১
বার্লিনে থাকাকালীনই অনেকগুলো টেক্সট পেয়েছিলাম। সাধারণত দেশের
বাইরে থাকলে আমি কলকাতার নম্বর চালু রাখি না। তা বলে এমন নয় যে, আমার পয়সা নেই, বা আমি কিপটে। কিছুটা চারপাশের লোকের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্যও এই কাজটা আমি
করি। একটু পালানোর স্কোপ পেলে কে ছাড়ে বলুন তো! সিনেমার হিরো বলে কি আর মানুষ নই নাকি!
নিজস্ব জীবন বলে কিছু থাকতে নেই? কিন্তু ফিল্ম রিলিজ় সামনে থাকলে রাখতে বাধ্য হই। কখন কোন দিক থেকে পাবলিসিটি মিস
হয়ে যায়,
বলা তো যায় না! এই যেমন, আমার নেক্সট ফিল্ম প্রোমোট করতে চলে এসেছি ইউরোপে। লন্ডন আর
রোম হয়ে দেশে ফিরব। তার মানে এরকম ভাবার কোনও কারণ নেই, বাংলা ছবির এত রমরমা যে দেশ-বিদেশ থেকে ফিল্ম প্রোমোশনের জন্য
ডাক পাঠাচ্ছে। এগুলো সবটাই আসলে কানেকশনের খেলা। আমার বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধব, যারা ইউরোপে থাকে, তাদের কনট্যাক্ট দেওয়া হয়েছিল, মানে আমিই দিয়েছিলাম প্রডাকশন হাউসকে। তারাই অনেক রকম ছক কষে এই ব্যবস্থা করেছে।
ব্যবস্থা মন্দ নয়। এই ফাঁকে টুক করে বিদেশ-টিদেশ ঘুরে ফেলা যায়। সে যাক! এ বছর আমার
খুব ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু জুলাই মাসের মাঝামাঝি কলকাতায় আসছে। আমিও আর দিনদশেকের মধ্যেই
দেশে ফিরব। সুতরাং তিন বন্ধুর মিলনোত্সব সেলিব্রেট করার জন্য একটা ছুটির দিন তো চাই-ই।
তাই না?
এ বছর ১৫ অগস্ট আমরা নিজেদের স্বাধীনতা কীভাবে উদযাপন করতে পারি, তাই নিয়ে বিস্তর প্ল্যান প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে। সব কিছু
ঠিকঠাক চললে এবার আমাদের দেখা করার কথা প্রায় বছরসাতেক বাদে।
আমি সপ্তাংশু মুখোপাধ্যায়, বাংলা সিনেমায় নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করি। কথায় বলে, সিনেমার হিরো, সুতরাং স্ট্রাগল তো থাকবেই। তবে নিজের কাছে স্বীকার করতে আপত্তি নেই, স্ট্রাগল আমার সেই অর্থে কিছু নেই। মানে ফিল্ম লাইনে। কিন্তু
তাও অনেকসময় বিভিন্ন স্ট্রাগল ও বঞ্চনা পেরিয়ে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের উপর ভিত্তি করে
আমার উত্থানের গল্প অনেকসময় আমাকে বানিয়ে বলতে হয়। এই লাইনে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেন, সেটা না করলে নাকি দর্শকদের আমার প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা ও একইসঙ্গে
সহানুভূতি তৈরি হবে না। বাজার বজায় রাখার জন্য এসবেরও দরকার আছে। অথচ অন্যপথে চললে
আজ হয়তো সত্যিই আমাকে স্ট্রাগলের গল্প বানাতে হত না। আমি যেভাবে জীবন শুরু করেছিলাম, থাক সে কথা...
