Saturday, August 11, 2018

স্বাধীনতার আলো অন্ধকার : প্রবুদ্ধ বাগচী


ক্রোড়পত্র






যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অরবিন্দ ভবনের দোতলায় যেখানে উপাচার্যের ঘর, তার সামনের চওড়া করিডরে বিক্ষোভ চলছে পড়ুয়াদের। মেঝেতে একটা শতরঞ্চি কিংবা ডেকোরেটরের কার্পেট বিছানো থাকলেও প্রচুর ছাত্রছাত্রীর এলোমেলো ও উত্তেজিত ভিড়ে সেই কার্পেট দুমড়ে-মুচড়ে একাকার। তাতে কী ? তাজা তরুণ পড়ুয়াদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই তাতে। এই আশ্চর্য এক প্রতিবাদী জমায়েতের একপাশে বেশ খানিকটা হাঁ-করা দৃষ্টি নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক সদ্য উচ্চমাধ্যমিক-পেরোনো কিশোর । সে এসেছে তার বাবার সঙ্গে এই নামী শিক্ষাসত্রে ভর্তি হতে। প্রাথমিক নির্বাচনপর্ব, মেধা তালিকা, কাউন্সেলিং টপকিয়ে টপকিয়ে অবশেষে তার নাম টাঙানো হয়েছে একতলায় ভর্তির অফিসের সামনের বারান্দায় জাল ঘেরা নোটিশ বোর্ডে।
সেসব অনেককাল আগের কথা । হয়তো বা তখন কলকাতার বাতাসে এত এস পি এম ছিল না, ছিল না কলকাতার মুখ ঢেকে ফেলা এমন ফ্ল্যাটবাড়ির স্পর্ধা, মেট্রো রেল তখনও মাটির তলায় চাপা পড়া একটা অজানা বিস্ময়  কখনো বা রাসবিহারী আভিনিউ-এর বুলেভার্ড ধরে দুরন্ত দুপুরে দস্যি বালকের মতো  ছুটে আসত ট্রাম, বাসের সবথেকে কম ভাড়া ছিল পঁয়তাল্লিস পয়সা আর ছিল ছোবড়াভরা উত্তল বসার গদি । মাথার ওপরের হুস-করা উড়ালপুল তখনো পার্কসার্কাস সাতমাথা, গড়িয়াহাট বা রবীন্দ্রসদনের লাবণ্য শুষে নেয়নি, তখনো এইট বি রুটের এক আশ্চর্য দোতলাবাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে ছেড়ে গোটা কলকাতা ঘুরে হাওড়ায় পৌছাতো । তবুও ভর্তির সব ধাপ পেরিয়ে যাদবপুরে চূড়ান্ত ভর্তি হওয়ার আগেই গোটা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উত্তাল। পড়ুয়াদের একমাত্র দাবি ছিল সমস্ত ধরণের কোটা প্রথার অবসান। এই সূত্রেই সেই মফসসল থেকে উজিয়ে যাদবপুরে ভর্তি হতে আসা কিশোর জানতে পারে এই নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রী বা প্রাক্তনীদের জন্য রয়েছে সংরক্ষিত আসন আর সেই কোটার সুড়ঙ্গ দিয়ে অনেক অবাঞ্ছিতের আনাগোনা । তাই প্রতিবাদ। তাই বিক্ষোভ। কিন্তু এই বিক্ষোভ প্রতিবাদের আদল ঠিক তার দেখা রাজনৈতিক সমাবেশের ধাঁচের থেকে আলাদা । একেবারে স্ফূর্তছন্দে পড়ুয়ারা হাতে তালি দিয়ে গান গাইছে, সেই গানের উত্তাপের কাছে স্লোগান কখন যেন গৌণ হয়ে গেছে ।আর ওইদিন ভর্তি নিয়ে উদ্বেগ ও জটিলতার আবহেই সে শুনে ফেলে একটা গান, যে গান এর আগে সে কোনোদিন শোনেনি। গানের প্রথম লাইনেই ছুঁড়ে দেওয়া হয় একটা প্রশ্ন : বল ইস্কুলে গিয়ে তুই শিখলিটা কী ? তার উত্তর আসে : আমাদের দেশ ছিল আগে পরাধীন / গান্ধিজি এসে তাকে করলে স্বাধীন ! এইভাবে এগিয়ে চলে সেই গান আর পরতে পরতে ছড়িয়ে রাখে বিস্ময় --- নিখাদ নির্ভেজাল এক অবাক আলোর লিপি । সেই কিশোরের ভিতরে ভিতরে ব্যাপিত হয় গানের শ্লেষ, বজ্র-বিদ্যুৎ-ভর্তি তির্যক পঙক্তি ।
অনেক পরে সে নিজের মতো করে ভেবে দেখতে চেয়েছে এই মেটামরফসিসের ভিতরের রসায়ন ঠিক কোথায় ? কারণ একদম শিশুবেলা থেকে আরো পাঁচজনের মতোই সে দেখে এসেছে, স্বাধীনতা মানে আসলে একটা ছুটির দিন, যেদিন সকালে যেতে হয় স্কুলের মাঠে ---- হেডদিদিমণি , পড়ে হেডস্যার, একটা বেদীর ওপর দাঁড় করানো বাঁশের মাথায় পতাকা তোলেন, ব্যান্ড বাজে ; ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা অথবা উঠগো ভারতলক্ষ্মী। তারপর জয় হিন্দ, জনগণমন এবং লুচি বোঁদের প্যাকেট। এই অনুষ্ঠান ফুরিয়ে গেলেই স্কুলের মাঠে নেমে পড়ে দুই দল ---- একদিকে মাস্টারমশাইরা অন্যদিকে উঁচু ক্লাসের ছেলেরা । দুইদলের মধ্যে শুরু হয় ফুটবল ম্যাচ। শ্রাবণমাসের জলকাদা থই থই মাঠ --- চেনা ভূগোল স্যার অথবা জীবনবিজ্ঞান আছাড় খেয়ে পড়েন --- মাঠে হাসির রোল ওঠে। স্বাধীনতা। স্বাধীনতা দিবস।
