লুই আরাগঁ –
It’s already too late to learn how to
live,
Let our hearts
mourn together at night.
For the least little song we pay with sadness
For each thrill
we pay with regret
Even a sweet melody we pay with weeping.
There is no
happy love.
প্রতিবছর আমরা এই ১৫-ই আগস্টের দিনটিতে যথেষ্ট পরিমাণ
বেলপাতা-ফুল-পাঁজি-বাতাসা নিয়ে স্বাধীনতার গল্প শুনি। সেদিন মনটাও হয়তো বা একটু
উড়ুক্কু থাকে। আমরা সেই ঘোরের মাঝে স্বাধীনতার লগ্নের বড়ো বড়ো নায়কদের –
গান্ধী-নেহরু-জিন্না-প্যাটেল-নেতাজীর গল্প শুনতে থাকি। স্বাধীনতার গল্প শোনার
ফাঁকে স্বাধীনতার লগ্ন কিভাবে জন্ম নিল, কিভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ
স্রেফ অসমান দু-টুকরো হয়ে ধরাধামে আত্মপ্রকাশ করলো, কীভাবে স্বাধীনতাকে রক্ষা করার
জন্য সমস্ত মানুষের ভোটের যন্ত্র, মন্ত্র এবং অধিকার তৈরি হল – এসবকিছুও শুনি
আমরা, শুনতেই থাকি। বিভিন্ন রস, স্বাদ এবং রঙের যৌগপদ্যে নতুন নতুন ধারায় এবং
বিভঙ্গে জমে উঠতে থাকে দেশ, জীবন, স্বাধীনতা আর আমাদের অস্তিত্বের যাত্রাপালা। আমরা
সাধারণত এর সাথে মানসিক একাত্ম হয়ে পড়ি প্রায় সবসময়েই, অবশ্য কখনো distant observer হয়েও থাকতে পারি। সবমিলিয়ে গণতন্ত্রের এক
জমাটি “জনতা” হিসেবে আমরা, বাখতিনের ভাষায়, carnivalesque / carnivalized
literature-এর পাঠ নিতে অভ্যস্ত হতে থাকি। কিন্তু বাখতিন যে
“সাবভার্সন” দেখেছিলেন জনতার এই আননন্দমুখর সৃজনে সে সৃজন বাখতিনের প্রায় ১০০ বছর
পরে লুঠ হয়ে যায় ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছে, রাষ্ট্রের হাতে। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের
আধুনিক চেহারায় এবং চলনে কার্নিভালের পরিবর্তে হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের “নির্মিত” জনতার উৎসব।
ভারতভাগের ৭১ বছর পার করে এসে রাষ্ট্রও তো বড়ো আকাঙ্ক্ষা করে এমনটাই যেন থাকি
আমরা।
শঙ্খ ঘোষ কি এরকম কোন সম্ভাবনা, এরকম কোন মুহুর্তের কথা ভেবেই আমাদের সচকিত
করেন –
আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব
আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব
…..
আমাদের এই তীর্থে আজ ভেঙে পড়ার উৎসব
তাকিয়ে আছে হাজার মাঠ গহ্বর
বিনাশ আনন্দের উৎসারের প্রতীক্ষায়
ঝলসে ওঠে আকাশমুখী চিমনি
…..