আমি মানুষটা দেখতে বাঙালিদের চোখে সুন্দর। ঢ্যাঙা লম্বা নই, গায়ের রং বেশ ফরসার দিকেই এবং চোখ-নাক-মুখ শার্প। বাঙালি মফস্সলি
মেয়েদের কাছে আমি বেশ সুপুরুষ, একথা লোকে বলে থাকে। আমার ছেলেবেলাটা মফস্সলে কাটলেও আমার মামার দৌলতে বড় হওয়ার
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাই কেটেছে শহরে। অর্ক মজুমদার ও অনিমেষ দাশগুপ্ত আমার সেই
সময়কারই বন্ধু। ক্লাস ইলেভেন থেকে অর্ক ও অনিমেষ আমাকে ঠিক সেইভাবেই জানে এবং চেনে
ঠিক যেভাবে আমি আজ খ্যাতির শিরোনামে এসে পৌঁছেছি। হয়তো আমাদের তিনজনের পথ ভিন্ন বলেই
আমি ওদের কাছে ঠিক আগের মতো একইরকমভাবে ধরা দিতে পারি। এই ব্যবস্থাটাও আমার নিজেরই
করা বলা যেতে পারে। অর্ককে আমি বেশ ঈর্ষা করতাম। ব্রিলিয়ান্ট অর্ক চিরকালই পড়াশোনায়
তুখোড়। শুধুমাত্র নিজের মেধার জোরে আজ ও এয়ারবাস ৩৮০-এর পাইলট। ওর মতো এই নিশ্চিন্ত
বিলাসী জীবন আমিও চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর সঙ্গে টক্কর দিয়ে সেটা পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব
ছিল না। তাই সময় থাকতে এমন একটা লাইন বেছে নিলাম যাতে মেধা না হোক, খ্যাতির দিক থেকে অন্তত আমি ওর সমকক্ষ হতে পারি। কে না জানে, বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে! আমার ধারণা, আমি নিজেও প্রায় একই উচ্চতায় পৌঁছেছি বলেই হয়তো বন্ধুত্বটা আগের
মতো করে ধরে রাখতে পেরেছি। ওইটুকু সময় আমাকে অভিনয় করতে হয় না জীবনে। আসলে আমি সবসময়
নিজের অজান্তেই একটা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি। এই প্রতিযোগিতার চক্করে অনেক প্রিয় জিনিস
আমাকে পিছনে ফেলে আসতে হয়েছে। আমার শৈশব, উজ্জয়িনী...উজ্জয়িনীর সেই চোখ...আমি এগুলো মনে করতে চাই না। কিন্তু সময় বোধ হয়
প্রতিশোধ নেয়। ঠিক সেই কারণেই কি উজ্জয়িনীর সঙ্গে ফের আমার দেখা হল দীর্ঘ বারোবছর বাদে? ওর ঋজু চেহারা, সম্মোহনী দৃষ্টি আবার আমাকে বিহ্বল করল, যখন আমি ওকে এখানকার সবচেয়ে নামী প্রডাকশন হাউজ়ের নতুন মার্কেটিং
ম্যানেজার হিসেবে দেখলাম। ভাবতে যন্ত্রণা হয়, একদিন একেই নাকি আমি...কী জানি! হয়তো এমনিভাবেই একদিন আমার কৈশোরের
সামনে গিয়েও দাঁড়াতে হবে...অর্ক ও অনিমেষ দু’জনেই আমার প্রায় বিস্মৃত, প্রায়ান্ধকার জীবনেরও একাংশ নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, আমারই মতো করে। আমি জানি, আমি না চাইলে ওরা কখনওই সেই অংশগুলো বের করবে না। অনিমেষ আলাদা, আমাদের মধ্যে একেবারেই ছন্নছাড়া। চিরকালের খ্যাপাটে অনিমেষ কোনও
বাঁধাধরা জীবন চায়নি। ইউনিসেফ-এ জয়েন করেছিল গ্র্যাজুয়েশনের পর। পৃথিবীর এই প্রান্ত
থেকে ওই প্রান্তে ছুটে বেড়ানোটাই ওর নেশা ও পেশা। এর বাইরে ওর কোনও চাহিদা নেই। আমাদের
জীবনযাপনের সঙ্গে ওর কোনও মিল নেই। কিন্তু নিখাদ বন্ধুত্ব নয়, ওর প্রতি আমার ও অর্কর কেমন যেন একটা স্নেহ আছে। নাড়িছেঁড়া অনিমেষও
বোধ হয় আমাদের প্রতি কোথাও দিয়ে সত্যিই দুর্বল। হয়তো এই গভীর পারস্পরিক বোঝাপড়ার কারণেই
বছরের বেশিরভাগ সময় যোগাযোগ না থাকার কারণেও আমরা কেউ কাউকে খরচের খাতায় ফেলে দিতে
পারিনি। এই ১৫ অগস্ট আমাদের তিন বন্ধুর বিদেশি মদ সহযোগে পারস্পরিক খাতা খোলার দিন।
প্রেমহীন দাম্পত্য এবং আগ্রাসী ভোগবাদকে সঙ্গে নিয়ে বাকি জীবনে আরও উচ্চতায় পৌঁছনোর
শলাপরামর্শ করার দিন। বলা বাহুল্য অনিমেষ এই ছকে থাকবে না। কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকবে।
অন্তত এই ১৫ অগস্ট তো থাকবেই, সেইরকমই জানিয়েছে। ওর মতে, ও আর বড়জোর বছরদশেক বাঁচতে চায়। প্রায়ই আমাদের বলে, “আমার জন্য প্রার্থনা করিস, এর পরে যেন আমার মৃত্যু হয়। আমি বাঁচতে চাই না। তার মানে এই
নয় যে,
আমি সুইসাইড করব। কিন্তু শারীরিক মৃত্যু না হলেও অন্তত সামাজিক
মৃত্যু যেন হয়।”
সামাজিক মৃত্যু কাকে বলে আপনারা জানেন?
