত, তালমা নদী। সব যেমনকে ছিল তেমনি পড়ে রইল। ওদিক থেকে এদিকে আসা যাওয়ার কোনো বাধা পড়ল না। যেমন ওই পাড়া আর এই পাড়া।
   আসা যাওয়ার ফারাক পড়ল তার কিছুদিন পর। এদিক দিয়ে মেঠো পথ চওড়া হতে থাকল। পিচ পড়ল। তালমার ওপর ব্রিজ হলো। ওই পার থেকে হুড়হুড় করে লোক আসতে লাগল। ওইখানে নাকি আবার যুদ্ধ লাগসে। ভাটিয়ারা আসি বসতেছে চরে।  তখন গোধূলি রীতিমতো গিন্নি।  ওপার থেকে  তাড়া  খেয়ে  এসে লোকগুলা বসত করল চরে। কোত্থেকে বিদেশি লোকজন এসে বসে পড়ল দুই পার পাহারা দিতে। হিন্দি না কীসব বিদেশী ভাষা কয়। কিস্যু বোঝে না গোধূলিরা। তারা এসে তারকাঁটা গাথল। ওইপার আর এইপার আলাদা হয়ে গেল। ফয়জুলকে আর দেখে নাই গোধূলি।


তালমা নদীর কখনও ভাগ হতে পারে, ওই জমিজমা ধানক্ষেতের কখনও ভাগ হতে পারে, ভাবে নাই পাথারু। টাউনিয়াদের মুখে অনেক আগেই শুনেছিল দেশভাগের কথা। সেইটা কোনদিক থেকে কোনদিক বোঝে নাই ওরা। বুঝতে চায়ও নাই। কোনদেশে কী হয়েছে তাই দিয়ে পাথারুর কী! পাথারু তালমা নদীতে ডুব দিয়ে গড়ে যায়। ছোটখাটো মূর্তি টুর্তি পেলে টাউনিয়াদের দিলে কিছু পয়সা পায়।
    বেড়া বাঁধায় খুব নাম ডাক ছিল  পাথারুর। সে কাজের আশায় ধারাপট্টি গিয়ে বসে থাকে ফি হপ্তায়। এই পারে সূর্য ওঠে, জানে। ওই পারে গড়ের পিছনে অস্ত যায়। এর মধ্যে কাঁটাতার দিয়ে তালমাকে দুভাগ করার যড়যন্ত্র ভেতরে ভেতরে ঘটে যাচ্ছে টের পায় নি।  ওই কাঁটাতার মানে নাই পাথারু। কাঁটাতার বসানোর দুদিনের মধ্যে একবার যেতে চেষ্টা করে গড়ে। মারধোর খায়। তারপর মনমরা হয়ে থাকতে থাকতে কথা নাই বার্তা নাই, একদিন সকালে উঠে গোধূলি দেখল মানুষটা নাই। নাই নাই তো নাই। দিন গেল রাত গেল গোধূলির বয়স গাছ পাথর ছাড়াল। পাথারুকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। লোকে বলে গড়ের নেশায় রাত বিরেতে উঠে তালমায় নামছিল পাথারু, তারপর বেবাক ভ্যানিস।
পাথারু ভ্যানিস হয়ে গেলে গোধুলির আরেকটা কাজ বাড়ে, পাথারুর  অপেক্ষা করা। অপেক্ষা করতে করতে পাছায় ফোঁড়া গজায়, বড় হয় টসটস করে। আবার আস্তে আস্তে শুকায় আসে। গোধুলির রঙ ফিকে হতে হতে গাদলি হয়ে যেতে থাকে। গোধূলী নামটা আর কারো মনে থাকে না।  ফোঁড়া গোনে গোধুলি। ওই একেকটা ফোঁড়ার ব্যথায় হাত বোলাতে বোলাতে দিন গুলো কেটে যায় একটা একটা করে।

ঝিম ধরে গাদলিমাসির।  টুকটুক করে  হাঁটতে হাঁটতে চক্ষু আন্ধার করে আসে। সব পুরানো কথাগুলো সার দিয়ে এসে দাঁড়ায় পরপর।  এই ভনভনা মাছির মতো বৃষ্টিতে পাথারুকে দেখতে পায় গোধূলি। উঁচু পাড় থিকা ঝপাং করে  লাফায়। গোধূলির হাত ধরে বলে চল। আকাশে গুরুম গুরুম ডাক ছেড়ে মেঘ চমকায়।  তালমায় ডুব- সাঁতার দেয় গোধূলি আর পাথারু। হুই ভাসি গ্যেইল পাথারু। অত জোরে আর সাঁতরাতে পারে না গোধূলি। হাত ছেড়ে  ভেসে যায় পাথারু। কোন দিকে যেন গুরুম গুরুম চমকায়, মেঘ না রাইফেল!  সেইটা যেন কোন সময়!  বুঝে উঠতে পারে না গোধূলি।  সময় গুলায় যায় এখন।


কায় ভাসি যায়! পাথারু না কালুয়ার ছাওয়াটা!  বেবাক মাইনষি মাটি ফুঁড়ে আসে। ডায়েন ডায়েন ছাড়া কিছু শুনবার না পায় গোধূলি।  ইটের টুকরা, পাথরগুলা গায়ে আসি পড়ে। পড়তেই থাকে।  চারিদিকে ফটফটা সাদা দুধের পারা অঙ ধরি বৃষ্টি পড়তেই থাকে,  পড়িতেই থাকে। তালমাটা দুধের নদী হয়া ভাসি যায়। সেই গড় থেকে পাথারুর পাওয়া পরীটার নাখান  হয়া ভাসি  যায়  গোধূলিও। চারিদিকে সাদা। আর  কুনো অঙ নাই। কিস্যু নাই। কুইন্ঠে ভাসি যায়! কায় জানে! অই দিকে চন্দর সুজ্জি ওঠে কি না কায় জানে! শুধু ভাসি যায় তালমা ধরি ধরি। ফোঁড়াগুলান টাটায়, টসটসায় ফোড়াগুলান।  য্যান আকাশে উঠি যায় পুন্নিমার চাঁদের নাখান। ভাসি যাতি যাতি গোধুলি নিশ্চিন্ত হয়। ফোঁড়াগিলা থাকি শিকড় গজাবার পারে নাই।

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...