১
‘লিবেহ্তে,
এগালিতে, ফ্রাতাহ্নিতে’—ফরাসী
বিপ্লবের এই অতিপরিচিত মূলমন্ত্রটির শুরুতেই রয়েছে 'লিবেহ্তে'
বা
‘স্বাধীনতা’-র
উদ্ঘোষ। মনে রাখা ভালো, ইয়োরোপের
ইতিহাসে, ফরাসী
বিপ্লবের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। হয়তো খুব একটা অত্যুক্তি হবে না,
যদি
বলি যে, পাশ্চাত্য
সভ্যতায় যাকে মডার্নিজম বা আধুনিকতাবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে,
ফরাসী
বিপ্লবের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তার বীজ, যা পরবর্তী শতকগুলিতে ক্রমশ পল্লবিত হয়ে
মহীরুহের আকার ধারণ করবে। আর স্বভাবতই, আধুনিকতার সেই ধারণার মধ্যে ওতপ্রোতভাবে
মিশে থাকবে এক স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি। আধুনিকতা বা মডার্নিটি শুধু একটি বিশেষ
সাংস্কৃতিক আন্দোলনই ছিল না, বরং
তা বদলে দিচ্ছিল মানুষের সমাজ ও রাজনীতি-সংক্রান্ত ধ্যানধারণা,
বদলে
দিচ্ছিল তার মনন ও চিন্তনের চিরপরিচিত অভ্যাসগুলিকে,
তার
জ্ঞানবিজ্ঞান এবং তার বিশ্বদৃষ্টিকে। আর, এই
সমস্তকিছুর গোড়ায় নিহিত ছিল মানুষের স্বাধীনতার ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার দুর্মর
তাগিদ। স্বাধীনতা মানে শুধু রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নয়,
ব্যক্তির
স্বাধীনতা, তার
চেতনা ও জ্ঞানের স্বাধীনতা। এবং, সেই
স্বাধীনতার সীমাটিও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল মানুষের কাছে।
মানুষ যে মূলত
স্বাধীন, এই
কথাটা আমরা কতকটা স্বতঃসিদ্ধের মতোই মেনে নিই। এই যে,
আমরা
আমাদের ইচ্ছেমতো হাঁটছি, খাচ্ছি,
ঘুমোচ্ছি—এ
কি স্বাধীনতা নয়? এ-কথা
ঠিক যে, আমাদের
স্বাধীনতাকে আমরা খানিকটা কাট-ছাঁট করে নিই,
নিতে
বাধ্য হই, পরিবার,
গোষ্ঠী
বা সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে। প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও,
আমরা
যেখানে-সেখানে থুতু ফেলি না, প্রবল
গ্রীষ্মেও ন্যাংটো হয়ে ঘুরি না রাস্তায়, চণ্ডরাগে
প্রতিপক্ষকে নিকেশ করে দেওয়ার অদম্য বাসনাও শেষতক দমন করি শাসনের ভয়ে। কিন্তু,
আমাদের
মনে সদাসর্বদা এই ধারণাটি বদ্ধমূল যে, ব্যক্তি-হিসেবে,
ইচ্ছে
করলে আমরা এই সমস্ত কাণ্ডই ঘটিয়ে ফেলতে পারি। করি না,
সে
আমাদের স্বাভাবিক সংস্কার শুধু।
একটু ভেবে
দেখলেই, বিষয়টা
আর তত সহজ থাকে না। প্রথমত, আমাদের
এই ইচ্ছেগুলো নির্ভর করছে আমাদের পরিপার্শ্বের ওপর,
আমাদের
বেড়ে-ওঠার ধরণধারণ, শিক্ষা-দীক্ষা
ও রুচির ওপর। এই পরিপার্শ্বের খানিকটা পারিবারিক,
খানিকটা
আবার সামাজিক। বাবা-মায়ের রুচি, শিক্ষা,
আর্থিক
অবস্থা যেমন সন্তানের ইচ্ছেকে নিয়ন্ত্রিত করে,
তেমনি
তা নিয়ন্ত্রিত হয় যে-দেশে, যে-সমাজে
সে বড় হয়ে উঠেছে, তার
