পারিপার্শ্বিক জগতের সঙ্গে আমাদের প্রথম
পরিচয় ঘটে বিভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে৷ রিদম ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমরা
ক্রমশ প্রস্তুত হই নিজের জন্ম মুহূর্তের জন্য৷ ভ্রূণাবস্থায় আমাদের ঘিরে
থাকে একটা পরিবর্তনশীল পরিবেশ৷ তাপমাত্রা ওঠাপড়া, অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইডের তরল চলাফেরা,
মায়ের শরীরের রক্তচাপ ওঠানামা, হৃৎপিন্ডের শব্দ, মায়ের হাঁটাচলার ভঙ্গি, ঘুম জাগরণের
দোলাচলতা, এই সব কিছুর সঙ্গে ধীরে ধীরে আমাদের পরিচয় হয় ছন্দের মাধ্যমে, ভ্রূণাবস্থা
থেকেই ৷ জৈবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা
অন্তর্নিহিত ছন্দের মাধ্যমে একটি ভ্রূণ শিখতে চায় আশ্রয়৷ জন্মের পর তাই মায়ের পায়ের
আওয়াজ পেলেই চেনা ছন্দে শিশু শান্ত হয়, মায়ের বুকের কাছে আঁকড়ে থেকে হৃদয়ের নৈকট্যে
নিশ্চিন্তে ঘুম আসে, মায়ের গলার আওয়াজে কান্না থামে আর গুনগুন গানে আসে নিরাপত্তা৷
নানা রকম ছন্দের প্রতি মনোযোগী হওয়া আমাদের প্রথম সার্ভাইভাল ইন্সটিনক্ট, বেঁচে থাকার
সহজ পাঠ৷ তাই, সমাজ সভ্যতা দেশ কাল জাতি নির্বিশেষে শিশুদের শান্ত করার ছন্দ একই দোলনায়
দোলে, ঘুমপাড়ানিয়া গানের ছন্দে হুবহু মিল৷ এই ঘুমপাড়ানিয়া গানের প্রসঙ্গে আসব আবার,
পরে৷
চল্লিশ থেকে সত্তর লক্ষ্য বছর আগে, প্রাগৈতিহাসিক মানুষ যখন দু'পায়ে হাঁটতে শুরু করে, বিবনর্তনের
ইতিহাসে প্রথম, তাদের চলা বসা দৌড়, সমস্ত ব্যবহারের ছন্দ আশেপাশের বাকি প্রাণীদের থেকে
আলাদা হয়ে যায়৷ আলাদা হতে থাকে তাদের অস্তিত্বের শব্দ৷ দু'পায়ে হাঁটলে জঙ্গলের আগাছায়
যে শব্দ হবে, চারপেয়ে জন্তুর চলাফেরায় ঝোপেঝাড়ে তার থেকে অন্যরকম শব্দ উঠবে, তাই তো
স্বাভাবিক৷ এই বিভিন্ন শব্দের প্রতি কান পেতে মন দিয়ে শুনতে পারার ক্ষমতা খুব প্রয়োজনীয়
হয়ে পড়ল এই সময়ে৷ ধারেকাছে স্বজাতির ঘোরাফেরা নাকি হিংস্র কোনও প্রাণী, যে আমাকে খেতে
আসছে, নাকি শিকারযোগ্য কোনও প্রাণী, যাকে আমি খেতে পারি, এইসবের উপর নির্ভর করবে কে
কতদিন সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারবে৷ তাই, বহির্জগতের ছন্দ-শব্দ-তাল-লয়ের প্রতি নিপুণ শ্রুতিক্ষমতা
উদয় হল মানুষের মস্তিষ্কে৷ মনোযোগের পরিবর্তে কিছু পুরস্কার অবশ্য প্রাপ্য, তাই ছন্দ
বা তালের প্রতি একনিষ্ঠ মনোযোগীদের মস্তিষ্কে ক্ষরণ হতে শুরু করল এক ধরণের কেমিকাল,
যার নাম ডোপামিন৷ যে কোনও কিছুর প্রতি আসক্তি
থেকে আমাদের মস্তিষ্কে যা উৎপাদিত হয়, যার ফলে নেশা হয় এবং সে নেশা ছাড়ানো অতি
কষ্টকর, ডোপামিন সেই প্রজাতির কেমিকাল৷ অতএব, শব্দের প্রতি মনোযোগী হওয়ার জন্য শরীরকে
পুরস্কৃত করা শুরু করল শরীর নিজেই৷ আর প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার সুযোগ পেল তারাই, যাদের