২
আমি কিন্তু জানি। আমি সামাজিক মৃত্যু ঘটতে দেখেছি। আমি আমার
বাবার সামাজিক পক্ষাঘাতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার সাক্ষী। আমাদের মফস্সলের সবচেয়ে
নামী স্কুলের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন আমার বাবা। আমি তখন ওই স্কুলে পড়ি ক্লাস টেনে, কয়েকমাস পরেই মাধ্যমিক। একদিন পরীক্ষায় একটি ছাত্রকে পরীক্ষায়
টুকলি করার অপরাধে চড় মেরেছিলেন এত জোরে যে, ছেলেটির নাক থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে
এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে হসপিটালাইজ় করা হয়। অথচ সে টুকলি করছিল বলে বাবা কিন্তু তাকে
মারেননি। ক্রমাগত মিথ্যেকথা বলে যাচ্ছিল সেই ছেলেটি এবং এবং যেহেতু বাবা প্রমাণ করতে
পারেননি,
অর্থাত্ হাতেনাতে ধরে ফেলতে পারেননি যে, সে সত্যিই টুকছিল, সেই কারণে ছেলেটি অবলীলায় বলে দিল যে “মাস্টারমশাই আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। আমি টুকিনি, আপনি ইচ্ছে করে আমায় ধরেছেন।”
‘মাস্টারমশাই আপনি মিথ্যেকথা বলছেন!’ এই কথাটা কে শুনল সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? অনাদিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়? আমার বাবা?
ওই একটা কথাই ওই ঠান্ডা মাথার মানুষটার মাথায় যেন চকমকি পাথর
ঠুকে দেয়,
একেবারে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে শিরা। আশ্চর্য! যে মানুষটা কোনওদিন
কোনও ছাত্রের গায়ে হাত তোলেননি, তাঁকে বাঁচাতে একজনও এগিয়ে আসেননি সেদিন। অভিভাবকেরা যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে ছিঁড়ে
খাচ্ছে,
একজন শিক্ষকও এগিয়ে এসে বলেননি, কোথাও আপনাদের ভুল হচ্ছে। এরকম একটা জ্বলন্ত ঘটনায় অংশ নিয়েছিল
সারা শহর। বলা ভাল, একটা জীবন জ্বালিয়ে
দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। আমি আর মা তখন মামারবাড়িতে। ঘটনার বিন্দুবিসর্গও জানতাম
না। যেখানকার প্রত্যেকটি লোক বাবাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে, সেখানে এমন চরম কশাঘাত মেনে নিতে পারেননি আমার বাবা। কাঁপতে
কাঁপতে বেরিয়ে এসেছিলেন স্কুল থেকে। সেদিন রাত্রেই বাবার স্ট্রোক হয়, পর পর দু’বার ম্যাসিভ অ্যাটাক। প্রাণে বেঁচে গেলেন বটে, কিন্তু বাকশক্তিরহিত হয়ে যান চিরদিনের মতো। বোধশক্তিও হারিয়ে
যায় আস্তে-আস্তে। উফ, জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা
দিতে যাওয়ার আগের সেই ক’টা দিন কীভাবে যে নিজেকে তৈরি করেছিলাম, ঈশ্বরই জানেন। বাবা তাঁর আধা পড়াশোনা করা ছেলেকে শুধু এটুকুই
শেখাতেন “পরীক্ষা যেমনই দাও, সত্ভাবে দেবে। জীবনে যা-ই কর না কেন, সত্ভাবে করবে। তাতে হয়তো আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে দেরি হবে, কিন্তু মানুষ হিসেবে নিজের কাছে গর্ব করতে পারবে যে তুমি কখনও
অন্যায়ের সঙ্গে আপস করনি, সত্যকে কেউ কখনও তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেনি।” বাবার কথা আমি তেমন না বুঝলেও মোটামুটি বাধ্য ছেলের মতো কথাগুলো
মেনে চলারই চেষ্টা করতাম বরাবর। মাধ্যমিক দিতে যাওয়ার আগে প্রণাম করার সময় সেই বাবার
চোখেই আমি দেখেছিলাম অর্থহীন বোবা এক দৃষ্টি...
বাবা অব্রাহ্মণ বিয়ে করেছিলেন বলে বাবার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে
কোনওদিনই সম্পর্ক ছিল না আমাদের। মামা পাশে এসে না দাঁড়ালে আমার পরীক্ষা দেওয়া হত কি
না সন্দেহ। ওই ঘটনার পর উনি আমাদের জোর করে নিয়ে আসেন কলকাতায়। নয়তো বাবার স্মৃতি ঘেরা
ওই বাড়ি ছেড়ে মা আসতেন না কখনও। যদিও কলকাতায় আসার পরও আমার বাবা বেশিদিন বাঁচেননি।
শেযদিকে বাবার সেই অবোধ শিশুর মতো প্রশ্ন নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার দৃশ্য...
আমি কিন্তু ভুলে গিয়েছি সব। এখন আর সত্যিই সেসব কথা তেমন মনে
পড়ে না। অথচ সেই অভিশপ্ত ঘটনার পর পর মনে-মনে কিন্তু খুব তৈরি হয়েছিলাম যে, একদিন এইসব অপমানের প্রতিশোধ নেব আমি। রক্তগরম করা সেইসব ভাবনা-চিন্তা
কলকাতার বিলাস যে ঠিক কবে মন থেকে মুছে দিল, সেটা টেরই পেলাম না। কোনওদিন মুখ ফুটে কিছু না বললেও মাও হয়তো
আশা করেছিলেন যে, আমি হয়তো বাবার উপর
হওয়া অবিচারের একটা যোগ্য জবাব দেব। কিন্তু আমি সেসবের ধার দিয়েও গেলাম না...
