Saturday, August 11, 2018

সত্তর বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি :শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়



ক্রোড়পত্র





স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।

এমনটাই বলেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ভারতীয় ভূখণ্ডে ব্রিটিশরাজের উপনিবেশ বানিয়ে অধিবাসীদের শাসন, অত্যাচার এবং মানবসম্পদ তথা অন্যান্য সম্পদাদি শোষণের প্রেক্ষিতে ওঁর এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা একটু অন্য প্রেক্ষিতে ফেলে দেখি যদি বাক্যটিকে।

পরিপ্রেক্ষিত আহামরি কিছু নয়-- আমাদের দেশের একাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস আসন্ন, আর আমাদের ঐকান্তিক স্বাধীনচেতা সত্তা। 

যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ, রাস্তায় পান-গুটখার পিক প্রক্ষেপ, অবাধে ফিনফিনে প্লাস্টিক ব্যবহার, সাইকেল-ভ্যানের কাঠামোয় মোটরবাইকের ইঞ্জিন জুড়ে বকচ্ছপ ভ্যানো ‘কাটা’ তেলে হাঁকানো, মেয়াদ পেরোনো ইঞ্জিন এবং কাঠামো নিয়ে পাবলিক বাস-ট্যাক্সি চলাচল, অরণ্যে ধূমপান কিম্বা সাগরবেলার কোলের ওপরে হোটেল বানিয়ে পর্যটন ব্যাবসা— এই দুনিয়ায় ভাই সব সত্যি।

এমন উদাহরণ আসলে ধরতাই মাত্র। অজস্র ঘটনা ঘটে চলে আমাদের আশপাশে, যা অনুচিত এবং গর্হিত। সমাজের প্রতি স্তরেই দুর্নীতির ঘুণের বাসা। আমরা সকলেই এমন অনেক অন্যায্য ঘটনা ঘটিয়ে চলেছি। কেউ কম, কেউ বেশি। কিন্তু জীবনে কখনোই করিনি, এমন দাবি করার মানুষ বোধহয় একজনও নেই।   

কেন নেই? থাকাটাই তো স্বাভাবিক ছিল। তাহলে?

অনুসন্ধিৎসু মন পশ্চাদ্গামী হতে চায়। ভারতীয় ভূখণ্ড ভারতীয়দের দ্বারা কমই শাসিত হয়েছে। এবার ভাবুন, আকবরের কি আধার কার্ড ছিল? তাহলে তিনি কি ভারতীয় ছিলেন না। ছিলেনই তো। সেই অর্থে তিনি পরদেশি আক্রমণকারী ছিলেন না। ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা। আবার আকবরের রাজত্বের বাইরেও কিছু এলাকা ছিল, যা আজকের ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেইসব অঞ্চলের মানুষের কাছে আকবর তাঁদের বাদশাহ ছিলেন না, কিন্তু আজকের ভারতের ইতিহাসে আকবর অবশ্যম্ভাবী উজ্জ্বল এক চরিত্র।

‘আকবর’-- এই নামটিতে আটকে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়। বলতে চাইছি, এমন অনেক রাজপুরুষই ছিলেন, যিনি এই ভূখণ্ডের একটি অংশের রাজা, অন্য অংশে আক্রমণকারী। লুঠতরাজও করেছেন হয়তো। আবার প্রতিটি রাজাই কি নিজ রাজ্যের মানুষের কাছে দয়ালু, দানশীল, ধার্মিক, ন্যায়নিষ্ঠ ছিলেন? বেশিরভাগই ছিলেন না।

আজকের ভারতের মানচিত্র নিয়ে যদি আপনি নবযুগ (‘খ্রিস্টাব্দ’ এখন বাতিল শব্দ) থেকে (প্রাক-নবযুগ তথা খ্রিস্টপূর্বাব্দ অনেক প্রাচীন ব্যাপার, ও থাক নাহয়) কোন অংশ কোন সময়কালে কার দ্বারা শাসিত হয়েছিল তা রংবেরঙের পেনসিল নিয়ে আঁক কষতে বসেন তো দ্রুতই সেই মানচিত্র বিচিত্র রঙের এমন এক জবড়জং-এ পরিণত হবে যে মানচিত্রের কাজ আর তা দিয়ে করা সম্ভবই হবে না। একই অংশ কখনো দেশীয় ছোটো প্রশাসক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত শস্যশ্যামলা, কখনো পরদেশি বড়ো প্রশাসকের গ্রাসে শোষিত উচ্ছিষ্ট মাত্র। অথবা উলটোটাও, পরদেশি প্রশাসকের কবলে সুখবিলাস, দেশীয় রাজন্যের চালনায় নাভিশ্বাস।