ছিল শব্দ থেকে শব্দ ভেদের ক্ষমতা৷ ন্যাচেরাল সিলেকশান৷
কখনও ভিড় রাস্তার পাশে বেঞ্চে চুপচাপ একা
বসে থেকে দেখেছেন, অগণিত মানুষ, অচেনা অসম্পর্কিত মানুষ, রাস্তা পার হচ্ছেন একই তালে
তাল মিলিয়ে? গ্রামের বাড়ির উঠোনে দেখেছেন, তিন চারজন গোল করে ঘিরে দাঁড়ানো মানুষ ধান
কুটছেন নিঁখুত ছন্দে? কৃষকের লাঙ্গল যে ছন্দে মাটিতে নেমে আসে, ধান রোপণের যে সুনির্দিষ্ট
তাল, তার কোনও দেশকাল ভেদাভেদ থাকেনা, কামারের ঠুকঠাক, মাথায় কলসি বা কাঠ নিয়ে হেঁটে
যাওয়া ঘর ফিরতি মানুষ, পুকুরে জাল ফেলার ঝপ্, এই সবকিছু বাঁধা রয়েছে এক প্রাচীন জাগতিক
ছন্দে৷ জীবনের গানে৷ হাতে হাতে কাজ করে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতায় গোষ্ঠিবদ্ধ সমাজ
গড়ে তোলা নাকি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে এক বিরল পদক্ষেপ৷ এই সহযোগিতার জন্য প্রয়োজন
একই তালে পা ফেলে এগিয়ে যাওয়া৷ কেউ বেশি এগিয়ে গেলে সমুখে বিপদ আসতে পারে, তখন তাকে
বাঁচাবে কে? কেউ বেশি পিছিয়ে পড়লেও একই সমস্যা৷ তাই, একে অপরের গতি নির্ধারণ করে পথ
চলাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ এই গতি মেপে তা বজায় রাখার জন্য চাই ছন্দ, তাল, লয়৷ সেখান থেকেই
নাকি সঙ্গীতের জন্ম, মনে করেন এক দল নৃতত্ত্ববিদ৷ এই যে কাজের ছন্দ, তা একে অন্যকে
জানান দেওয়ার জন্যই কাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ সুর ধরে৷ সুরের মারফত সরাসরি দলকে
জানানো যাবে কখন পা ফেলবে, কখন থামবে, কখন ধান কুটবে, কখন কাঠে পড়বে কুড়ুল৷ সব সমাজেই
সংঘবদ্ধ যে কোনও কাজের সময়ে দেখা যায় মানুষ বেছে নিয়েছেন এক একরকম গান, তাদের বিশিষ্ট
সুর, ছন্দ৷ যে কোনও দেশেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সব সুরের দৃষ্টান্ত এখনও আবহমান৷
অন্য ভাষায় নদীর বা চাষের গান শুনলে, শ্রমের গান শুনলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, কী করে?
মানুষের শারীরিক গতিপ্রকৃতি থেকে যে ছন্দ বা সুরের উদ্ভব, তার একটাই ভাষা, জৈব-শারীরিক
ভাষা৷ যা ভৌগোলিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে থাকতেই ভালোবাসে৷ মানুষের শরীরের মাংসপেশীর কাজ
করার ক্ষমতা নির্ধারিত হয় ফিজিক্সের নিয়মে৷ ইলেক্ট্রিসিটি (স্নায়ু সঞ্চারিত) বা কেমিকালের
(হরমোন সঞ্চারিত) প্রভাবে পেশী সজাগ হয়, কাজ করে, এবং পরের কাজের জন্য প্রস্তুতির সময়
নিয়ে কিছুক্ষণ থিতু হয়৷ এই কাজ এবং কাজ মধ্যবর্তী বিরতি, এটাই জীবনের অন্তর্নিহিত ছন্দের
মূলে৷ এর থেকেই সমস্ত কাজকর্মে ঢুকে পড়ে সুগঠিত তাল৷ তারই প্রতিফলন শ্রমিকের গানে৷
শরীরের প্রক্রিয়া যখন সকলেরই এক, শ্রম চলবে একই তালে, শ্রমের গান বাঁধা হবে একই সুরে৷
এর আবার রকমফের হবে কেন?