যদিও বেড়ে ওঠার পাশে পাশে এই স্বাধীনতার গল্প ও রোমাঞ্চ বেশ কয়েকবার ধাক্কা খেয়েছিল যার কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা সে খুঁজে নিতে পারেনি। একটা ঘটেছিল সর্বভারতীয় রেল ধর্মঘটের দিন রাতে। তাদের মফসসলের বাসাবাড়ি আক্রান্ত হয়েছিল দুষ্কৃতীদের হাতে। আর তার শিকার হয়েছিল সেই বাড়ির নিচের তলায় থাকা তাদের পরিবারটিই । রাত এগারোটায় রাস্তার ধারের জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ধারালো বর্শা যে জানলার পাশেই বিছানায় ঘুমিয়ে কাদা হয়ে ছিল সেই অমল বালক। বালিশ ও বিছানার আড়াল তাকে সেই যাত্রায় বর্শাবিদ্ধ হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয় কিন্তু সারা বাড়ির ওপর পড়া মুঠো মুঠো বোম এবং তাদের স্প্লিন্টারে ছেয়ে যাওয়া উঠোন সঙ্গে কাঁচের বোতল, পাথরের টুকরো ---- এক নাম না-জানা ট্রমায় সে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আর ঠিক তার পরের দিন যখন সেই বাড়ি ছেড়ে তাদের চলে যেতে হয় অন্য এক আশ্রয়ে তখন সে কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারে না, কেন এমন হল ? এতো স্বাধীনতার উল্টোপিঠ !
অথবা তার মনে পড়ে আরেক স্বাধীনতার দিনের কথা, যার অল্প আগেই সে বড়দের মুখে শুনেছিল এক আশ্চর্য শব্দ ‘ইমারজেন্সি’ --- এতকাল লাল আলোয় লেখা যে শব্দ সে দেখে এসেছে হাসপাতালের গেটে। এই শব্দের মানে সে বোঝেনি শুধু শুনেছে এখন নাকি ট্রেন ঠিক সময়ে চলে আর তাই তার কলকাতায়-চাকরি-করতে-যাওয়া বাবাকে দেখেছে সকালে উঠে শশব্যস্ত হয়ে অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে। এরও কয়েকবছর আগে, তার মনে পড়ে, তাদের পাড়া ঘিরে থাকত খাকি উর্দি একদল বন্দুকধারী, তাদের বলে সি আর পি ---- রোজ তাদের ঘিরে-রাখা এলাকা পেরোনোর জন্য তার বাবাকে অনুমতিপত্র নিয়ে আসতে হয়,  এই কথা সে শুনেছে ঘরের ভিতর । এটাও কি ঠিক স্বাধীনতা ?  কেমন স্বাধীনতা ? তার কাছে সব যেন তাল কেটে যায় ।
অবশ্য এরই পাশে পাশে আরেকটি দিন । সেই স্বাধীনতার দিনটায় তার বাবা তাকে নিয়ে গিয়েছিল কলকাতায়। সেদিন সারা শহর ছিল আলোয় সাজানো । তারা এসেছিল ধর্মতলায় । ট্রাম গুমটি, এসপ্ল্যানেড মোড়, দূরে পার্ক স্ট্রিট, এদিকে রাজভবন সব আলোয় ঝলমল করছে। সেটা কি স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ? মনে পড়ে না । শুধু মনে পড়ে সন্ধের মুখে শহর জুড়ে নেমেছিল প্রবল বর্ষণ, সে কী জলের তোড়--- যেন প্রলয় এসে তছনছ করে দিতে চায় এই সাজানো শহরের সমস্ত বৈভব ! ডেকার্স লেনের মুখে গাড়ি বারান্দার নীচে সেই নাবালক শক্ত করে হাত ধরে ছিল তার বাবার, আর তার বাবা রুমাল দিয়ে ঘড়ি আড়াল করে তাকে কাছে টেনে নিচ্ছিল, যাতে বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচানো যায় তাকে। রাস্তার ওপারে ট্রামগুমটি ঘিরে গাছগুলো স্নানের আনন্দে মাতোয়ারা, তার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা স্তব্ধ যাত্রীবিহীন ট্রামগুলো চুপচাপ ভিজে চলেছে একটানা । বৃষ্টির বেগে রাজভবনের আলোগুলো ক্রমশ আবছায়া। অকালসন্ধ্যা নেমেছে শহর বিছিয়ে। কাকভেজা হয়ে তারা বাড়ি ফিরেছিল সেইবার।
২.