আমাদের এই তীর্থে ঘোর উৎসব
আমাদের এই তীর্থে শেষ উৎসব
একজন সার্বভৌম নাগরিক, একজন ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে শিখলেই গৌরি লঙ্কেশ বা
পানেসার বা কালবুর্গি হয়ে ওঠার বিপজ্জনক সম্ভাবনা ক্রমশ খুলতে থাকে। এমনকি “হিট
লিস্ট”-এ থাকেন গিরীশ কার্নাডের মতো ব্যক্তিত্ব। আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান পরিধির
মধ্যে এতটা জায়গা আমরা দিই কি করে? প্রত্যাশা করাও বড্ডো অনুচিত। যখন আনন্দমুখর
উৎসবের প্রকাশকে সাফদার হাসমির মতো কেউ রাস্তায় সমস্ত মানুষের সাথে মিশিয়ে দিতে
চান, চান ভাগ করে নিতে চান প্রতিজ্ঞাঋদ্ধ প্রত্যয়ে তখন তাঁর দোজখ যাত্রা ছাড়া আর
কোন রাস্তাই বা খোলা থাকে? কারণ, ব্যক্তি কথা বলছে, সমষ্টিও কথা বলছে। কথা বলছে
মানুষের নিজের জীবন-জগৎ-যাপন নিয়ে। এ এক সর্বনেশে পরিস্থিতি। তাই আমরা জনতাই থাকি,
কার্নিভালের সুখে মাখামখি হয়ে থাকি। শঙ্খ ঘোষ তো কবেই নিজেকে এবং আমাদেরকে
বলেছিলেন –
তরল আগুন ভরে পাকস্থলী
যে-কথাটাই বলাতে চাই বলি
সত্য এবার হয়েছে জমকালো।
গোলায় যদি ঝুলিয়ে দাও পাথর
হালকা হাওয়ায় গন্ধ সে তো আতর
তাই নিয়ে যাই অবাধ জলস্রোতে –
…….
এ-দুই চোখে দেখতে দিন বা না দিন
আমরা সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন
আকাশ থেকে ঝোলা গাছের মূলে।
স্বাধীনতার ঠাসবুনট গল্পের কি একটিই আখ্যান? একটি বয়ান? একটিই শরীর?
যাত্রাপালা কি একভাবেই অভিনীত হয়? প্রতিটি অভিনয়ের সাথে সাথে তো নতুন উপাদান, নতুন
ভঙ্গিমা তৈরি হয়। এভাবেই আমাদের রুধির-স্নাত স্বাধীনতার চলমান জীবনপ্রবাহ বেঁচে
থাকে।
গল্পের ওপরে গল্প। আখ্যানের পরে আখ্যান, অসংখ্য চরিত্র, অগনণ মূত্যু,
সংখ্যাতীত নারীর শরীর (তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়া), টুকরো হয়ে যাওয়া
জমি-জিরেত-পরিবার-আত্ম-দেশের ভূমি, হাজারো হাজারো নামগোত্রহীন শববাহী ট্রেনের যাত্রা,
ক্ষমতার স্তরে স্তরে আরো বৈভব আরো মাৎসর্য্য – এসব নিয়েই তো স্বাধীনতার নির্লজ্জ
বা অবগুণ্ঠিত কাহিনী।
তুমি তো জানো,
জন্মভূমি আজ ছিন্নমস্তা; তার উলঙ্গ অভুক্ত দেহের ওপর
হাজার নরমাংসলোলুপ শ্বাপদেরা
তোমার শপথ, স্বপ্ন, ভালোবাসা, সবকিছুকে আড়াল করছে।
এমন কি তার হাতের মুঠোয় যে লাল পতাকাটা শক্ত ক’রে ধরা আছে
সেখানেও ভয়াবহ কুয়াশা, কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। (বীরেন্দ্র চট্টোপাধায়)
এই ছিন্নমস্তা জন্মভূমির কাহিনী, আখ্যান, রক্ত-স্নাত কসাইখানা যার নাম হতে
পারে রাষ্ট্র, মানুষের ওপরে মানুষের ঢিবি করে রাখা লাশ – এসবকিছুর সালতামামি নেবার
মাহেন্দ্রক্ষণ দরজায় কড়া নাড়ছে। তখনই তো আবার শুনবো উদার সুরে “সারে জঁহাসে
অচ্ছা”, মন ভরিয়ে দেবে “ऐ मेरे वतन्
के लोगों / ज़रा आँख्
में भर् लो
पानी / जो
शहीद् हु हैं
उनकी
ज़रा याद् करो क़ुरबानी।”
ज़रा याद् करो क़ुरबानी।”
তখন আরেক কবি মাতৃভূমির স্বপ্ন নিয়ে একটি অন্য চিত্র আঁকবেন –