সমস্ত প্রাণীর যেমন নিজের চারণক্ষেত্র নির্ধারণ
করার উপায় খুঁজতে হয়, মানুষেরও প্রয়োজন পড়ল স্থান নির্দিষ্ট করা৷ নিরাপদ গন্ডীর মধ্যে
যেন ঢুকে না পড়ে শিকারী হিংস্র প্রাণী, বা অন্য গোষ্ঠীর মানুষ৷ বিভিন্ন প্রাণীদের যেমন
নানা প্রকারের টেরিটরিয়াল ডাক, মানুষ সেই ভাবে তৈরী করল তাদের নির্দিষ্ট ডাক এবং শব্দ৷
এই শব্দ উৎপাদনের জন্য তারা ব্যবহার করা শুরু করল নিজেদের কণ্ঠ, প্রকৃতি থেকে পাথর,
কাঠ, মাংসের হাড় প্রভৃতির ঠোকাঠুকিতে সৃষ্টি হল নিরাপত্তার গান৷ সঙ্গে শরীরী ভঙ্গিমায়
অযাচিত প্রাণীদের দূরে রাখতে লাফালাফি, যার চলনে সংঘবদ্ধ ছন্দ৷ এর থেকেই শুরু হল নাচ৷
প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রতি সন্ধ্যায় এক জোট হয়ে একই সুরে তালে
নাচ গান করে আজও৷ দূর থেকে শুনে বাকিরা জানতে পারে, ওখানে ওরা আছে৷ প্রাণীরা বোঝে,
ওদিকে আর না যাওয়াই শ্রেয়৷ সঙ্গীতের বিবর্তনের আরও একটি থিওরি দিয়েছেন কিছু বিজ্ঞানী৷
নাচ গানের মাধ্যমে আকৃষ্ট হয় প্রণয়ী সাথী৷ যার প্রাণে যত সুর, তার জিন তত উন্নত, যার
বোধে যত ছন্দ, তার সঙ্গে জীবন কাটালে বিপদের সম্ভাবনা কম৷ যেভাবে পাখিরা গান গেয়ে আকৃষ্ট
করে সঙ্গীকে, হরিণের শিং ঠোকাঠুকি যুদ্ধজয়ে মেতে ওঠে হরিণী, খানিকটা সেরকমই৷
জন্মের শুরু থেকেই যে ছন্দের সঙ্গে পরিচয়,
সেই থেকেই কি ভাষার উৎপত্তি হল? নাকি ভাষা পেল বলেই মানুষ গান বাঁধতে শিখল? এই নিয়ে
মতান্তরের শেষ নেই বিজ্ঞানী মহলে৷ কেউ আবার মনে করেন, ভাষা বা সঙ্গীত দু'টোই মানুষের
বিবর্তনের বাই-প্রডাক্ট৷ কোনোরকমে হঠাৎ চলে এসেছে আমাদের জীবনে৷ সে তর্কে না যাওয়াই
ভালো৷ বরং দেখে নেওয়া যাক কোনটা কিসের আগে বা পরে আসতে পারে৷ সেই যে ঘুমপাড়ানি গানের
কথা বলছিলাম গোড়ার দিকে, তার শুরু হয় মায়ের বুকে শুয়ে গুনগুন শুনে৷ সব দেশে সব মায়েদের
গুনগুনের সুর একই থাকে৷ এর উৎপত্তি নাকি অন্যান্য প্রাইমেটদের একটি ডাক থেকে৷ বাঁদর
বা বনমানুষ জাতীয় প্রাণীরা জঙ্গলে চলাফেরার সময় আপন মনে একপ্রকার গুনগুন ডাক ডাকে৷
সারাক্ষণ একটা রিদম বজায় রেখে ডেকে যায় সারাদিন৷ দলের অন্য সদস্যদের জানিয়ে রাখার জন্য,
যে তারা পরস্পরের কাছাকাছি আছি৷ এই থেকেই নাকি মা-শিশুর মধ্যে বেঁধে বেঁধে থাকার প্রতুশ্রুতিময়
গুনগুনানি সুরের শুরু৷ শিশুকে মনে করিয়ে দেওয়া,
তুমি চেনা গন্ডিতেই রয়েছ৷ তার থেকেই ঘুমপাড়ানি
গান৷ এর পরবর্তী স্তরে, শিশু আর একটু বড় হলে, তার সঙ্গে শুরু হয় মায়ের টুকরো
টাকরা কথা৷ এই কথার সারবস্তু অবান্তর, যা শিশুর কানে যায় মূলত, তা' ওই কথা বলার সুর৷ নির্দিষ্ট ছন্দে বাঁধা সুরেলা মিষ্টি ওঠাপড়া৷ শিশুদের
সঙ্গে কথার ছন্দ, গবেষণা করে জানা গেছে, পৃথিবীর সব ভাষার সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রায়