আবছায়া স্মৃতির ক্যানভাস থেকে আলোকিত স্বাধীনতাজয়ন্তীর যে উদ্ধার, সমস্যা হল, যখন একটু একটু করে জ্ঞানবুদ্ধি পাকতে শুরু করল --- ধরা যাক, মাধ্যমিকের আশপাশ—তখন সে তার বাবার মুখেই শুনতে পায় প্রথম যৌবনে তার পিতৃদেবের কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে সম্পৃক্তির কথা ও কাহিনি। ১৯৫৯-এর আগস্ট মাসের শেষ দিনে, যেদিন খাদ্য আন্দোলন ঘিরে গোটা ধর্মতলা চত্বর জনসমুদ্রে উত্তাল সেইদিন সেই সমাবেশের মধ্যে ছিল তার বাবাও --- সেদিনের বেপরোয়া পুলিশি সন্ত্রাসের ফলশ্রুতি এসে পড়েছিল তাঁরও বাঁ হাতের কবজিতে । লাঠির ঘায়ে ভাঙা কবজি আর কাঁদানে গ্যাসের চোখ ঝাঁঝাঁনো তীব্রতায় বিপর্যস্ত এক প্রতিবাদী যুবক ডেকার্স লেন ধরে দৌড়াচ্ছে খানিকটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে --- তার পেছনে ছুটে আসছে স্বাধীন দেশের পুলিশ ! হিসেব করলে তখন স্বাধীনতার বয়স মাত্রই বারো । তার হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছিল আবারও --- কারণ তার সম্পর্কিত এক জ্যাঠামশাই যিনি ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবে দীক্ষিত ---- তার কাছে সে গল্প শুনেছিল বিয়াল্লিশের আন্দোলনের সময় কীভাবে দিনের পর দিন তিনি পুলিশের চোখ এড়িয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন এক গ্রাম থেকে অন্যত্র, কখনো ছদ্মবেশে, কখনো পুলিশকে বোকা বানিয়ে। তাদের আরাধ্য ছিল একরকম স্বাধীনতা, উপনিবেশের শাসন থেকে মুক্তি। কিন্তু সেই রোমাঞ্চিত প্রায়-রূপকথার সঙ্গে কি মেলে স্বাধীন দেশের পুলিশের প্রতিবাদী নাগরিকের ওপর নির্মম লাঠি গ্যাসের ছবি ? এগুলো তো কোথাও একটা ভাবনার আগ্নেয়গিরিকে খুলে দেয় ---- মাধ্যমিকের কিরণ চৌধুরীর ইতিহাস বইয়ে তো এগুলো লেখা ছিল না ! সেই উন্মীলিত বালকের কাছে তখন ইতিহাস বলতে কিরণ চৌধুরী !
গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নোয়াম চমস্কি একবার বলেছিলেন, বৃহত্তর গণতন্ত্রের বিচার করতে গেলে আগে দেখতে হবে মাইক্রোলেভেলে গণতন্ত্রের চেহারাটা কেমন অর্থাৎ দেশের গণতন্ত্র বুঝতে গেলে দেখতে হবে পাড়ায় পাড়ায় গণতন্ত্র আছে কি না স্বাধীনতাএই বিরাট সাইনবোর্ডের ব্যঞ্জনা খুঁজতে গেলেও বোধহয় ভাবা  দরকার একেবারে ব্যক্তিগত মনের অন্দরে ঠিক কী অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে যদি সেই বেড়ে-উঠতে-থাকা বালকের অভিজ্ঞতার নিরিখে বিচার করতে হয় তাহলে মনে করে নিতে হবে আরও কিছু তথ্য উচ্চমাধ্যমিকের আওতায় এসে যখন তার বাবার সঙ্গে তার বিনিময় আরও সহজ ও ঘন তখনই সে শোনে কয়েকটি গানের কথা , বাবারই মুখে সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে নাকের বদলে নরুন পেলাম টাকডুমাডুম/ জান দিয়ে জানোয়ার পেলাম লাগল দেশে ধুম’ , হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্য’ --- পাশাপাশি একটা স্লোগানের কথাও শোনা গেল : ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়/ভুলো মত ভুলো মত আর যাদবপুরের নতুন ক্লাসে প্রথমদিনই সবাইকে চমকে দিয়ে তার এক সহপাঠী সোচ্চারে পড়ে শোনালো এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না আমূল বিস্মিত হতে থাকে সেই কিশোর এর পড়ে সিরিয়াল ব্লাস্টের মতো তার সামনে এসে পড়েন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি বলবেন ক্ষুধার সামনে দুটো আধপোড়া রুটির জন্য হেসে দিতে পারি স্বদেশেরও স্বাধীনতা’, মণিভূষণ ভট্টাচার্য লেখেন বেকারের চিঠি সুবর্ণরেখাআর মেঘে ঢাকা তারাদেখে তার সংবেদী মন ভরে ওঠে বেদনায় আর যুক্তি তক্কো আর গপ্পোতে নীলকণ্ঠ বাগচী যখন নন্দন প্রেক্ষাগৃহের প্রকান্ড পর্দায় ক্যামেরার চোখে চোখ রেখে বলেন বুর্জোয়া ডেমোক্রেসি ? ফুঃ !’ তার মনে হল কৈশোর থেকে তারুণ্যের পথে বেরোনোর আগে অনেক কিছু হিসেব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, অনেক কিছু মিলছে না অন্তত এতদিন যা যা সে জেনে এসেছে স্কুলে বা স্কুলের বাইরে অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতূহল, অমীমাংসিত একবুক রহস্য তাহলে স্বাধীনতাব্যাপারটা ঠিক কী ? সেই কি তাহলে ওই আমাদের দেশ ছিল আগে পরাধীন/ গান্ধীজী এসে তাকে করলে স্বাধীন   ----- সব ইস্কুলেই কি তাহলে একই গল্প শেখানো হয় ?