এখন আমি বলিষ্ঠ তুলির টানে
একটা নতুন শিশুর মুখ আঁকবো
আর ঘুমন্তদের ডেকে বলবো
শহীদদের সেই উজ্জ্বল স্বপ্নের কথা –
যে স্বপ্ন দেখতে কোনোদিন ঘুমোতে হয় না।।
সেসময়েই কোন একজন কবি হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে উঠে আসা আগ্নেয় প্রক্ষোভ নিয়ে
রচনা করবেন –
রক্তমাখা দ্রোণফুল পড়ে আছে ঘাতকের থাবার তলায়
ওই ফুল একদিন ফুটেছিল জ্যোৎস্নায়, কবিতায়
তাহার মায়ের স্নেহের ছায়ায়। (সনৎ দাশগুপ্ত)
এও তো আরেক “কুরবানি”-র কাহিনী, তবে এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্ট্রের যুদ্ধ
নয়। দেশের মানুষের শোণিত-সিক্ত জীবন বনাম রাষ্ট্রের খতম-যুদ্ধের কাহিনী।
গায়ত্রী স্পিভাকের লেখা, ১৯০০০ বার রেফারড, প্রবন্ধ (পরে পুস্তক হয়ে প্রকাশিত)
“Can the Sublatern Speak”-এ স্পিভাক মন্তব্য
করছেন – “The subaltern cannot speak. There is no virtue in global
laundry lists with ‘woman’ as a pious item.” তিনি তাঁর আত্মীয়
ভুবনেশ্বরী দেবীর আখ্যান চিরে চিরে দেখিয়ে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। এ সিদ্ধান্তে
পৌঁছনোর পথে তিনি ফরাসী দার্শনিক ফুকো এবং দেলুজের “epistemic violence” তথা জ্ঞানতাত্ত্বিক হিংসা, উপনিবেশিক ভারতের মতো ভিন্ন সাংস্কৃতিক
পটভূমিতে জন্ম নেওয়া জ্ঞান ও সত্যের নির্মাণ কি করে “universal” জ্ঞানের কাঠামোর মধ্যে নৈতিকভাবে আত্মসাৎ করে নেওয়া যায় ইত্যাদি প্রসঙ্গকে
মার্ক্সীয় এবং দেরিদীয় প্রেক্ষিত থেকে সমালোচনা করেছেন। নতুন ভাবনার যাত্রাপথ
নির্মাণ করেছেন। দুটি প্রসঙ্গ এসেছে ওপরের উদ্ধৃতিতে – প্রথম, সাবঅল্টার্ন বা
নিম্নবর্গের মানুষ তাদের নিজেদের কথা বলতে পারেনা; দ্বিতীয়, “global
laundry lists”এ নারীরা কোন পবিত্র সামগ্রী নয়। আপাতত সাবঅল্টার্নদের
স্বর আদৌ আছে বা রেপ্রেসেন্ট করা সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে একটুখানি কথা বলবো। পরে
আমাদের স্বাধীনতা ও নারী নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করা যাবে।
সত্যিই কি সাবল্টার্নরা নিজেদের রিপ্রেসেন্ট করতে বা কথা বলতে পারেনা (এখানে
নারীর প্রসঙ্গ ঊহ্য রাখলাম)? “আনন্দমঠ” পড়লে এরকম মনে হওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক
নয়। নামগোত্রহীন সন্তান সেনাদের (সন্যাসী বিদ্রোহীদের মাঝে শুধু ভবানন্দ,
ধীরানন্দ, জীবানন্দ, মহেন্দ্র কিংবা সত্যানন্দের মতো অগ্রণী পুরুষদের কন্ঠনিঃসৃত
সংলাপ শোনা যায়। যে অসংখ্য বিদ্রোহী – শান্তির বক্তব্য অনুযায়ী গড়ে “বিশ পঞ্চাশ
হাজার” সন্তান সেনা থাকে – তারা ভাষ্যহীন, কণ্ঠহীন, স্বরহীন। সন্তান সেনাদের
নেতৃত্ব ভবানন্দ বলেন – “আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল,
মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্তও যায়। এ নেশাখোর নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি
হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?”