৩
মা চলে গেলেন গ্র্যাজুয়েশনের পরই। আমার প্রোফেসর হওয়া না অভিনেতা
হওয়ার দোলাচলকে বাঁচিয়ে দিয়ে। মানে আমি মাস্টার্স করব, নেট স্লেট দেব, অধ্যাপক হিসেবে আমার নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে, বাবার মতো ছাত্র তৈরি করাই হবে আমার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান, মা ঠিক এরকমটাই চাইতেন। কিন্তু ততদিনে আমি নাম যশের মোহে পড়ে
গিয়েছি। তা ছাড়া আমি নিজের নামে বিখ্যাত হব, এরকম একটা ভাবনা আমাকে তাড়িয়ে ফিরত। মনে হত, আমাকে সকলকে ছাপিয়ে যেতে হবে। আমার নামটা এমন হবে, যে নিজেই নিজের ইতিহাস সৃষ্টি করবে। বিরাজ করবে শুধু উজ্জ্বল
বর্তমানে আর পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যাবে মসৃণ ভবিষ্যত্। কলেজে থাকাকালীন গ্রুপ থিয়েটারে
শখের অভিনয়ের সুবাদে গ্ল্যামার ওয়াল্ডর্টা একটু-আধটু চিনতেও শিখেছিলাম। নামী ফিল্মস্টারদের
অনেকেই ভাল অভিনেতার তকমা লাভ করার জন্য থিয়েটারে অভিনয় করতে আসতেন। তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা
করার কাজটা আমি প্রায় খেটেখুটে ভাল রেজ়াল্ট করার মতোই একাগ্রচিত্তে করতাম। এঁদেরই
একজন আমায় বলেছিলেন, “শোন গ্লিসারিন ছাড়া
চোখের জল আমার চেষ্টা করবি না একদম। লোকে যতই বার খাওয়াক, মনে রাখবি অভিনয়টা তোর পেশা। আর কোনও চরিত্রকে ফুটিয়ে ঠিকঠাক
ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে তোর প্রোফেশনালিজ়মের নিদর্শন। এক্কেবারে মাইনে করা চাকরির মতো ব্যাপার।
নিজের মনকে ভারাক্রান্ত করে চোখে জল এনে লোকের প্রশংসা কুড়িয়ে কোনও লাভ নেই। জীবনটা
জলের মতো বইতে দিবি, বাইরের কোনও কিছু
ভিতরে দিবি না। জীবনকে কাজের সঙ্গে মেলাতে যাস না। তার জন্য কেউ তোকে টাকা দেবে না, মনে রাখবি। বরং গ্লিসারিন নিয়ে কেঁদেও যদি তোকে দেখে মনে হয়
সত্যি কাঁদছিস,
তা হলে জানবি, অভিনেতা হিসেবে তুই জিতে গিয়েছিস।”
আমি নিজেও ওঁর সঙ্গে একমত ছিলাম। আজ অবধি একটি দৃশ্যেও গ্লিসারিন
ছাড়া কাঁদিনি। কান্না-টান্না এমনিতেই আমার বড় একটা আসে না। বাবা ও মায়ের চলে যাওয়ায়
কেঁদেছিলাম ঠিকই, তবে তার চেয়ে অনেক
বেশি ভিতরে পুড়েছিলাম। সেই আগুন ওখানেই ছাইচাপা দিয়েছি। যাক সে কথা। এইরকমই কিছু ঘনিষ্ঠতার
সূত্রে আমার জীবনে ফিল্মের ব্রেক আসে। একদল কলেজস্টুডেন্টকে নিয়ে ছবি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যাদের অনেকে মারা যায়। একটা দেশপ্রেম
টাইপ পাঞ্চ থাকায় ছবিটা মার্কেটে হিট করে গিয়েছিল একেবারে। সেই থেকে শুরু করে আজ এই
চল্লিশের কোঠায় দাঁড়িয়ে আমাকে ফ্লপ ব্যাপারটা তেমন ভাবায়নি। সুপারহিট, হিট, সেমি হিট এই তিনধরনের শব্দের মধ্যেই আমার কেরিয়ার ঘোরাফেরা করেছে বেশিরভাগ সময়।
আর ইদানীং বাংলা ছবির একটা মস্ত সুবিধে হয়েছে। আন্তর্জাতিক মার্কেটে বাংলা সিনেমার
ইন্ডাস্ট্রিকে প্রোমোট করার জন্য খাতায়-কলমে সব ছবিকেই হিট দেখানো শুরু হয়েছে। আগে
যেমন অন্য প্রডাকশন হাউজ়কে ডাউন করার জন্য অনেকরকম পলিটিক্স চলত এবং যাতে আমাকেও অনেকসময়
সক্রিয় অংশ নিতে হয়েছে, এখন সেইসব সমস্যা অনেকটাই কমে গিয়েছে। পিছনে নিন্দে করলেও এখন ইন্ডাস্ট্রির সকলের
সঙ্গে সকলের ভারী বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ফলে আমার ছবি যদি ধ্যাড়ায়ও, কেউ মুখ ফুটে সেকথা বলবে না। তা ছাড়া এখন এই সময়টা, যখন মেনস্ট্রিম কমার্শিয়াল মুভির জায়গায় এতটু আঁতেল ছাপমারা