সে বাইরে তাকিয়ে দেখে কেন্দ্রীয় সরকারে তখন জাতীয় কংগ্রেস দল, রাজ্যে একটি তথাকথিত বামপন্থী মতাদর্শের সরকার কিন্তু নয়াদিল্লীর সরকারের স্লোগানে নেহেরু গান্ধীর জয়ধ্বনি, রাজ্যের সরকারের সামনে মার্ক্স এঙ্গেলস লেনিন স্ট্যালিন কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে এসে বলেন সব কারখানা তিনি খুলে দেবেন আর রাজ্য তখন হলদিয়া আর বক্রেশ্বর কারখানা নিজেরাই খোলার লক্ষ্যে মরিয়া এর সঙ্গে স্বাধীনতার কী যোগ তার ধারনায় কুলোয় না কিন্তু প্রায় অকস্মাৎ এক যোগাযোগ ও বেপরোয়া কৌতূহলে তার সামনে এসে পড়ে এক সুযোগ রাজ্যের একের পর এক কারখানা তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের প্রকৃত অবস্থা নিজে চোখে দেখার নিবিড় সুযোগ ঘটে যায় তার এ যেন এক নতুনভাবে দেখা স্বদেশ ও সমাজকে , যার ছবি এতদিন ছিল তার চোখের অন্তরালে ক্রমশ সে বুঝতে পারে গান্ধীবাদী ও মার্ক্সবাদীদের সঙ্গে আদপে গান্ধীজি ও কার্ল মার্ক্স সাহেবের দূরত্ব আসলে কত আলোকবর্ষ সমান্তরাল অনুভবে চওড়া হয়ে আসে স্বাধীনতার সংজ্ঞা ঘিরে অতলান্ত প্রশ্নমালা
৩.
সেইসব অমীমাংসিত প্রশ্নমালা থেকে যেসব সিদ্ধান্তের কিনারায় দাঁড়ানো তার অন্যতম তো এই যে একটা দেশের ভিতর আসলে আরও অনেক দেশ এবং নানারকম স্বাধীনতার খাঁচা । যে স্বাধীনতার দাপটে একজন মিল মালিক তার কারখানা বন্ধ করে দেন সেই স্বাধীনতাই আসলে কেড়ে নেয় বন্ধ কারখানার মজুরদের বেঁচে থাকার অধিকার । আমজনতার ভোটে জেতা ‘জনপ্রতিনিধি’ যে স্বাধীনতার বলে ‘কালো বিড়াল’ পরিবেষ্টিত হয়ে পথে ঘোরেন , সাধারণ নাগরিকের কোনও স্বাধীনতাই নেই সেই মহামহিমের কাছে পৌছানোর । কৃষক তার নিজের জমি দখলে রাখার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে যখন রাষ্ট্র বা তাদের বকলমে কোনও বহুজাতিক সেই জমি দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে। দেশের শাঁসালো নাগরিক সর্দি-গর্মি হলেও স্বাধীনভাবে সেঁধিয়ে যেতে পারে ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট হাসপাতালের শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে অথচ ওই হাসপাতালের সামনের রাস্তায় যে চায়ের দোকান চালায় তার কোনও স্বাধীনতাই নেই গুরুতর রোগেও ওই চিকিৎসালয়ে পরিষেবা পাওয়ার। বিপুলাকার শপিং মল বা খাদ্য বিপণিতে যারা কারণে-অকারণে এসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করতে পারে তাদের দৈবাৎ চোখে পড়ে যায় বিপণির সামনে ধূপকাঠি বিক্রেতা মলিন ছেলেটিকে, তার পণ্যের দামে ওই বিপণিতে এক গেলাস জলও পাওয়ার উপায় নেই। কেন ? সমস্যাটা তাহলে কোথায় ? এই ভাবনার অতলে ডুবলে চিনতে পারা যায় এক অসীম বৈষম্যের মানচিত্র । প্রকান্ড সেই মানচিত্রের প্রাকার ও প্রান্তর। দেশের মানুষের মধ্যে তুমুল