এরপরে মহেন্দ্রের সাথে ভবানন্দের কথোপকথনে আসে ইংরেজ এবং মুসলমানদের
প্রতিতুলনা –
“ধর, এক ইংরেজ প্রাণ গেলেও পলায় না, মুসলমান গা ঘামিলে পলায় – শরবৎ খুঁজিয়া
বেড়ায় – ধর, তার পর, ইংরেজদের জিদ্ আছে – যা ধরে, তা করে, মুসলমানের এলাকাড়ি।
টাকার জন্য প্রাণ দেওয়া, তাও সিপাহীরা মাহিয়ানা পায় না। তার পর শেষ কথা সাহস –
কামানের গোলা এক জায়গায় বই দশ জায়গায় পড়বে না – সুতরাং একটা গোলা দেখে দুই শ জন
পলাইবার দরকার নাই। কিন্তু একটা গোলা দেখিলে মুসলমানের গোষ্ঠীশুদ্ধ পলায় – আর
গোষ্ঠীশুদ্ধ গোলা দেখিলে ত একটা ইংরেজ পলায় না।” এত প্রাঞ্জল এ বিবরণ যে পাঠক
নিরপেক্ষভাবে এর আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু ইতিহাস কি এমনটাই বলে? সুপ্রকাশ রায়ের অসীম পরিশ্রমধন্য ১৯৬৬ সালে
প্রথম প্রকাশিত বই “ভারতের কৃষ্ক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম”-এর পাতায় পাতায়
এর “আনন্দমঠ”-এর বিপরীত ভাষ্য বিধৃত আছে। সন্যাসী, ফকির, নিপীড়িত হিন্দু-মুসলমান
ভূমিহারা, সহায়সম্বলহীন কৃষক সম্প্রদায় ইংরেজ শাসন, কেবলমাত্র ইংরেজ কুঠিয়ালদের
বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে লড়াই করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে অত্যাচারী হিন্দু বা মুসলিম জমিদার
বা কুসিদজীবীও বাদ যায়নি। বিদ্রোহীদের একটি পর্যায়ের নেতা ধর্মগতভাবে মুসলমান –
মজনু শাহ। পরবর্তীতে নেতৃত্বে এসেছিলেন ইশা শাহ এবং অন্যান্যরা।
ইংরেজের সাথে চুক্তিবদ্ধ জমিদারদের “রেভেনিউ কাউন্সিল” ১৭৭২ সালের ১৬ মার্চ
জমিদারদের সরকারিভাবে জানিয়েছিল – “ফকিরদের উৎপাতের ফলে রাজস্বের যে ক্ষতি হইয়াছে,
আমাদের হিসাবে রাজসাহী জেলায় তাহার পরিমাণ ৮,৯৬৯ টাকা। আমরা মনে করি, চুক্তিবদ্ধ
জমিদারগণ যে সকল দায়িত্ব বহন করিতে বাধ্য, এই ক্ষতি পূরণ তাহার মধ্যে একটি। কাজেই
সরকার এই ক্ষতি সহ্য করুক – এই প্রস্তাবে আমরা সম্মতি দিতে পারি না।” (সুপ্রকাশ
রায়, পৃঃ ৩০) ১৭৮৭ সালের ২২শে জুন দিনাজপুরের কলেক্টর মুর্শিদাবাদের কলেক্টরকে
চিঠি লিখছেন – “এই যুদ্ধে গ্রামবাসীরা ফকিরদের পক্ষ নিয়ে কাজ করছে এবং বিপদের সময়
ফকিরেরা যে ফেলে গিয়েছে তা সযত্নে রক্ষা করে পরে ফকিরগণ নিরাপদ স্থানে উপস্থিত হলে
ফিরিয়ে দেবে।” (সুপ্রকাশ রায়, পৃঃ ৩৯) এসময়কার গ্রাম
আমরা এর সাথে “আনন্দমঠ”-এর স্বকপোলকল্পিত কাহিনীকে মেলানোর চেষ্টা করতে পারি।
“আনন্দমঠ”-এ শেষ অব্দি ইংরেজকে শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা কেন্দ্রীয় প্লট হিসেবে
প্রকারান্তরে কাজ করেছে। ইতিহাসের ওপরে আরেক ইতিহাসের, কাহিনীর ওপরে আরো অনেক
কাহিনীর স্তরায়ন হয়েছে। কিন্তু সাবঅল্টার্নদের স্বর রয়ে গেছে ঐতিহাসিক
দলিল-দস্তাবেজে, লোকগাথায়। বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সাবঅল্টার্নরা “কথা” বলতে
পারে – উপনিবেশিক দেশেও – কখনো বিদ্রোহের ভাষায়, কখনো ভিন্ন স্বরে। সেসময়ের লোকগান বা কাহিনী
আমার জানা সূত্রের মধ্যে নেই। কিন্তু সামাজিক উথাল-পাথাল অবস্থায় গ্রামীন
সংস্কৃতিতে এবং প্রকাশে পরিবর্তন তো আসবেই। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের মতো মানুষ যখন