এক সময় ধীরে ধীরে ব্রিটিশ ছত্রতলে এসে আজকের ভারতের কাছাকাছি রূপ পেল সেই ভূখণ্ড, হিসেবে তখন আঠারোটি শতবর্ষ অতিক্রান্ত। ভূখণ্ডবাসীর নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করেছে আজ এই রাজা, কাল অন্য আরেক রাজা। এবং তাদের বেশিরভাগই প্রজাহিতৈষী ছিলেন না।

এর পরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালের পর্যায় এবং তা নিয়ে সেসময়ের অগ্রগণ্য বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বের বক্তব্য তো এই লেখার ভূমিকাতেই উল্লেখিত।

ছোটো করে বলতে চাইলে, এই যে আমি, আমার পূর্বপুরুষেরা কেউ সুখে বা দুখে জীবন কাটিয়েছেন এই ভূখণ্ডে, কখনো লাহোরে (মুঘল ভারতে > ব্রিটিশ ভারতে > এখন পাকিস্তানে), কখনো বোয়ালমারিতে (পরের দিকের মুঘল ভারতে > ব্রিটিশ ভারতে > এখন বাংলাদেশে), কখনো মহীশূরে (ব্রিটিশ ভারতে নয় > এখন ভারতে), কখনো মুঘলসরাইতে (মুঘল ভারতে > ব্রিটিশ ভারতে > এখনো ভারতে)। এখনকার ভারতবাসীর কোনো এক পূর্বপুরুষের নাম ধরা যাক ক। ক বাবরের ভারতের বাইরে থাকতেন, আবার সেই অঞ্চল পরে আকবরের ভারতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেলে ক-এর পরের প্রজন্মের প্রতিনিধি খ সেখান থেকে টুক করে এমন জায়গায় বসবাস উঠিয়ে নিয়ে গেলেন, যা আজ ভারতে, সেসময় আকবরের ভারতের বাইরে। এই খ-এর পরবর্তী প্রজন্ম আবার ওই অঞ্চলের বসবাস ছাড়লেন, কারণ ততদিনে উহা অওরঙ্গজেবের ভারতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে!       

এভাবে আমাদের শিরায় মজ্জায় তাই আজও বহন করে চলেছি রাজসিংহাসন আলো করে থাকা এক প্রবল রাজকীয় ব্যক্তিত্বকে দেশের মহামহিম মেনে নেওয়া। সিংহাসনের অধিষ্ঠান হোক সুউচ্চ কোনো মঞ্চে। এবার আমরা জনগণমন সেই মঞ্চের নীচে এসে নতজানু হব, অথবা নিন্দেমন্দ করব আড়ালে, অথবা আরেকটু এগিয়ে, বিপ্লব।

কিন্তু রাজন্যবর্গ কখনোই আমাদের সমান হতে পারেন না। তা যতই ব্রিটিশরাজের অবসানের পরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক! আমাদের গণতন্ত্রের প্রতিটি তন্ত্রীই তো রাজতন্ত্রের মন্ত্র দিয়ে বাঁধা। শব্দ, আচরণ, প্রকরণ, পদক্ষেপ— সব, সব।

শুনি পশ্চিমের অনেক গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান মাত্র দু-জন দেহরক্ষী, একটি গাড়ি এবং একজন সচিব পান। আবার এমনও জানতে পারি, আরেক রাষ্ট্রপ্রধান একটি কলেজ অথবা ইউনিভার্সিটিতে সাপ্তাহিক একটি ক্লাস নেন, শিক্ষক হিসেবে সেই নির্দিষ্ট দিন তিনি যাতায়াত করেন তাঁর ব্যক্তিগত সাইকেলে, প্রকাশ্যে।

আমাদের দেশে এমন ঘটনা তো নিরাপত্তার কারণেই সম্ভব নয়। নেতানেত্রীরাও অন্তরে অন্তরে মোটেও চাইবেন না ‘পাবলিক’-দের সমান করে নিজেদের দেখতে, মুখে তিনি যতই জগৎ মারুন। আমরা ‘পাবলিক’-রা ‘ধুস তাই আবার হয় নাকি, ওঁয়ারা সব গণ্যিমান্যি জন, আমাদের সমান নাকি’ বলে প্রায় অজান্তেই কপালের দিকে হাত তুলে ফেলব। তার পরেও ধরুন, ঘটনা ঘটল। আমরা প্রকাশ্যে হঠাৎই গড়িয়াহাট বাজারে দেখলাম কোনো এক মন্ত্রীকে, বাজার করতে এসেছেন। আমরাই তো আদিক্ষেতায় হামলে-হুমলে তাঁকে গজা বানিয়ে দেব।