আর্থিক অসাম্য, আয়ের অসম বন্টন ; এলাকায় এলাকায় আঞ্চলিক উন্নয়নের বৈষম্য, সামাজিক চেতনার উচ্চাবচতা, ধর্ম ও সংস্কৃতির তফাৎ --- এই বৈচিত্র্য কোনও ঐক্যের কথা কি সত্যিই বলে ? বলতে পারে ? যে প্রতিদিন দুমুঠো খেতে পায় না তার সঙ্গে কি ঐক্যের রাখী বাঁধা যায় কোনও ক্রোড়পতির ? সেই তরুণের মনে হতে থাকে এই অখণ্ড সমতল স্বাধীনতার ধারনা  ও নির্মাণ আসলে আড়াল করে এই ব্যাপ্ত মলিন, খন্ডিত, বৈষম্যঘেরা বাস্তবতাকে , ঠিক যেমন উজ্জ্বল দেবীপ্রতিমার কাঠামোর পেছনে থেকে যায় জৌলুষহীন খড়ের কাঠামো । এক উঠতি তরুণের কাছে স্বাধীনতার মানে পালটে যেতে থাকে কেবলই । এক দেশ, অনেক স্বাধীনতা ।
কিন্তু এই বৈষম্যের নিগড় থেকে বেরিয়ে কীভাবে আসতে পারে এক সার্বজনীন স্বাধীনতা ? যে স্বাধীনতার আড়ালে কোনও কান্না নেই, বেদনা নেই, বঞ্চনার সূচিমুখ নেই, নেই অসংখ্য না-পাওয়ার হাহাকার ! এইসব খুঁজতে খুঁজতে সেই তরুণ পৌঁছে যায় এক নতুন স্বপ্নের কিনারায়। নানারকম মতবাদের পলেমিক্স থাকলেও একটা সময় সে বিশ্বাস করতে শেখে এইসব বৈষম্যমুখর এলোমেলো অন্ধকারের দিন পেরিয়ে কোথাও রয়েছে এক সমস্ত অবনত মানুষের সমানাধিকারের ঠিকানা, মুক্ত মানুষের জন্য এক স্বপ্নিল উপত্যকা, সব-পাওয়ার সব-চাওয়ার এক এল-ডোরাডো। আর সেই ঠিকানায় স্বাধীনতা শব্দটি তার গভীরতম ব্যঞ্জনা নিয়ে জেগে থাকে, অন্তত জেগে থাকার প্রত্যাশা করে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে-পরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও যেসব স্বাধীনতার লড়াই জিতে নিয়েছে তারই কোথাও কোথাও তৈরি হয়ে গেছে সেই স্বপ্নসম্ভব উপাখ্যান । রুশ বিপ্লবের পর দেশেদেশে এই বার্তার বিস্তার ঘটেছে, শ্রেণিবৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষের হাতে ক্ষমতার অধিকার তুলে দেওয়া সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সোভিয়েতের গর্বিত জয় এই আস্থাকে দৃঢ়তর করে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে একটা উৎক্রান্তির দিকে। পরে চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও  ভিয়েতনাম -লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গেরিলাযুদ্ধ স্বপ্নচারী মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে আরও সমৃদ্ধির উপকরণ । এইসব টুকরো স্বপ্ন তো ফুটতে চেয়েছে এইদেশের মাটিতেও, সেই স্বপ্নের অঞ্জন এসে লেগেছে ইতিমধ্যে তারুণ্য থেকে প্রথম যৌবনের দিকে হাঁটা লাগানো সেই বালকের চোখেও। শুধু পতাকা তোলা আর ব্যান্ডের সুর মানে স্বাধীনতা নয় ---- স্বাধীনতা মানে নতুন একটা পৃথিবী , পাশাপাশি থাকা মানুষের এক নতুন বিভেদহীন জাতি । এমনই ‘একটা পৃথিবী চাই, মায়ের আঁচলের মতো / আর তাতে যেন গান থাকে, যখন শিশুদের ঘুম পায়’
৪.