ছবিগুলো দর্শক টানছে, সেখানেও আমি নিজেকে
বেশ ভালই ফিট করিয়ে নিতে পেরেছি। আমার অভিনয়ের ব্যাপারে কোনও ইনহিবিশন নেই। শুধু অভিনয়
কেন,
জীবনের কোনও ব্যাপারেই নেই। আমি খুব সুন্দর সাঁতরে পার হতে পারি
খরস্রোতা নদী,
দিব্যি উপরে উঠতে পারি সর্পিল পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়েও। এটাই আমার
সাফল্যের রহস্য বলে আমার মনে হয়।
তবে আমার সাফল্যের পিছনে আমার শ্বশুরবাড়ির অবদানও নেহাত কম নয়।
ঠিক সময়মতো একটি নামী প্রডাকশন হাউজ়ের মালিকের একমাত্র মেয়েকে বেশ ছক করে বিয়ে করে
ফেলেছিলাম। ফলে শ্বশুরের অপত্য স্নেহ এবং আরও অনেক কিছুই অকাতরে পেয়েছি আমি। আমার বউয়ের
সঙ্গে কোনও ঝামেলা নেই। ফিল্মলাইনের একনম্বর হিরো হওয়া সত্ত্বেও আমার কোনও ‘শোওয়ার’ দোষ নেই। একমাত্র মেয়ে তিন্নি-অন্ত প্রাণ আমি। বাবা হিসেবে ওকে যতটুকু দেওয়া যায়, তার চেয়ে আরও ঢের বেশি আমি ওকে দিতে প্রস্তুত। সবই ঠিকই আছে
এই পর্যন্ত। কিন্তু উজ্জয়িনী যে আবার ফিরে এল! আর আমি সেদিনই বিস্ফোরণের সাক্ষী হলাম...ভুলে
গেলাম কলেজের পোর্টিকোর এক কোণে ওকে এক ধাক্কায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে সুপ্রীতিকে বিয়ে করেছিলাম
আমি! সুপ্রীতির সঙ্গে আমার ভালবাসার অভিনয়, সুন্দর দাম্পত্য জীবন ফুটিয়ে তোলার অভিনয় যে ভিতরে ভিতরে আমাকে
এতখানি বিধ্বস্ত করে দিয়েছে, সেটা হয়তো উজ্জয়িনীকে আবার না দেখলে এত ভাল করে অনুভব করতে পারতাম না। পেশার খাতিরেই
প্রায়ই ওর মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। ও কখনওই আমাকে বুঝতে দেয় না ওর ভিতরের উত্থান-পতন।
এমনভাবে আমরা কথাবার্তা বলি, যেন আমাদের কোনও অতীত নেই। নতুন করে পরিচয় হয়েছে। এ যেন এক অদ্ভুত অভিনয় প্রতিযোগিতা!
কে কত নিপুণ কৌশলে পরস্পরকে ভুলিয়ে রাখতে পারে অতীত, বজায় রাখতে পারে দূরত্ব। এই প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি
আমি,
জিতে যাচ্ছে উজ্জয়িনী। অতীত নেই আমাদের, ভবিষ্যত্ও কি নেই? আমি কি জানি হেরে যাওয়া কাকে বলে? আমি কি জানি ভাঙন কোন দিক থেকে আসে?
৪
এই অনিমেষটাই শেষপর্যন্ত সবকিছু ভেস্তে দিল। শুধু ওর কথা ফেলতে
পারব না বলেই আমি রাজি হতে বাধ্য হলাম। হুগলির একটা প্রত্যন্ত গ্রামের আশ্রমে আমাকে
ফ্ল্যাগ তোলার জন্য যেতে হবে ১৫ অগস্ট। অন্য কেউ হলে ম্যানেজারকে সোজা খিস্তি দিতাম
এই ধরনের প্রোপোজ়াল অ্যাকসেপ্ট করার জন্য। কিন্তু অনিমেষকে কী করে না বলি! অর্কও রীতিমতো
আপসেট। আসলে অনিমেষের বাউন্ডুলেপনা যে এইভাবে আমাদের ডোবাবে, সেটা ঠিক ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি আমরা কেউ। ও নিজেও খুব দুঃখিত।
কিন্তু যেহেতু ওর কাছে ওর খ্যাপামি আমাদের বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা
বুঝে আমাদের অভিমান হয় বটে, কিন্তু কিছু বলতেও পারি না ওকে। এবারও ওর কাছে আমরা সারেন্ডারই করলাম। অর্ককে কিছুতেই
আসার জন্য রাজি করাতে পারলাম না। অগত্যা আমিই এলাম মেয়েকে নিয়ে। এলাম অবশ্য বেশ লেট
করেই। সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। আর মেজাজও বেশ খিঁচড়ে ছিল। এসে দেখলাম ফ্ল্যাগ তোলা
হয়ে গিয়েছে। বাচ্চারা নাকি খুব হট্টগোল করছিল, তাই পতাকা তুলতে বাধ্য হয়েছেন। আশ্রম কর্তৃপক্ষ খুব ক্ষমা চাইলেও
আমার রাগটা বেড়ে গেল, মনে-মনে অনিমেষকে