দ্বারাও। ফলে, তার
ইচ্ছেগুলো যে পূর্ণত তার নিজেরই, সেগুলো
যে সর্বার্থেই আত্মনিয়ন্ত্রিত, এমন
কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আবার, আমাদের
ইচ্ছে যদিও বা আত্মনিয়ন্ত্রিত হয়, তা
পূরণ করার ক্ষমতা আমাদের আয়ত্তাধীন না-ও হতে পারে। স্টেশনের বাইরে যে-ছেলেটি
ভিক্ষে করছে, দোকানে
সাজানো কেক-বিস্কুটের প্রতি তার লোভটা একান্তই তার নিজের,
কিন্তু
তা পূরণ করার কোনো উপায় তার হাতে নেই। অর্থাৎ,
রাষ্ট্রিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-পারিবারিক
এবং এরকম আরো নানান নিগড়, প্রতিমুহূর্তে,
আমাদের
ইচ্ছেকে অথবা ইচ্ছাপূরণের উপায়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। নিয়ন্ত্রণ করছে ইচ্ছের
স্বাধীনতা। তাহলে, মানুষ
যে স্বাধীন, এ-ব্যাপারে,
আমরা
স্থিরনিশ্চিত হচ্ছি কী করে?
দ্বিতীয়
সমস্যাটা আরো গভীর। আমাদের চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া,
এমনকী
ভাবনা-চিন্তার স্বাধীনতাও প্রকৃতিনির্দিষ্ট সীমার বাইরে যেতে পারে না। যে-মানুষ
জন্মান্ধ, তার
দেখার স্বাধীনতা হরণ করেছে স্বয়ং প্রকৃতি। যে-মানুষ জড়বুদ্ধি,
তার
ভাবনাচিন্তা প্রসারিত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রাস্তায়,
প্রকৃতির
নিয়ম মেনেই। এই যে, সুখাদ্যের
ঘ্রাণে আমাদের ক্ষুধার উদ্রেক হল, সে-ও
এক উৎসেচকের ক্ষরণমাত্র, যার
মূলে রয়েছে শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার অলঙ্ঘ্যনীয় নিয়ম। সেই নিয়মের উৎস খুঁজতে খুঁজতে
হয়তো কখনও আমরা পৌঁছে যাব ডি এন এ-র কাঠামোয়,
পড়ে
ফেলব তার প্যাঁচানো গড়নের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গূঢ়লেখ। কিন্তু সেখানেই তো শেষ নয়!
কীভাবে, কতরকম
ঘটনার আকস্মিক সমাপতনে, অমন
এক অদ্বিতীয় প্রোটিন-অণুর উদ্ভব ঘটল পৃথিবীতে,
কীভাবে
সে সক্ষম হল নিজেই নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টিতে,
তার
রহস্য আজও পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি। আজও নির্দ্বিধভাবে বলা সম্ভব নয়,
ঠিক
কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই ব্রহ্মাণ্ড, অথবা
কী তার আসল চেহারা। কার্যকারণ-সম্পর্কের এক অন্তহীন শৃঙ্খল থেকে জন্ম-নেওয়া এই
সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যতক্ষণ না-মিলছে, ততক্ষণ
পর্যন্ত, মানুষ
কি প্রকৃতির হাতে নিছক কলের-পুতুলমাত্র নয়?
তবুও,
কী
আশ্চর্য দেখ! মানুষ স্বভাবতই, তার
প্রাত্যহিক জীবনযাপনে, নিজেকে
স্বাধীন বলে ভাবে! হয়তো, এই
ভাবনাটাই তাকে সচল থাকতে সাহায্য করে। অন্যথায়,
সে
কি পারত এক বিপুল, আত্মধ্বংসী
হতাশার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে?