সময় গড়িয়ে চলে তার নিজের নিয়মে । বদলে যায় দেশ-কাল-সভ্যতার প্রেক্ষাপট। কালকের মতাদর্শকে আজ মনে হয় সংস্কার । নতুন নতুনতর ভাবনা এসে জড়িয়ে ধরে মানবচিন্তন । এইভাবেই এক সদ্যযুবকের চোখের সামনে থমকে দাঁড়ায় সোভিয়েত, ভেঙে পড়ে পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েতব্লক । পথ পাল্টায় মাও সে তুং এর চিন। সারা দুনিয়ার সামনে যে মানবমুক্তির শিখা জ্বলে উঠেছিল এই পতনের অন্তরালে অজস্র স্বপ্নের শব্দহীন সমাধি ঘটে যায় অচিরেই। কবি অরুণ কুমার সরকার লিখেছিলেন, ‘স্থবিরতা কবে তুমি আসিবে বলো তো’ --- তবে কি মানুষের এত বছরের সভ্যতা স্থবির হয়ে গেল এইবার ? এই সব বিষণ্ণ ভাবনার পাশে পাশেই এসে পড়ে  বিশ্বায়নের ঝোড়ো হাওয়া, অবাধ পুঁজির লাগামহীন চলাচল, অভাবনীয় প্রযুক্তির বিস্ফোরণ । কিন্তু এই ঝড় সাময়িক থেমে যেতেই দেখা গেল দেশের আর্থিক সার্বভৌমত্ব যেমন শিথিল তেমনি গোকুলে বেড়ে উঠছে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ । ১৯৯১ সালের এপ্রিলে ঘটা করে ঘোষণা হল দেশের নতুন আর্থিক নীতি যা আসলে উন্মুক্ত অর্থনীতির অনুবর্তী আর তার দেড় বছরের মধ্যে মৌলবাদীদের অস্ত্রের আঘাতে গুঁড়িয়ে গেল দেশের অন্যতম প্রাচীন সৌধ , পাশে পাশে ধেয়ে এল সাম্প্রদায়িক হানাহানির কলুষ । মানুষের মৌলিক চাহিদাকে পেছনে ফেলে তার ধর্মীয় পরিচয় ও দাবিই হয়ে উঠতে লাগল রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। থাবা গেড়ে বসছে হিন্দি হিন্দু ফ্যাসিজম, পাল্টে দিচ্ছে প্রতিবেশীর মন মেজাজ মানসিকতা ---- নাগিনীদের সেই বিষাক্ত নিঃশ্বাসে বাতাস ক্রমশ ভারী । বিভ্রান্ত যুবক ইতিহাসের পাতা ওলটায় । হ্যাঁ, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস সাম্প্রদায়িক হিংসার রক্তে ক্লেদাক্ত, স্বাধীনতার গায়ে লেগে আছে দেশভাগের হাহাকার । তাহলে কি ইতিহাস প্রস্তুত হচ্ছে নিজেকে পুনরাবর্তিত করার ? অন্যপক্ষে বিশ্বায়নের তালে তাল দিয়ে পুঁজির জয়ঢাক বেজে চলেছে চড়া ডেসিবেলে--- বিদেশি পুঁজির পায়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া দেশের সামনে কোনও নাকি বিকল্প নেই, সুতরাং তাদের পায়ের কাছে আজানু প্রণত দেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলিকেও । আর এই বশ্যতার দশচক্রে স্বাধীনতার অন্য একটা প্রান্ত খুলে গেল তার সামনে । অবশ্য সেটাকে স্বাধীনতার বদলে কেতাবীভাষায় বলা যায় ‘চয়েস’ ।
চয়েস, অর্থাৎ  আমার দেশের সমস্ত নাগরিক খেতে-পরতে পাবেন কি না সেই প্রশ্ন গৌণ কিন্তু তার খাওয়ার জন্য এখন দশটার জায়গায় একশো দশটা ঠিকানা , পরনের পরিচ্ছদের জন্য হাজারো ব্র্যান্ড, শিক্ষার জন্য নামমাত্র সরকারি ব্যবস্থার পাশাপাশি বিপুল বেসরকারি বিনিয়োগ, চিকিৎসার জন্য ক্লিন্ন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পাশাপাশি ঝাঁ চকচকে বেসরকারি হাসপাতাল । দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ সেখানে পৌঁছাতে পারবেন কি না তার থেকেও বুক বাজিয়ে বলার কথা তার সামনে অনেক চয়েস --- ঠিক যেন কলসির তলায় রাখা মাংসের টুকরোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুধার্ত শৃগাল ! স্বাধীনতা । বিলাসবহুল বিপণিতে  অবাধ কেনাকাটার স্বাধীনতা ও কিছুই না-কিনতে পারার ব্যর্থতায় নিজের প্রয়োজনকে সংকুচিততর করার স্বাধীনতা । দামী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার স্বাধীনতা ও বিনা চিকিৎসায় স্বর্গলাভের স্বাধীনতাস্যাঁতস্যাঁতে প্রাইমারি স্কুলের চালাঘরের নীচে পড়ুয়াদের বিনি পয়সার শিক্ষা পাওয়ার স্বাধীনতা ও শীততাপনিয়ন্ত্রিত ক্লাসঘরে নার্সারি শিক্ষার জন্য নিজেদের সন্তান-সন্ততিকে পাঠানোর স্বাধীনতা । আর যেহেতু এই বৈষম্যকে সেতুবন্ধনের একমাত্র দাওয়াই  প্রতিযোগিতা, প্রতিযোগিতা এবং প্রতিযোগিতা --- সুতরাং এর সঙ্গে জুড়ে যায় দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটবার স্বাধীনতা! পাশের মানুষকে লেঙ্গি মেরে, প্রবঞ্চিত করে, নিজের আখের গোছানোর স্বাধীনতা । কে থাকল কে মরল কে কী ভাবল ওসব ঠুনকো ভাবনা এখন অবান্তর নির্বুদ্ধিতা ---একমাত্র উদ্দেশ্য ও বিধেয় টাকা করো, নিজের পুঁজি নিজের হাতে গড়ে তোলার অবাধ স্বাধীনতা-- হোক গে সেই রাস্তা অন্ধকার আবছায়া --- সেই মোহানায় পৌঁছেই তো বিলাসী গাড়ির চাবি, ঠান্ডা রেস্তোরায় চেয়ার, প্রকান্ড বিপণির চলমান সিঁড়িতে ওঠার ছাড়পত্র ! পড়ে মরুক গে দেশ, মরুক অর্থনীতি, মরুক গরিব মানুষরা । রুটি না পেলে কেক খেলেই তো পারে !