এক নিয়মে গঠিত৷ একই রকম স্বরনিক্ষেপ, একই পিচ, মডিউলেশন৷ এই সুর-ছন্দের হাত ধরে শিশু
প্রথম আধো আধো কথা বলতে শেখে, শেখে কথোপকথনের রীতি, সামাজিক আদানপ্রদানের কৌশল৷ সব
সমাজে, সব দেশে৷ সুর এবং ছন্দের মধ্যে দিয়েই ভাষায় হাতেখড়ি৷ পারিপার্শ্বিক শব্দ থেকে
যে ভাষা এসেছে তার স্বপক্ষে আরও একটি উদাহরণ আসে ধ্বন্যাত্মক শব্দমন্ডলি থেকে৷ প্রতি
ভাষায় এইসব শব্দের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়৷ জলের
টুপটাপ, ঘোড়ার ক্ষুরের টগবগ, বৃষ্টির রিমঝিম, পাতার সরসর, এইসব শব্দ সরাসরি প্রকৃতি
থেকেই তুলে এনে ভাষায় বসানো৷ এর জন্য আলাদা করে কোনও আভিধানিক শব্দ চিহ্নিত নেই৷ যা
শুনছি আসেপাশে তাকে তার মাধ্যমেই প্রকাশ করা যায়, নিপুণ অনুকরণে৷ আর, খেয়াল করলে দেখা
যাবে, এইসব প্রাকৃতিক শব্দে অবশ্যই রয়েছে অন্তর্নিহিত ছন্দ৷
সুর তাল লয় ছন্দ সঙ্গীত ভাষা, কে কার আগে
বা পরে এলো এই দ্বন্দে না গিয়ে আমার প্রিয় একটি উক্তির কথা বলি৷ স্টিভেন ব্রাউন বলেছেন,
ভাষা বহির্জগতের বস্তু চিহ্নিকরণের জন্য প্রয়োজন, আর সঙ্গীত প্রয়োজন নিজের একান্ত অন্তর্জগতের
প্রকাশের জন্য৷ অন্তরে যে আবেগ জন্ম নেয়, তা ভাষায় প্রকাশ করতে আমরা প্রায় সকলেই বিফল
হই বারবার৷ শত চেষ্টাতেও, সহস্র শব্দ চয়নেও পুরোটা যেন বলে ফেলা সম্ভব নয়৷ প্রত্যেকটি আবেগের জন্য শব্দ হয়ত আছে, কিন্তু মৌখিক
ভাষা নেই! প্রত্যেক আবেগের জন্য শব্দও রয়েছে কি? তাই, আবেগ ভাষাপ্রাপ্ত হয় সঙ্গীতে৷
ভোর হলে মন কেমন করে ঠিক জানে আহির ভৈরব, রাত যখন চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত, মুনলাইট সোনাটা
নিঙড়ে আনতে পারে মনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা চুড়ান্ত আবেগ, যার কোনও লিখিত ডিকশনারি
নেই৷ এইভাবেই, হাজার হাজার ভাষায় শোক কাকে বলে, আনন্দের নাম কী, রাগ হলে কোন শব্দ,
প্রেমের প্রতিশব্দ আমাদের অজানা থাকলেও, নতুন দেশে গিয়ে চিনতে ভুল হয় না দুঃখের গান,
বা শান্তির সুর৷ এই নিয়েও গবেষণা হয়েছে, চলছে৷ আবেগের সুর আমরা সহজেই ধরে ফেলতে পারি,
ভাষা নির্বিশেষে৷
শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ পরিবেশ থেকেই কি সঙ্গীতের
জন্ম? বাহির পরিবেশের কোনও হাত নেই? আগে যে বলছিলাম ধ্বন্যাত্মক শব্দের কথা, তার কোনও
প্রতিফলন নেই কি সঙ্গীতে? খোলা জমিতে হাওয়া বয়ে যাবে যে গতি শব্দে, ঘন অরণ্যে কি তার
সুর বাজবে না অন্যরকম মর্মরে? অবশ্যই বাজবে, এবং তার প্রতিফলন স্পষ্ট হবে সেই ভৌগলিক
সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গীতে৷ তাই, আফ্রিকার সাহারাবাসীদের গানের সুরে মিলেমিশে যাবে