২
আধুনিকতার
সবচেয়ে বড় লক্ষণ বোধহয় এই যে, তা
সবরকম প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নায়িত করার প্রণোদনা জোগায়। শিল্পসাহিত্যে যাঁদেরকে
আধুনিকতাবাদের অগ্রপথিক বলে মনে করা হয়, সেই
রোম্যান্টিকরা, শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী
যান্ত্রিক সভ্যতার উদ্দেশ্যে একরাশ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। এবং,
তার
বিপ্রতীপে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এক আদিম প্রাকৃতিক চেতনাকে। কিন্তু মানুষের
জ্ঞানবিজ্ঞান, এর
ঠিক উল্টোদিকে হেঁটে, আরো
গভীরভাবে বুঝতে চেয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে। যদিও,
সেই
প্রয়াসের পেছনে ছিল প্রকৃতির একচ্ছত্র আধিপত্যকে খর্ব করার,
তার
আপাত-খামখেয়ালকে নিয়মের বাঁধনে বেঁধে, প্রকারান্তরে
তার সমকক্ষ হয়ে ওঠার তাগিদ। সে-ও এক স্বাধীনতার ঘোষণা বই কী!
শিল্পসাহিত্য
এবং বিজ্ঞানের যাত্রাপথ স্বভাবতই আলাদা। শিল্প মানুষের প্রাতিস্বিক চেতনার,
তার
একান্ত সাবজেকটিভ উপলব্ধির সংহত প্রকাশ। নিজের প্রাতিস্বিক উপলব্ধিগুলিকে যথাসম্ভব
স্বাধীনভাবে, তাদের
আদি ও অকৃত্রিম রূপে, উপস্থাপিত
করার ইচ্ছেই, যেকোন
শিল্পের প্রস্থানভূমি। যেকারণে, শিল্পের
রসাস্বাদন ও তজ্জনিত আনন্দ, একান্তভাবেই
পাঠকের বা শ্রোতার বা দ্রষ্টার চেতনাসাপেক্ষ। অন্যদিকে,
বিজ্ঞান
চায় যেকোন প্রাতিস্বিক অভিজ্ঞতাকে একটি নৈর্ব্যক্তিক নিয়মের ছকে বেঁধে ফেলতে,
তাকে
সর্বজনগ্রাহ্য ও মান্য করে তুলতে। সেখানে অধিকারভেদ খাটে না। দর্শন তথা
সমাজনীতি-রাজনীতির অবস্থান, মনে
হয়, এই দুই চরমসীমার
মধ্যবর্তী আলো-আঁধারিতে, সাবজেকটিভ
ও অবজেকটিভ সত্যের নিরসনহীন নিত্যবিরোধে।
হতে পারে,
মানুষের
শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের এই দ্বিবিধ গতিপ্রকৃতির পিছনে,
তার
অস্তিত্বের দুটো ভিন্ন দিক লুকিয়ে রয়েছে। একদিকে,
যখন
সে কেবলমাত্র নিজেকে দেখছে, নিজের
চেতনার আলোয়, তখন
তার সামনে কোনো বাধা নেই, অন্তরায়
নেই—নিজের মনোজগতের সাপেক্ষে সে স্বরাট, স্বতন্ত্র,
ও
স্বাধীন। অন্য কারোর হস্তক্ষেপ, সেখানে,
তার
চোখে পড়ে না। তার নিজের চেতনার রঙেই যে পান্না সবুজ হয়েছে,
এ
নিয়ে কোনো ধন্দকে প্রশ্রয় দিতে সে নারাজ। এ হল,
নিজের
সম্পর্কে মানুষের প্রাতিস্বিক অনুভূতি, তার
সাবজেকটিভ অবস্থান। অন্যদিকে, যখন
এই স্বরাট ও স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাকে সে স্থাপন করছে বাহ্যজগতের সাপেক্ষে,