এই সমস্তটাই এক বিষণ্ণতার আখ্যান। স্বাধীনতার লড়াইয়ে জুড়ে ছিল যে মহত্ব আর ত্যাগের ছোঁয়াচ এর সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। যে আত্মসম্মানের অকুতোভয় আদর্শে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত সেনানীরা ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়েছিলেন, কোটি কোটি স্বাধীনতাকামী মানুষ সর্বস্ব পণ করে সেই যজ্ঞের আগুন জ্বেলে রেখেছিলেন তাদের মত ও পথের পার্থক্য থাকলেও উদ্দেশ্য অভিমুখ ছিল অভিন্ন । আর স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের সবথেকে বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িক দলটির সর্বভারতীয় সভাপতি যখন ক্যামেরার  সামনে যুদ্ধাস্ত্র কেনার দালালির টাকা গুনে নিলেন এবং গোটা আসমুদ্রহিমাচল সেই রোমাঞ্চিত দৃশ্য দেখলেন তখন মুহূর্তে বদলে যায় স্বাধীনতার মানে, বদলে যায় যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ঠাকুরঘরের দেব সিংহাসনের তলায় আবিষ্কৃত হয় নোটের বান্ডিল , টাকাভর্তি ব্রিফকেস পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষুধার্ত দেশের তালিকায় যখন আমার দেশের নাম উঠে যায় উঁচু তালিকায়, দেশের প্রতি দুজনে একজন মানুষ খেতে পান না বলে জানা যায় তখন এই প্রশ্ন না উঠে পারে না , দেশটা তাহলে কাদের ? যারা ‘আচ্ছে দিন’ এর আড়ালে গোপন যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করে নিজের পছন্দের সংস্থাকে মিলিয়ন বা বিলিয়নের উপঢৌকন দিচ্ছেন বা জনগণের সঞ্চিত অর্থ অবাধে আত্মসাৎ করতে উৎসাহিত করছেন ঋণখেলাপি শিল্পপতিদের নাকি সেইসব অভাবী কৃষকদের প্রতি তেইশ মিনিটে যাদের একজন করে আত্মঘাতী হচ্ছেন বা  প্রতি বছর নানান অসংগঠিত ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ কর্মচ্যুত মানুষ, যাদের সামনে কোনও বিকল্প জীবিকার সন্ধান নেই ?
অসাম্যের অবসান হয় না অথচ নাকি দেশ এগোয় । সেই রথের চাকায় কারা তেল জোগায় জানা যায় না । মন খারাপ হয়ে যায় সেই যুবকের, দীর্ঘশ্বাস এসে পথ জুড়ে দাঁড়ায় বারবার । তবু সময় থেমে থাকে না। এইসব টানাপোড়েনের মধ্যেই সে মুখোমুখি হয় এক অন্য অভিজ্ঞতার। টাইমলাইন : ডিসেম্বর ২০০৮, কলেজ স্ট্রিটের মহাবোধি সোসাইটি সভাঘর । সেই সভায় বক্তব্য রাখতে এলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিক ডঃ অমিত ভাদুড়ি । ততদিনে তার Development with Dignity বেস্ট সেলার যা পড়ে সেই যুবক খুঁজে পাচ্ছে একটা দিশা। সেই সভায় ডঃ ভাদুড়ি জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা । সারা দেশেই তখন ‘কৃষিজমি অধিগ্রহণ’ ও ‘স্পেশ্যাল ইকোনমিক জোন’   বিরোধী গণ-আন্দোলন তুঙ্গে, নতুন অর্থনীতির ‘সংস্কারযুগ’ পেরিয়ে এসেছে দেড় দশক। তিনি বললেন তাঁর দেশব্যাপী ঘোরার অভিজ্ঞতা ---- বললেন, এই গণ-আন্দোলনের অভিঘাত ও বিস্তার বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের থেকে কোনো অংশে কম নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে লড়াই চেহারা নিয়েছে আত্মমর্যাদা ফিরে পাওয়ার । তাত্ত্বিকভাবে তিনি তখন ভাবতে শুরু করেছেন এমন এক উন্নয়নের মডেল যা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অর্থনীতির ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত অথচ মৌলিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির মুনাফাসর্বস্ব প্রবণতার প্রতিস্পর্ধী। অন্তত এমন এক ধারনা যা নিছক জিডিপির গপ্পো না  ফেঁদে  দেশের বেশিরভাগ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের কথা বিচার করতে চায়, যেরকম এক উন্নয়নের স্পর্শে বদলাতে পারে স্বাধীনতার অর্থ।