আরব বেদুইনের ধুধু সুর, গঙ্গার বুকে মাঝি যে গানে নাও ভাসায়, তার জল চলকে পড়বে অ্যামাজনের
প্যান্টানালে৷ আমরা সুর শুনে ভাবব কেবল, কী আজব মিল! মিল থাকবে যন্ত্রানুসঙ্গেও৷ একই
রকম গাছ যে সব অঞ্চলে, সেই কাঠ থেকে তৈরি বাদ্যযন্ত্র সুর তুলবে একই সুরে৷ শুকনো ফল,
বীজ পাতা দিয়ে তৈরি হবে পার্কাশান ছন্দ, মাসাই মারায়, মধ্যভারতে, ক্যারিবিয়ানে৷ আম
আঁটির ভেঁপু বাজিয়ে ঘরে ফিরবে দূরদেশী রাখাল বালক, ভিয়েতনামে বা বাংলায়৷ বাস্তুপরিবেশের
প্রভাব সমস্তরকম ব্যবহারিক প্রকাশেই দেখা যায়, সঙ্গীতের জন্মেও তার আংশিক দেখা পাওয়া
যাবে, এমনটাই তো কথা ছিল৷ যে কোনও প্রাণী তার পরিবেশের মধ্যে একপ্রকার নিহিত হয়ে থাকে৷
প্রকৃতিতে যা ঘটে সেই প্রাণীর শরীরে ও মনে তার প্রতিফলন হয়, ভাবনা চিন্তায় রেখাপাত
করে৷ মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়৷ মনে উদ্ভূত ভাবনাগুলি যখন ডানা মেলে প্রকাশ পেতে চায়,
ভাষায় বা গানে, গোড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশের উপস্থিতি নিঃশব্দে জারিত হয় সেই প্রকাশমাধ্যমে৷
এম্বোডিমেন্ট-এর বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া দুষ্কর- তবে গানে ছন্দে সুরে ভাষায় এম্বোডিমেন্টের
থিওরি নাকচ করার সাধ্য আমার নেই৷ যে কোনও প্রাণীর ব্যবহারিক গঠন নির্ভর করে তাদের শারীরিক
গঠনের উপর; শারীরিক গঠন নির্ভর করে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তাকে মাথায়
রেখে; এই জটিল অঙ্কের থেকে বেরিয়ে আসে সমগ্র প্রকাশ মাধ্যম- যেমন মানুষের ভাষা অথবা
সুর৷ যে প্রজাতির মানুষ যে প্রাকৃতিক অবস্থানে কাটিয়েছে হাজার হাজার বছর, প্রজন্মের
পর প্রজন্ম, তার কথায় এবং ভঙ্গিতে, সুরে এবং বাদ্যযন্ত্রে, জীবনে এবং যাপনে পারিপার্শ্বিক
পরিবেশের ছাপ সুস্পষ্ট৷
এই পুরো আলোচনাটি, বলাই বাহুল্য, সম্পূর্ণ
তাত্ত্বিক৷ এর কোনও প্রমাণ আমার হাতে নেই৷ এই মুহূর্তে কারুর হাতেই নেই৷ মাত্র কুড়ি
বছর আগে শুরু হয়েছে সঙ্গীতের বিবর্তনমূলক গবেষণা ও চিন্তাভাবনা, তাই, আমাদের একমাত্র
উপায় যৌক্তিক জল্পনা ও তথ্যভিত্তিক আদানপ্রদান৷ চিন্তাভাবনার বাইরে আর কতটুকুই বা করার
আছে আমাদের! জীবনটাই তো কাগজে লেখা কার্ডিওগ্রাফিক ছন্দের ওঠাপড়া, ভাবনাতেও তরঙ্গের
সাইনুসয়ডাল কার্ভ৷ কিছু থাকা এবং কিছু না থাকার আসা যাওয়াতেই ছন্দের সৃষ্টি, সেই ছন্দ
ভেঙে সঙ্গীত৷
কিছু না থাকার পর যতক্ষণ কিছু ফিরে আসছে
আবার, ততক্ষণই৷
চমৎকার
ReplyDeleteচমৎকার
ReplyDeleteভালো লেখা। সবই ডোপামিনের মায়া।
ReplyDeleteকী ভালো ঝরঝরে লেখা! এবিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাই। নন-টেকনিক্যাল হলে খুবই ভালো হয়।
ReplyDeleteBhalo laglo. Ei bishoye aro porar icche thaklo.
ReplyDelete