তখন
সে নিজেকে এক অন্তহীন কার্যকারণসূত্রে গ্রথিত হতে দেখছে। সে লক্ষ করছে,
এক
বিরাট, সর্বব্যাপী
জালের মধ্যে, সে
একটি সামান্য গিঁট ছাড়া আর কিছু নয়। জালের প্রত্যেকটি গ্রন্থি ও দড়ি যেমন
একে-অপরের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, সে-ও
ঠিক সেইভাবে তার পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র-প্রকৃতি-মহাবিশ্বের সঙ্গে অনন্যোপায় হয়ে
জড়িয়ে রয়েছে, যেখানে
তার স্বাধীন ইচ্ছার মূল্য নিতান্তই সীমিত,
এবং
শর্তসাপেক্ষ। এটা, বাহ্যজগতের
সাপেক্ষে, মানুষের
নৈর্ব্যক্তিক, অবজেকটিভ
অবস্থান। স্বাধীন ইচ্ছা (ফ্রী উইল) ও নিয়তিবাদের (ডিটারমিনিজম) পারস্পরিক বিরোধকে,
এই
ভাবেই, প্রাতিস্বিক
ও নৈর্ব্যক্তিক চেতনার দ্বান্দ্বিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন তলস্তয়,
তাঁর
'যুদ্ধ ও শান্তি'
উপন্যাসের
উপসংহারে।
যেহেতু
নৈর্ব্যক্তিক সত্যের অনুসন্ধানকেই বিজ্ঞান নিজের লক্ষ্য বলে মেনেছে,
তাই,
কার্যকারণ-সম্পর্কের
শৃঙ্খলটিকে সে ক্রমাগত সম্প্রসারিত করতে থাকে। তার কাছে,
নৈর্ব্যক্তিক
সত্যের কাছে পৌঁছনোর সেটাই একমাত্র উপায়। আর,
সেই
জটিল ঠাসবুনোটের মধ্যে দিয়ে, যে-জগতের
ছবি আমাদের সামনে ফুটে ওঠে, তা
একান্তভাবেই নিয়তিবাদী—ডিটারমিনিস্টিক। বিষয়টার মধ্যে একটা স্ববিরোধ আছে। যেকোন
বৈজ্ঞানিক সত্যের অন্বেষণ শুরু হয় এই বিশ্বাস নিয়ে যে,
মানুষের
চিন্তাশক্তি, তার
যুক্তিকাঠামো, তার
কল্পনা ও সম্ভাবনা—এই সমস্তকিছুই মানুষের
স্বেচ্ছাধীন। মানুষের সামান্য অঙ্গুলিহেলনেই তারা ক্রিয়াশীল হয়,
ও
তাকে সাহায্য করে সত্যের দোরগোড়ায় পৌঁছতে। অথচ,
সমস্ত
অন্বেষণের শেষে, যে-সত্য
সে আবিষ্কার করে, তা
এক অলঙ্ঘ্যনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম, মানুষ
নিজেই যার অধীন।
তাহলে,
যে-চিন্তাশক্তি
ও স্বজ্ঞাকে মানুষ স্বাধীন বলে ভাবতে অভ্যস্ত,
তা
কি সত্যিই স্বাধীন? এবং
তার মাধ্যমে, আমাদের
পরিপার্শ্ব-সম্বন্ধে যে-সিদ্ধান্তে বা জ্ঞানে আমরা উপনীত হচ্ছি,
তা
কি বাস্তবিকই অকাট্য ও নৈর্ব্যক্তিক? না
কি যেভাবে, জলের
প্রতিসরণের ক্রিয়ায়, মাছের
চোখে ধরা পড়ে এক কৌণিক, শঙ্কু-আকৃতির
পৃথিবীর ছবি, সেভাবেই,
আমরাও
এক গভীর প্রমাদের শিকার, জন্মাবধি?
৩
অন্নদাশঙ্কর
রায়ের অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাস ‘সত্যাসত্যে’র কেন্দ্রীয় চরিত্র বাদল,
তার
সুধীদা-কে উদ্ধতভাবে জিজ্ঞেস করেছিল—“ফ্রী উইল না ডিটারমিনিজম?”
