একুশ বছর বয়সে
আমি প্রথম বুঝেছিলাম যে স্বাধীনতা শর্ত নিরপেক্ষ নয়। যে অর্থে আমরা স্বাধীনতা
শব্দটা যখন তখন বলি, তাকে অত সহজে না তো বলা যায়, না ব্যাখ্যা করা যায়। এমন কি
শব্দটার যে অনেক স্তর আছে, সেটাকেও ছোঁয়া যায়না। তো ওই বয়সেই কোনও এক অভিজ্ঞতা
আমায় শিখিয়েছিল যে স্বাধীনতা আসলে এক কম্পন। একটা ছোবল মারা, ছিটকে ওঠা তীব্র
ইচ্ছে। যা হয়ত প্রস্তুত হয়েছে গোপনে, চোখের আড়ালে, আর তারপর কোনও বিশেষ মুহূর্তে
সে ফণা তুলেছে, দ্রোহে, চূড়ান্ত অস্বীকারে, আর তারপর নিমেষেই হারিয়ে গেছে। এই যে
অদৃশ্য থেকে মুহূর্তে দৃশ্য হয়ে ওঠা আর তার পরেই ফের অদৃশ্যের দিকে চলে যাওয়া এই
হল স্বাধীনতার আশ্চর্য নিয়তি।
আর এই অর্থে
স্বাধীনতা, সভ্যতার ইতিহাসে কোনদিনই মানুষের স্থায়ী অবস্থান নয়। সময় নিরপেক্ষও নয়।
তা সব কালেই সমাজ, রাষ্ট্র, এবং শাসন ব্যাবস্থার কাছে দায়বদ্ধ এবং সে ভাবে দেখলে
পরাধীন। আর একটু স্পষ্ট করে বলা যাক। ব্যক্তির
স্বাধীনতা আর সমষ্টির স্বাধীনতা তো এক জিনিস নয়। বস্তুত বহুক্ষেত্রেই ব্যক্তি আর
সমষ্টির স্বাধীনতা একে অন্যের উলটো দিকেই দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের সম্পর্ক মূলত
দ্বন্দ্বের এবং সময়বিশেষে পরস্পর বিরোধী।
ব্যক্তির
স্বাধীনতার কোনও একটাই একক ঠিক করে নেওয়া কখনই সম্ভব নয়। কারণ তা নির্ভর করে সেই
মানুষটির ব্যক্তিগত চাওয়া না চাওয়ার ওপর। যতক্ষণ অবধি সেই ব্যক্তির ইচ্ছা বা
আকাঙ্খা অন্যের পক্ষে ক্ষতিকর না হচ্ছে ততক্ষণ অবধি তার স্বাধীনতা নিয়ে কোনও
প্রশ্ন নেই। সুতরাং ব্যক্তির স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যেটা গুরুত্ব পাচ্ছে সেটা তার
চাওয়ার নৈতিক বা অনৈতিক অবস্থান। যদিও এটিও অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয় এবং এ নিয়ে কোনও
স্পষ্ট দিকনির্দেশ কোনও সমাজ ব্যাবস্থা আজ অবধি দিতে পারেনি। তবু সে প্রসঙ্গ এ লেখায়
আনছি না।
কিন্তু একটি দেশ
বা একটি সমাজের স্বাধীনতার কথা যদি বলি তাহলে সেই একক তইরি করা সম্ভব। খুব সহজ
ভাষায় বললে, যে দেশ বা সমাজ অন্য কোনও দেশ বা সমাজের ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়
সেই দেশকেই আমরা স্বাধীন দেশ বলতে পারি। আর সেই সূত্রে বলতে পারি এ দেশের জনগণ
স্বাধীন। বলতে পারি ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন দেশ। এ দেশের জনগণ স্বাধীন। আর ঠিক
এইখানে এসে আমাদের একটা সংশয় তইরি হয়। বিশেষ করে সমকালীন ভারতের প্রেক্ষিতে যদি
ভাবি।
আহার, বাসস্থান,
কর্মসংস্থান এই তিনটি প্রাথমিক প্রয়োজন বেছে নেওয়ার অবাধ স্বাধীনতা যদি এ দেশের
মানুষের থাকে তাহলে স্বাধীন দেশ বলাই যেত। কিন্তু বাস্তব এটাই যে সেই নির্বাচন
ক্ষমতা আমাদের মত বহু স্তরে বিভক্ত দেশে একেবারেই নেই। বহুজাতি, বহুধর্ম, বহুবর্ণ,
বহুভাষী এই দেশে আর্থসামাজিক বিভাজন এতটাই বেশি যে সেই অর্থে সব মানুষের স্বাধীনতা
ধারণাটিই একটি অবাস্তব ধারণা। বিত্ত অনুযায়ী শ্রেণী বিভাগ তো আছেই। এছাড়াও রাষ্ট্র
ক্ষমতার কে কতটা কাছাকাছি আছে তার ওপরেও ব্যক্তি ও জনগোষ্টির স্বাধীনতা নির্ভর করে
আছে। তাদের প্রতিটি গতিবিধি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের অধীন। প্রত্যক্ষভাবে অথবা
পরোক্ষে। রাষ্ট্রের ধারণাটা আমাদের দেশে
খুব প্রাচীন কিছু নয়। স্বাধীনতা ধারণাটি সেক্ষেত্রে আজকে যেভাবে ভাবা হয় সেটিও খুব
পুরনো কিছু নয়। কিন্তু ঘটনা এটাই যে ব্যক্তি স্বাধীনতার ভাবনা থেকে এ লেখা শুরু
করেছিলাম তা মানুষের আদিতেই ছিল। তার অস্তিত্বের অংশ হিসেবেই ছিল। যেখানে যখন সে
নিজেকে বন্দী দেখেছে তখন সেখানেই সে নিজের মধ্যে এই স্বাধীনতার তীব্রতা অনুভব
করেছে। ইতিহাসের কোনও পর্যায়েই এরকম হয়নি যে শোষিত, নিপীড়িত, শৃঙ্খলে আটকে থাকা
মানুষ স্বাধীনতার এই বাসনা নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেনি। বস্তুত এই অর্থে পৃথিবীর
প্রতিটি স্বাধীনতার ইতিহাস আসলে প্রতিটি সমাজ ও সভ্যতার, রাষ্ট্র ও সমষ্টির শাসন
ব্যাবস্থায় ব্যক্তির দমনেরও ইতিহাস।
No comments:
Post a Comment