আঠারোটি শতবর্ষের পরে আরও দু-টি শতশতবর্ষ পেরোল, স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশটির বয়স সত্তর পেরোল, আমরা গরিষ্ঠ অংশ দেশবাসী নিজেদের আজও তৈরি করে উঠতে পারলাম না, গণতন্ত্রের উপযুক্ত করে।                

দেখবেন আড্ডা-আলোচনায় আমরা প্রায়ই জাপানিদের ভূয়সী প্রশংসা করি এই জন্য যে, পারমাণবিক বোমায় ছিন্নভিন্ন একটি জাতি মাত্র চল্লিশ বছর সময়কালে ইলেকট্রনিক্‌স সামগ্রী নির্মাণে বিশ্বের প্রথমে উঠে এসে বাধ্য করে তাদের দিকে সকলের চোখ ফেরাতে। শুধু ইলেকট্রনিক্‌সই নয়, দুরন্ত গতিশীল ট্রেন, শহরজুড়ে জালের মতো বিস্তৃত পাতালরেল, সময়ানুবর্তিতা, আরও কত কী! আর সেই সঙ্গে স্বীকার করে নিই, ওরকম সমস্যায় পড়লে আমরা কিছুই করে উঠতে পারতাম না।

পারিনি তা তো সত্যি। একটা দেশভাগ, ঠাঁইনাড়া সহস্র-লক্ষ পরিবারের ঘা আজও শুকোল? নড়বড়ে হয়ে যাওয়া অর্থনীতি থেকে আইনশৃঙ্খলা যেন আজও সে-ঘটনার অভিঘাত বয়ে চলেছে। এদিকে কেটে গেছে চল্লিশের পরে আরও তিরিশ বছর!    

সদ্য সমাপ্ত ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়েই দেখুন, রাত জেগে খেলা দেখা (তাও তো এবার ভারতীয় সময়ের হিসেবে রাত তেমন গভীর ছিল না, থাকলেও পরোয়া করেছে কে কবে!) এবং তা শুধু দেখেই ক্ষান্ত হওয়া জাস্ট পোষায় না আমাদের। ইশকুলে, বাসে বা আপিসে, মুখে মুখে বা টিভি চ্যানেলে তার হরেক বিশ্লেষণ, কত প্রতিবেদন। সঙ্গে এক চিলতে মন কেমন, কত ছেলেকে ইশকুলে বা পাড়ায় দেখেছি, বল পায়ে এলে যেন জাদু, ঠিক কাটিয়ে নিয়ে গোলের জন্য ঝাঁপাবে। আসলে সব হারিয়ে যায় পেটের তাগিদে, কেউ দেখার নেই। আমাদের দেশ তো আর দক্ষিণ আমেরিকা বা ইওরোপ নয় রে ভাই যে এইসব মণিমাণিক্য খুঁজে বের করে তুলে ধরবে বিশ্ব দরবারে।  

তার মানে এই নয় যে সবটাই অন্ধকার। আলো আছে, আলোর নিজস্ব নিয়মে তা চারপাশ আলোকিত করে, করছেও। আমি কয়েকটি নেহাতই বুনিয়াদি আঁধারকোনায় একটু আলো ফেললাম। একজনকেও যদি এসবের কিছুমাত্র ভাবায়।

সত্তর বছর হয়ে গেল, আমাদের কাছে আজও নির্বাচনের আগে স্বপ্ন ফেরি করতে আসে প্রতিটি রাজনৈতিক দল। আমরা আগের হিসেব মিলিয়ে নিই না। নিলেও বিপুল ছাড় দিই। আমরা তো দিব্যি আছি কলতলার কোঁদল নিয়ে— হিন্দুস্তান পাকিস্তান, ভারত চিন, হিন্দু মুসলমান, কট্টরপন্থা মধ্যপন্থা, উচ্চবর্ণ পিছড়েবর্গ এইসব নিয়ে। কে কত বেশি দেশকে ভালোবাসি তার এক অদেখা দুর্মর প্রতিযোগিতায় হুল্লোড়েই আছি আর কী, নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুলে! দায় অন্যের ঘাড়ে ফেলতে মাঝে মাঝে একটু অভিমান উথলে ওঠে আমাদের: সত্তর বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি।   

ভারী কথা থাক। ধরে নিন, জানতে পারলেন, সামনের নির্বাচনে কোনো দল অংশ নিচ্ছে না। জনগণকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে পাঁচ বছরের জন্য। প্রত্যেকে ভালো মানুষ হয়ে নিজেরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখুন। এই পাঁচ বছর সরকার চালাবে এগজিকিউটিভদের দল। রাজনৈতিক দলগুলি নীরবে নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে কেবল পর্যবেক্ষণ করে যাবে পরের নির্বাচন অব্দি, কোনো প্রতিহিংসার ছক না কষে।                 

জনগণের অবস্থান থেকে ভাবুন, সম্ভব?

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...