যদিও, সে নিজে এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌঁছতে পারেনি কখনই। বরং,
অস্তিত্ববাদী সংশয়ের চোরাবালিতে গ্রস্ত হতে-হতে, নিজেকে অনিবার্য ধ্বংসের দিকে
ঠেলে দিয়েছিল।
প্রকৃতপ্রস্তাবে,
এই জটিল প্রশ্নের কোনো সরল ও একরৈখিক উত্তর আদৌ দেওয়া সম্ভব কি না,
তা
আমার জানা নেই। কিন্তু, মানুষের
সভ্যতার ধারাবাহিক বিবর্তনের (অগ্রগতি, বা
প্রগতি, এই
শব্দগুলিকে ইচ্ছাকৃতভাবেই পরিহার করলাম) দিকে নজর ফেরালে,
মনে
হয়, এই দুই বিপরীতমুখী
প্রবণতার টানাপোড়েনই তার মূল চালিকাশক্তি। একটি নিয়তিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে
আটকে-পড়া মানুষ, সেই
ব্যবস্থার অস্পষ্ট নিয়মগুলোকে তার
স্বজ্ঞার সাহায্যে, তার
যুক্তিকাঠামোর সাপেক্ষে, বুঝে নিতে চাইছে;
আর,
তারপর,
সেইসব
নিয়মের ফাঁকফোকর দিয়ে, যতদূর
সম্ভব প্রসারিত করে নিচ্ছে নিজের স্বাধীনতার সীমা—এ যাবৎ মানুষের যা-কিছু অর্জন,
তাকে
যদি এইভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাই, তাহলে
কি খুব ভুল করব?
মানুষের লড়াই,
প্রথমত,
প্রকৃতির
বিরুদ্ধে। প্রকৃতি তার শারীরিক ক্ষমতাকে একটি নির্দিষ্ট সীমায় বেঁধেছে,
তার
আয়ুকে বেঁধেছে মৃত্যু দিয়ে, সর্বোপরি,
তাকে
এনে ফেলেছে এমন এক জগতে, যেখানে
সমস্ত ঘটনার পিছনে রয়েছে কার্যকারণ-সম্পর্কের এক অন্তহীন শৃঙ্খল। যদিও মানুষ জানে
যে, এ এক অসম যুদ্ধ,
তবু
নিজের ক্ষমতার প্রকৃতিনির্দিষ্ট সীমাকে সে অতিক্রম করতে চায়,
এমনকী,
অস্বীকার
করতে চায় মৃত্যুর অনিবার্যতাকেও। প্রকৃতির নিয়মতন্ত্রের বিপরীতে,
সে
কায়েম করতে থাকে তার নিজস্ব নিয়মের কাঠামো—তার জ্ঞানবিজ্ঞান,
তার
প্রযুক্তি, তার
সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার। আবার, তার
স্বনির্মিত কাঠামোগুলোই যখন তার স্বাধীনতার পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে,
তখন
সে খুঁজে নেয় নতুন কাঠামো, নতুন
নিয়ম—স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, ধনতন্ত্রের
বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্র, পুরুষতন্ত্রের
বিরুদ্ধে নারীবাদ, ধর্মের
নিঃশর্ত সমর্পণের বিরুদ্ধে যুক্তির কুঠার,
ঈশ্বরের
বিরুদ্ধে মানুষ, কিংবা
মানুষের বিরুদ্ধে ঈশ্বর, নিউটনীয়
দেশ-কালের বিপরীতে আপেক্ষিক দেশ-কালের ধারণা। প্রকৃতির চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের
বিরুদ্ধে এটাই মানুষের ধারাবাহিক অন্তর্ঘাত।
হতে পারে,
এ
সবই মানুষের বিভ্রমমাত্র, তার
স্বকপোলকল্পিত অহং-এর আস্ফালন। হতে পারে, এর
পিছনেও রয়েছে কোনো দুর্নিরীক্ষ্য প্রাকৃতিক
নকশা, কোনো
গ্র্যান্ড ডিজাইন। তবু, নিজের
চেতনাকে স্বাধীন বলে ভাবার এই নাছোড় প্রবণতাই,
মানুষের
বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ, তার
আপাত-অর্থহীন অস্তিত্বকে অর্থময় করে তোলার একমাত্র হাতিয়ার।
আত্মহত্যার স্বাধীনতা পেয়ে ধন্য।
ReplyDelete