সে তো প্রায় দশ বছর আগের কথা । তবু সেদিনের সেই সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনি সত্যিই শোনা গিয়েছিল দেশের বিভিন্ন রাজ্যে। কৃষিজমি নির্বিচার অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে কৃষক বিক্ষোভ, এস ই জেড এর প্রতিরোধে আন্দোলন, বেহিসেবী পরিবেশ ভারসাম্য বিরোধী স্বর ক্রমশ আসতে থাকছিল শিরোনামে। অনেক জায়গায় প্রতিবাদীরা প্রতিষ্ঠা করলেন নিজেদের অধিকার, সরকারী নীতির মুখ পাল্টে গেল। কোথাও তারা পিছু হঠলেন। এই কথা ঠিক গত এক দশকে মৌলিক কোনও পরিবর্তন হয়নি বরং হিন্দুত্ববাদীরা দেশ দখল করেছেন, অবাধে ছড়িয়ে চলেছেন বিভেদের বিষ, মতপ্রকাশের অধিকারকে, বিকল্প স্বরকে গলা টিপে মারছেন নানা জায়গায়, ইতিহাসকে পরিকল্পিতভাবে গুলিয়ে দিচ্ছেন, বিকৃত করছেন। ঠিক । কিন্তু একইসঙ্গে তারা বিশ্বব্যাপী ক্রোনি ক্যাপিটালের নয়নের মণি হয়ে আগলে রাখছেন তাদের স্বার্থদেশের আমদানি রফতানি ভারসাম্য টলমল, আর্থিক বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর, বিদেশি বিনিয়োগ পড়তির দিকে, বেকারি ও কর্ম সঙ্কোচন বেড়েই চলেছে, বাড়ছে কৃষক বিক্ষোভ, দলিত বিক্ষোভ, জনজাতি বিক্ষোভ। প্রান্তিক মানুষরা লড়ছেন, কৃষকরা গলা তুলছেন, কর্মচ্যুত শ্রমিকরা ঘিরে ফেলছেন শহর, তাঁদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন সাধারণ নাগরিকরাও – তাঁরাও তো সুখে নেই আর। ভাবতে ভাল লাগে এরই মধ্যে কোথাও বাসা বেঁধে আছে নতুন স্বাধীনতার স্ফূটনোন্মুখ আকাঙ্ক্ষা ।
৫.
যাদবপুরের সেই হাঁ-করা কিশোর আজ অর্ধশতক পেরোনো প্রৌঢ় । আজ সে আর মনে করে না ‘আজাদি’ সবটাই ‘ঝুটা’ বা গোটা দেশের সমস্তটাই ‘মৃত্যু উপত্যকা’ । স্বপ্নালু সমাজতন্ত্রের সবটুকুই যে খাঁটি ছিল এই বিশ্বাসও কোথাও টাল খেয়েছে আজ। তাছাড়া মানুষের মুক্তির ইতিহাসে সমাজতান্ত্রিক ধারনার প্রায়োগিক দিক নিয়েও তো নানা নিরীক্ষা ঘটে গেছে ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এখনো চলছে। ‘সর্বশক্তিমান’ কি না জানা না-থাকলেও মার্ক্সবাদের মৌলিক ধারণাগুলি এখনও সজাগ ও সজীব বলেই তার নিবিড় প্রতীতি। তার ভাবতে ভাল লাগে ‘এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে’ আর সেই নতুন মানবমুক্তির পাঠ্যক্রম রচিত হচ্ছে ভিতরে ভিতরে, এই আস্তিক্যে সে খুঁজে পায় এক স্নিগ্ধ মরূদ্যান, এক সজল ছায়ামারীচের বন। ঠিক যেভাবে, আমাদের সকলের অগোচরে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে কোটি কোটি নক্ষত্র, তারা গড়ে নিচ্ছে নিজেদের নিঃশব্দ ছায়াপথ--- আলোময়, বর্ণময়। সে প্রতীক্ষা করে, তার এই ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমিও একদিন সংখ্যাগুরু মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে প্রেমের গান গাইবে। ভাত কাপড়ের বাইরে যে বৌদ্ধিক বিশ্ব সেই নিখিলবিশ্বের নাগরিক হয়ে উঠবে তার দেশের সবাই। ঘোর আকালে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের পাখিদের ডানায় নতুন উড়াল দেওয়ার মন্ত্র --- এইই তার একান্ত স্পর্ধা। একান্ত স্বাধীনতা । There's no short cut to freedom......


No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...