Saturday, August 11, 2018

ধারাবাহিক গদ্য দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়







ভালোবাসাগুলো সেলিব্রিটি হয়ে...যায়নি


টানা ঝড়জলের মাস। অনেকেরই স্মার্ট ফোন খারাপ হয়ে যাচ্ছে হঠাৎ। দুম করে হারিয়ে যাচ্ছে সব তথ্য। ছবি, গান, মেসেজ। তা হলে? 
ডিজিটাল মেমরি রিস্টোরেশন নিয়ে অনেকেই বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। গুগল ক্লাউড আসার পর ব্যপারটা অন্য মাত্রায় যায়। মানুষ বোঝে, আর চাপ নেই।আমার যা-কিছু গুগলে রেখে দিলেই হল। এমন আগেও ভেবেছিল মানুষ। এবং ঠকেছিল। কারণ, অরকুট ক্র‍্যাশ করে। নিমেশে হারায় হাজার হাজার তথ্য। কত প্রেম-কত বিচ্ছেদ”! কত সেল্ফি-কত ভয়েস রেকর্ড। যেমন একদিন সমস্ত বিশ্বাস নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছিল সোভিয়েত। মানুষেরো তো স্মৃতি মুছে যায়। কি নিয়ে ফেরে মানুষ তারপর? জাতিস্মর?
সিনেমা মারা গেছে। সংবাদপত্র মারা গেছে। আর কোনো সম্পাদক নেই চাবুক নিয়ে বসে। যেমন থাকতেন রমাপদবাবু বা ধরণী ঘোষ। নেই কোনো সেস্নার। ডিজিটাল সব। সব কিছুই সবার। আর সে পথেই, একটা false Glorification এর ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। মিথ্যা আন্তরজাতিকতা সিনেমা, গান, লেখায়।  ম্যানুফ্যাকচারড শক খেতে খেতে সুররিয়াল ডিসকানেকশনে ভুগছি সবাই। একটা ডি-পলিটিসাইজড সমাজে এটাই হয়। আমাদের কোনো সমর সেন, বিনয় ঘোষ নেই। চাবুক মেরে মেরে যে রাতে মোর দুয়ারগুলি গানে চেতনা ফিরিয়েছিলেন ঘটক। নবারুণ বলতেন। বলতেন, সব অস্ত্রই যদি শত্রুদের হাতে চলে যায়, তবে কি দিয়ে লড়বি? সুমন বলতেন, এত পড়াশোনা কর, যাতে ফেলে দিতে না পারে। গণচেতনা ওঠে নামে, শিল্পীদের কাজ তার সময়ে চেতনার সুতোটা তুলে ধরা। এ অধমকে বলেছিলেন অলকরঞ্জন দাশগুপ্ত। এমপ্যাথি, কম্পেশন, হনেস্টি শব্দগুলোকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কখনো  ভুল নারীবাদ, ভুল উত্তর আধুনিকতা তো কখনো ভুল বিজেপি এটা করছে। নিজেকে ছুটি দিন। সচেতন ভাবে ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে দূরে থাকুন।
তা হলে আশ্রয়? হয়তো গান। হয়তো গাছ-পালা। ডিজিটাল মানুষকে সাইকো বানিয়েছে। বানিয়েছে প্যানিকড, প্যারানয়েড, ডিপ্রেসড। পরমাণু বোমার মতই একটা প্রজন্ম থেকেও নেই। কিন্তু আমি ভগবান দেখেছি। দেখেছি গাইতে গাইতে মানুষ ভগবান হয়ে উঠছেন। হয়ে উঠছেন সুন্দর। আলো হয়ে যাচ্ছেন মানুষ। শান্ত হচ্ছেন। বা রেগে যাচ্ছেন। প্রেমে পড়ছেন। বেরিয়েও আসছেন। গান গেয়ে মানুষ পারছেন সব। আমি দেখেছি।
দেখেছি, অবিবাহিত বহু মানুষকে গান নিয়ে বেচে থাকতে। এরা কখনই একাডেমিক্সের লোক নন। কিন্তু কয়েক শো একাডেমিয়ার পেছন মারতে পারে এদের স্মৃতি। 
এদের দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, গানের সাথে মানুষের সেক্স থাকে এক রকম। এই যে শরত আসছে, মহালয়া, তরপণ -- এদের সাথে গণ অতীতের তো আসলে সেক্সের সম্পর্ক। এন্টনি স্টরের মিউজিক এণ্ড দ্য মাইন্ড নিয়ে নবারুণ লিখতে বলেছিলেন এই অধমকে। লেখাটা লেখার আগেই নবারুণ মারা যান। কাল ছিল তার প্রয়াণ দিবস। 
একটা জাতির মহালয়া আছে।।আছে রবি ঠাকুরের গান। আধুনিক বাংলা গান আছে এ জাতির। সুমন না থাকলে যে সোনার খনি অজানাই থেকে যেত। রক্তে বিষ মেশালেন সুমন। মেশালেন সন্ধ্যা, অখিলবন্ধু, শ্যামল, রবিন চাটুজ্যে। বললেন জিনিয়াস পঙ্কজ মল্লিকের কথা। বললেন, কীর্তন ছাড়া আধুনিক বাংলা গান সম্ভব না।
বদ্ধদেব বসু কোথাও লিখেছিলেন, রবিঠাকুর সমুদ্রের মত। সবাইকে নিজের কাছে আসতে আহ্বান জানান। বারণ নেই। কিন্তু কেউ সাতার না জানলে ডুববেন নিশ্চিত।
 "ছিন্নপত্র" পড়ি যখন আজ, দেখি, একজন একা মানুষ কেমন সবুজ গাছপালা আর গানে প্রভোকড হচ্ছেন। তার আর কিছু লাগছে না।
 গত ক"দিন টানা ঝড়জল। বহু মানুষের ঘর নেই। দুনিয়ার মাটি জুড়ে কত মানুষ এমন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘর বলে এ দুনিয়ায় কিছু থাকবে না হয়তো। ঘর শুধু স্মৃতিতে। যেখানে গান থাকে। সুর থাকে। প্রজাপতি ওড়ে। ফুল ফোটে। রবি ঠাকুর আর সুমন হেটে বেড়ান।
বছর দশেক আগে একবার রূপম ইসলামের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। কখনই রূপমের প্রতি কোনো টান আমার ছিল না। তবে সেদিন ওকে প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে তোমার গানে এত একলা মানুষের ডিপ্রেশন, হতাশার কথা, যারা সত্যি একা, তারা কি করবে? 


রূপম বলেছিলেন, দুনিয়ায় এত গান-ছবি-বই আছে, কেউ চাইলেও একাকীত্বে ভুগতে পারে বলে মনে হয় না। সেদিন বুঝেছিলাম, রূপম ১২ বছর ধরে একটি স্কুলে পড়িয়েছেন। বাচ্চাদের স্কুল। যে বাচ্চারা কি করতে পারে, বাংলাদেশ তার প্রমাণ।

2 comments:

  1. তোর অন্যান্য লেখার মতোই চাবুক। মেদহীন। একটা গায়ে হাওয়া লাগানো সময়কে লাথি মারে।

    ReplyDelete

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...