গালাগাল দিলাম। এর জন্য শালা আমাদের এত সাধের প্ল্যান বরবাদ করলি তুই? অনিমেষ অবশ্য নির্বিকারচিত্তে বলল, “ফ্ল্যাগ তোলা হয়েছে তো কী হয়েছে। সপ্তাংশু এই এগজ়িবিশনের ফিতে
কাটবে।”
হাসিমুখে কাটতেও হল তাই। কিন্তু ওদের বাকি অনুষ্ঠান আর কচি-কচি হাতের কাজ দেখতে কোথাও যেন বরফ গলেও যাচ্ছিল।
কেমন একটা সুদূরের স্মৃতি যেন কাছে আসতে চাইছে। আমি এখানে নিজের মতো নির্লিপ্ত ও উদাসীন
থাকতে পারছি। অন্তত এটুকু স্বাধীনতা আমার কাছে আছে, কারণ অন্য জায়গায় আমি অ্যাপিয়ারেন্স ফি নিই বলে প্রোফেশনালিজ়ম
দেখানোর জন্যই অনেকরকম অভিনয় করতে হয়। সাদাকে কালো বা কালোকে সাদা বলতে হয় হামেশাই।
আজ অন্তত এগুলোর হাত থেকে নিস্তার পেয়েছি আমি। আমার সদ্য তিনে পড়া মেয়ে আশ্রমের বাচ্চাদের
সঙ্গে খুব মজা করছে। সবার কোলে উঠছে, ছুটে-ছুটে বাগানে যাচ্ছে, চারাগাছগুলোকে আদর করছে। বহুবছর পরে আমার বাবাকে মনে পড়ছে। শেষদিকে কোনও কিছুর
প্রতি বাবার কোনও আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু আমার মামারবাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানের গাছগুলোর
গায়ে-মাথায় কেমন যেন হাত বোলাত বাবা। দূর থেকে দেখলে মনে হত, নিশ্চুপ নিস্তব্ধ দুই প্রাণের মধ্যে অজানা ইথার-তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে।
বাবা বোধ হয় ভাবতেন, ওই নরম সবুজ গাছগুলো, আর যা-ই হোক অন্তত তাঁকে মিথ্যেবাদী বলতে পারবে না..
আমি কি একটু বিহ্বল হয়ে পড়ছি? না না সপ্তাংশু, উচিত হচ্ছে না। জীবনের সাফল্যের মূল কথাই হল আবেগ নিয়ন্ত্রণ, এই তুমিই কিনা, বাবার সেন্টিমেন্ট, মায়ের ইচ্ছে, প্রেমিকার অশ্রুসজল
চোখের পথ হেলায় পেরিয়ে এসেছ? সেই তুমিই কি না, প্রত্যন্ত গ্রামের
একটা আশ্রমে এসে...এ কী করে হয়? তোমার জীবনের স্ত্রিপ্টে তো আবেগে ভেসে যাওয়া নেই? বরাবরই তুমি ডিরেক্টরস অ্যাক্টর...নিজেকে সঠিক পথে ডিরেক্ট করো
সপ্তাংশু!
“স্যার, ব্যস্ত?
একটা কথা বলব?”
এক ভদ্রলোকের গলা শুনে ফিরে তাকালাম। মূল আশ্রম থেকে বেরিয়ে
আপনমনেই হাঁটছিলাম এদিক-ওদিক। দেখলাম, সাদা লাটখাওয়া ধুতি ও ততোধিক সাধারণ পাঞ্জাবি পরা একটি লোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সামান্য
হেসে বললাম,
“বলুন।”
“কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি কি অনাদিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে?
”
আমি সামান্য অবাক হলাম। অনেক পাগল ফ্যানই আমার হাল-হকিকত মুখস্থ
রাখে। ভাবলাম,
ইনিও হয়তো কোনও ইন্টারভিউতে আমার বাবার নামটা পড়ে মনে রেখেছেন, সেই কথাটা বোঝানোর জন্যই এভাবে বললেন! আসলে উনি তো জানেন না, এই পরিচয়ে আমি বড় হইনি! হতে যে চাইনি, এমন নয়। কিন্তু হওয়ার আগেই তো সব শেষ হয়ে গেল! তা ছাড়া এখন আমার
নিজের নামের একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি হয়েছে। আর এই লোকটি কিনা অনাদিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের
নামে আমায় চিনতে চাইছে?
আমি চুপ করে আছি দেখে লোকটি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। বলল,
“না মানে সরি স্যার। আমার বোধ হয় কোথাও ভুল হচ্ছে...”
“কোথাও কোনও ভুল নেই। আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনি ঠিকই বলেছেন...আমি
অনাদিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়েরই ছেলে!”
নিজেই চমকে গেলাম। কথাটা বলার সময় কি প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল কোথাও?