একে রেপ্রসেন্ট করেন তখন সমগ্র চিত্রনাট্যই নতুন করে লেখা হয় রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত ঢঙে।
তখন আর নিম্নবর্গের কোন কণ্ঠ, স্বর, ভাষ্য শোনা যাবেনা। ১৯৪৭-এর নান্দীমুখ হিসেবে
এরকম আখ্যান একের পরে নির্মিত হতে থাকে, যার একঅর্থে চূড়ান্ত পরিণতি মর্মন্তুদ
স্বাধীনতার অভিনব চিত্রনাট্যে। আমরা পরতে পরতে সে ঘটনা দেখবো এ প্রবন্ধের পরবর্তী
অংশে।
তখনো স্বাধীনতা হাতে এসে পৌঁছয়নি ভারতীয় জনতার হাতে। জোর কদমে প্রস্তুতি চলছে। সেরকম এক সময়ে ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট
নিয়ে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতা আবুল কালাম আজাদ তাঁর India Wins Freedom গ্রন্থে লিখলেন – 16th
August was a black day in the history of India. Mob violence unprecedented in
the history of India plunged the great city of Calcutta into an orgy of
bloodshed, murder and terror …. The streets were deserted and the city had the
appearance of death.
“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ” হয়ে উঠলো শেষ অব্দি। শুধু এটুকু নয়। "স্বাধীনতা”
এই শব্দের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল সাম্প্রদায়িক হত্যা, নারীদের ক্ষত-বিক্ষত ধর্ষিত দেহ,
এমনকি পণবন্দীতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া। আজাদ বলছেন – It implied that partition was being accepted on the basis that in both
India and Pakistan, there would be hostages
who would be held responsible for the security of the minority community in the
other state.
স্বাধীনতার অন্যতম প্রস্তুতি ছিলো গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভোট। বিহারের
প্রত্যন্ত গ্রামে ঢোঁড়াই বুঝতে পারে – “অদ্ভুত জিনিষ এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে
লোকের ইজ্জত বাড়ে, এর অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে আগে হয়েছে। বোটও সেই রকম রাতারাতি
লোকের ইজ্জত বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” (সতীনাথ ভাদুড়ি, ঢোঁড়াই
চরিত-মানস) এখানে অব্যর্থভাবে মনে পড়বে বেনেডিক্ট অ্যন্ডারসনের Imagined Communities-এর কথা – “anonymous performance
of citizenship”. কোন ভগ্নাংশে একে দেখা যাবেনা – হয় শূন্য কিংবা ১,
এরকম পূর্ণ রাশিতে তোমার পরিচয়। তুমি একইসাথে ভারতীয় এবং পাকিস্তানী হতে পারোনা।
“গণতান্ত্রিক” ব্যবস্থাতো একটি শক্তপোক্ত secularizing process – এমনটাই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু জাতের সমস্যা, বিভাজন, পারস্পরিক হিংস্রতা
রয়েই গেলো। আবার ঢোঁড়াইয়ে ফিরি – “আমাদের সাহায্যেই ভোটে কংগ্রেসি জিতেছিল
আগেরবার। এবার তাই আমরা ঠিক করেছি কুর্মছত্রি, কুশবাহাছত্রি, আর যদুবংশছত্রি এই
তিন জাত মিলে রাজপুত ভূমিহারদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব।” এর উত্তর ৬১ বছরেও মিললোনা। The
answer my friend is blowing in the wind!