লোকটা হাসল, “তা হলে ঠিকই চিনেছিলাম আপনাকে।”
“মানে?” আমাকে চেনে না, এই রাজ্যে এমন লোক
পাওয়া মুশকিল বলেই তো আমি জানতাম! আমার অপ্রস্তুতভাবটা বুঝেই সম্ভবত উনি বললেন,
“আমি আদিগ্রাম হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। আপনার কয়েকব্যাচ জুনিয়র...জীবনে
আজ অবধি স্যারের মতো একজন মানুষ দেখলাম না।”
আমি এবার সত্যিই অবাক হলাম। সপ্তাংশু মুখোপাধ্যায় টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির
একনম্বর হিরো,
অভিনয় করতে-করতে ক্লান্ত, ক্রমশ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছি। এর চেয়ে অনাদিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের
ছেলে হওয়াই কি ভাল ছিল?
“আপনার নামটা...”
“বিমলেন্দু ঘোষ।”
অনেক চেষ্টা করেও নামটা মনে করতে পারছি না ছেলেটি কে! কোন ক্লাসে
পড়ত ও?
বাবার সেই মর্মান্তিক ঘটনার সময়?
“আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। স্যার একদিন আমায় ডেকে পাঠালেন। স্বাধীনতা
দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি। বললেন ‘বিমল তোমার হাতের লেখাটা খুব সুন্দর। আমি তোমাকে একটা কপি দেব, তুমি যত্ন করে সেটা লিখে দেবে একটা চার্টপেপারে, বুঝলে? সুন্দর করে রং দিয়ে সাজাবে, ভাল হলে আমি ১৫ অগস্ট টাঙাব স্কুলের দেওয়ালে।’ কী যে আনন্দ হয়েছিল, আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। স্যারের হাত থেকে ১৫ অগস্টের কাজ
পাওয়া যে কতটা গর্বের বিষয়, আপনাকে নতুন করে আর কী বলব!”
আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার ভিতরে কোথাও কোনও ভাঙচুর ঘটছে কি না! কত স্মৃতি ঝাঁপিয়ে
পড়ছে,
যাদের জোর করে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম মনের চোরাকুঠুরিতে। এবার
যেন তারা বিদ্রোহ করে বাইরে আসতে চাইছে...
“আপনার মনে আছে সপ্তাংশুদা? স্যার কী সুন্দর করে স্কুলটাকে সাজাতেন? মনে আছে প্রত্যেককে দিয়ে আলাদা আলাদা করে পাঠ করাতেন স্বাধীনতা
সংগ্রামের ইতিহাস? আর স্যারের সে কী
সুন্দর গমগমে গলা! একটা সত্যি কথা বলব দাদা? আপনাকে স্যারের মতো দেখতে নয়। কিন্তু গলাখানা অবিকল স্যারের
মতোই লাগে জানেন! আপনার মনে আছে, আপনারা কয়েকজন মিলে প্রতিবছর ফ্ল্যাগ তোলার পর বন্দেমাতরম গাইতেন, খোলা গলায়। বিকাশদা হারমোনিয়াম বাজাত? আপনার মনে আছে সপ্তাংশুদা গানটা? এখনও গান? উফ ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ”
গানটা মনে নেই? কতবছর গাইনি? কত বছর? অথচ ওই গানটা তো শিরায় শিরায় মিশে ছিল। আমার বাবার সুর করা একেবারে
পরিচিত ঢঙের বাইরে খোলা গলার গান বন্দেমাতরম্। ওটা কি ভুলে গিয়েছি আমি?
মনে হল কেউ যেন ডাব করছে আমার গলা। অন্য কেউ আমার ভিতর থেকে
বলছে,
“তোমার মনে আছে সুরটা? গানটা গাইলে না কেন?”
“গেয়েছি তো! আপনাদের তো আসতে আসতে লেট হল একটু। বুঝি, আসলে রাস্তার যা অবস্থা...অতক্ষণ কি আর পতাকা তোলা অপেক্ষা করা
যায় বলুন?
বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেগুলো হাঁ করে বসে আছে, কোন সকালে উঠে..”
“তা ভালই করেছেন।”
“কী জানি সপ্তাংশুদা, ভাল না মন্দ। স্বাধীনতা দিবসের স্কুলটা যেন চোখের সামনে ভাসে।
স্যার একা হাতে ঠিক যেভাবে গোটা স্কুলবাড়ি সাজাতেন, আমাদের এই ছোট্ট আশ্রমকেও...আমি চেষ্টা করেছি। সারাদিন এই নিয়েই
তো থাকি।”
“আপনি বিয়ে করেননি? বাড়ি কোথায় আপনার? এখানেই থাকেন?”