ঢোঁড়াই দেখেছিল – “আর পূবের দিকের টুরমেনের ফারমের সিধা রেল লাইনের কাছে কাঠের
ইস্টিশন করেছে ফৌজের সাহেবরা। বড় বড় চালা তুলেছে সেখানে। গোরু, ঘোড়া, ছাগল, খচ্চর,
ভেড়ায় ভরা। সব বেলুচি ফৌজ মুসলমান নইলে এত কসাই আর কে হবে। অথচ মুসলমানরা চটবে বলে
উট আর শুয়োর রাখেনি সরকার।” সেনাবাহিনীতে সাম্প্রদায়িকীকরণ অনেক পরে আবুল কালাম
আজাদও অনুভব করেছিলেন – “This injected communal poison in the army which till then
had been free from it.” আজাদ একথা বলছেন ১৯৪৭-এর
১৫ই আগস্টের অব্যবহিত আগে। ঢোঁড়াই আরো আগে একই বিষয় নিজের বাস্তবতা দিয়ে অনুভব
করছে!
কিভাবে অখণ্ড ভারতবর্ষ উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাদের ক্ষমতার লোভে টুকরো টুকরো হল সে
নিদারুণ ঘটনা বিস্তৃত জানার জন্য অন্তত তিনটি বইয়ের কথা উলেখ করবো – (১) জয়া
চ্যাটার্জীর Bengal Divided এবং The Spoils of
Partition, (২) রজতকান্ত রায়ের “পলাশি থেকে পার্টিশন”।
কি হল তারপরে? ঊর্বশী বুটালিয়ার The Other Side
of Silence এর oral history, personal narrative, government
documents ইত্যাদি সব নথিভুক্ত করেছে। তাঁর হিসেবে – “Twelve
million people were displaced. Nearly one million died. Some 75,000 women were
raped, kidnapped, abducted, forcibly impregnated by men of the ‘other’ religion,
thousands of families were split apart, homes burnt down and destroyed,
villages abandoned.” (p. 35) আরো মর্মান্তিক হল “while
abducted women then entered the realm of silence, women who were killed
by families, or who took their own lives, entered the realm of martyrdom.”
(p. 158) একদল নারীর যাত্রা পরম নৈঃশব্দে এবং বিস্মৃতিতে যাদের
কোথাও কোন চিহ্ন নেই (স্রেফ মুছে গেলো), আরেকদল অর্জন করলো শহীদের মর্যাদা।
স্বাধীনতার কি অট্টহাস্যময় পরিহাস!
বীণা দাস তাঁর Transactions in the Construction of Pain প্রবন্ধে
জানাচ্ছেন – “The bodies of the women were surfaces on which texts were
to be written and read – icons of the new nations.” কিন্তু বিপরীট
ঘটনাও ঘটলো – “But women converted this passivity into agency
by using metaphors of pregnancy…”
পরিবার, নারীত্ব, চিরকালীন বিচ্ছেদের যন্ত্রণা,
দেশহারা-ভূমিহারা-আশ্রয়হারা-নির্বান্ধব হবার তীক্ষ্ণ বর্ণনা ধরা আছে An Epic Unwritten: The Penguin Book of Partition Stories-এ।
সাদাত হাসান মান্টোর “সাহে” গল্পে হিন্দুদের সাথে একসাথে সারাজীবন, বংশ পরম্পরায়
বেড়ে ওঠা বন্ধু মুমতাজ শেষ অব্দি লাহোর যাবার জাহাজে উঠে পড়লো। সেসময় “After
his bags had all been taken to the cabin, he took us out onto the deck. For a
long time he gazed out of the place where sky and sea came together. He then
took Juggal’s hand in his and said, ‘How perfectly deceptive … this meeting of
the sky and the sea, and yet so incredibly delightful too!’” মান্টোর
আরেকটি বিখ্যাত গল্প “টোবা টেক সিং”-এ পাগলা গারদের এক পাগল জিজ্ঞেস করে – If
they were in India, where on earth was Pakistan? And if they were in Pakistan,
then how come that until only the other day it was India?” আরেকটি
পাগল গাছের ওপরে উঠে পড়ে জানায় সে ভারত বা কোথাও নেই – এক নিরালম্ব অবস্থা। গল্পের
প্রধান চরিত্র বিষান সিং ১৫ বছর ধরে শুধু দাঁড়িয়েই ছিল। তারপরে তাকে যখন জোর করে
ভারতে পাঠানো হবে তখন এই চূড়ান্ত মানসিক আর শারীরিক ধকল সে নিতে পারেনা, পড়ে থাকে
তার প্রাণহীন দেহ – There behind the barbed wire, on one side, lay India
and behind more barbed wire, on the other side, lay Pakistan. In between, on a
bit of earth which had no name, lay Toba Tek Singh.” “নো ম্যান’স
ল্যান্ডে পড়ে রইলো মানুষটি যার কোন দেশ নেই।
“রাইত কতো হইলো? উত্তর ম্যালে না!”