“হ্যঁা, এখানেই থাকি। এটাই সংসার। এতগুলো অনাথ বাচ্চা...দায়িত্ব কম বলুন? এর মধ্যে আবার বিয়ে! কলকাতায় একটা অনুষ্ঠানে ভাগ্যিস অনিমেষদার
দেখা পাই। উনি কত বড় পজ়িশনে আছেন। আজকালকার দিনে একটু এক্সপোজ়ার না হলে কি চলে? অনিমেষদার হেল্প না পেলে মুশকিল ছিল। অজ পাড়া-গাঁয়ে এতগুলো গণ্ডমুর্খ
বাচ্চা...জীবনে যে কী করবে, কে জানে! চিন্তার শেষ নেই। সপ্তাংশুদা? শুনছেন? কী ভাবছেন?”
ওর শেষের কথায় আমার সংবিত্ ফিরল। একটু এগিয়ে এসেছিলাম আমি।
ভাবছিলাম,
বাবার ছেলে ঠিক কে, আমি? না কি বিমল?
প্রশ্নটা করেই ফেললাম, “আচ্ছা, বিমলেন্দু,
তখন তুমি কোন ক্লাসে পড়তে?”
কখন? সেই প্রশ্নটা করল না বিমল। আস্তে-আস্তে বলল, “ক্লাস ফাইভ। জানেন, গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করেছিল সেদিন, স্যার কিছুতেই মিথ্যাকথা বলেননি। মিথ্যে বলতে পারেনই না উনি।
বিনা দোষে কাউকে কোনওদিন শাস্তি দিতে পারেন না। কিন্তু কী যে হল, গলার মধ্যে মনে হল যেন বঁড়শি ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ...কোনও কথাই
বলতে পারলাম না। সেই পাপের শাস্তি বহন করে চলেছি এখনও! মনে শান্তি নেই...”
আমার কী বলার থাকতে পারে এর পর। বিমল বলল,
“অনিমেষদা আমায় বলেছিল আপনি এত ব্যস্ত যে, আসতে পারবেন কি না ঠিক নেই। তা ছাড়া আপনার মতো সুপারস্টার নাকি
এধরনের অনুষ্ঠানে এত দূরে আসেন না! কিন্তু আমার মন বলছিল, আপনি ঠিক আসবেন। আসতেই হবে আপনাকে...স্বাধীনতা দিবসে কয়েকটা
অসহায় বাচ্চা আপনাকে ডেকেছে। স্যারের ছেলে হয়ে আপনি সেখানে আসবেন না? কী করে হয়! বাঘা যতীনের ভূমিকায় আপনি যে এত ভাল অভিনয় করলেন, সেটা কী করে সম্ভব হল? স্যারের ছেলে বলেই না! কী দাদা, আমি ঠিক বলিনি?”
ও জানে না যে, একেবারেই ঠিক বলেনি বিমল। আপনারাও জানেন, এখানে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। স্রেফ অনিমেষ...তা ছাড়া
বাঘা যতীনের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছি আমি। বহু জায়গা ঘুরে এটা নিয়ে প্রচারও করেছিলাম।
এই ডাকটা ফিরিয়ে দিলে সেটা যদি আমার ইমেজে কোনও কালোছাপ ফ্যালে? এতসব কথা ভেবেই আজ এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি আমি। কিন্তু চিরকাল
কম্পিটিশন করা সপ্তাংশু, যে কি না বাংলা সিনেমার শেষ কথা, যার একটা বাইট পাওয়ার জন্য গোটা শহর হামলে পড়ে, আজ কি না একটা সাধারণ মফসসলি ছেলের কাছে গো হারান হারছে? তার সামনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছে? উজ্জয়িনীর পর কি এবার আমি শৈশবের আয়নায় এসে দাঁড়ালাম? সময় কি এখন আমাকে প্রশ্ন করবে, কোন পরিচয়টা নিয়ে বেঁচে থাকা ভাল ছিল সপ্তাংশু মুখোপাধ্যায়, তোমার এই অভিনয়ের প্রথম স্থান, মুখোশের আড়ালে মুখ নাকি অনাদিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে?
“সপ্তাংশু একবার এদিকে আয় প্লিজ়। তিন্নিকে আমি ডেকে-ডেকে আনতে
পারছি না। কাদা মেখে কী কাণ্ড করেছে নিজে গিয়ে দ্যাখ একবার!”
পিছন ফিরে দেখি অনিমেষ একটু অপরাধীগোছের মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
বিমল বলল,
“কী হয়েছে দাদা?”
দেখবি আয় বলে অনিমেষ আমাদের নিয়ে গেল পিছনদিকের বাগানে। দেখি, তিন্নি আর একটা বাচ্চা ছেলে মিলে মাটিতে বসে একতাল কাদার মধ্যে
এটা ছোট্ট পতাকা পুঁতে চলার চেষ্টা করছে। আমাকে দেখেই একগাল হাসল তিন্নি, পতাকাটা দেখিয়ে বলল “বাবা, স্বাধীনতা!”
তিন্নির মুখে কি আস্তে-আস্তে বাবার মুখটা সুপার ইম্পোজ় করে
বসিয়ে দিচ্ছে কেউ? চোখটা এত জ্বালা করছে
কেন?
আমি তো গ্লিসারিন আনিনি সঙ্গে...
(পুনঃপ্রকাশ)
বেশ ভাল গল্প ।মনে রাখার মত
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteখুব স্বাদু গদ্য তোমার।
ReplyDelete