কৃষণ চন্দরের “পেশোয়ার এক্সপ্রেস” গল্পটি একবার স্মরণ করি। পেশোয়ার এক্সপ্রেস
এখানে নিজের মনে কাহিনী শোনায়। এক ট্রেন ভর্তি জবাই হওয়া হিন্দু ভারতে আসছে, ফিরতি
ট্রেনে ট্রেনভর্তি হিন্দুদের হাতে কাটা মুসলিম দেহ নজরানা হিসেবে ফেরত যাচ্ছে।
ট্রেনটি গোঙায়। অবশেষে শেঈ মেয়েটিকে পেয়ে গেলো দাঙ্গাবাজেরা – “মেয়েটি ওদের হাতে
নিহত হল। জঙ্গলের শুকনো ঘাসের ওপর মেয়েটি ছটফট করতে করতে মারা গেল। আর তার হাতের
বইখানা রঞ্জত হল তারই দেহের রক্তে। বইটা ছিল সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা।” জন
স্ট্র্যাচির Why One Should Be A Socialist। “সে তো নারী
ছিল। হতো কাড়োও প্রিয়তমা অথবা জননী। আর এখন সে এই জঙ্গলে পড়ে আছে লাশ হয়ে। শকুন আর
শেয়ালেরা তার লাশ ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা বইটা জানোয়ারেরা
ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। বিপ্লবের দরজা আর কেউ খুলছে না। কেউ কিছু বলছে না।”
আমাদের স্বাধীনতা পরিক্রমা আপাতত “শান্তি কল্যাণ” নিয়ে শেষ হল বেশ জবরভাবে
বুঝতেই পারছেন। ৬১ বছর পরেও বিস্মৃতির অতলান্ত গহ্বর থেকে উঠে আসা স্কন্ধ কাটা
মানুষগুলো বারেবারে বেসামাল করে দেয়। শিকাগোর হে মার্কেটের শহীদ অগাস্ট স্পাইসের
গলায় ফাঁসীর দড়িতে টান পড়ার আগে শেষ কথা ছিলো – “The day
will come when our silence will be more powerful than the voices you are
throttling today.” (History As It Happened, p. 199)
আর আমাদের বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের কানে মন্ত্রোচ্চারণ করেন –
কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে বলে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল ;
যদিও ঊজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমণীকে বুকে টানে; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।
Wonderful reminder of the history of our 'Independence'..the state sponsored education system in a very subtle way gives very little to no lesson of these history to new generations. The pain of this day, today, remains confined to a diminishing generation of Bengal and Punjab, while the rest of the nation ignorantly gloats in hollow pride. Nonetheless India crawls to become a better democracy, but this blot of history, still wrapped in paper, stinks, may be forgotten for the too sensitive for the politically correct, like an Armenian genocide of turkey!!
ReplyDeleteঅসাধারণ
ReplyDeleteBrilliant
ReplyDeleteইতিহাস বইয়ের পাতায় লেখা নেই। কিন্তু তথ্যগুলির সত্যতা সন্দেহের উর্দ্ধে। হয়তো একটা সময় আসবে যখন এই তথ্যগুলির সমর্থনগুলো মুছে দেওয়া হবে।
ReplyDeleteলেখক ডাঃ জয়ন্তকে ধন্যবাদ এই চমৎকার লেখা প্রকাশ করার জন্য।