রাসসুন্দরী দেবী উনিশ শতকের মাঝামাঝি
তার আত্মকথায় লিখেছিলেন, " পোষা পাখি হইয়া তাদের শরণাগত হইলাম।" মায়ের মৃত্য
শয্যায় তিনি তাকে দর্শন করতে পারেননি, তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন," এই কথাটি আমার
মনে ভারি আক্ষেপের বিষয় হইয়া রহিয়াছে। আমি যদি পুত্র সন্তান হইতাম, তবে আমি যেখানে
থাকিতাম পাখির মতো উড়িয়া যাইতাম। কি করিব, আমি পিঞ্জরাবদ্ধ বিহঙ্গ।"
আগস্ট ২০১৭ তে দমদমের শ্রাবন্তী মিত্র তার ডায়রীতে লিখলেন- সংসারের
পরিস্থিতিতে মন ভালো নেই, মাস্টার ডিগ্রীর পরেও তিনি পড়া চালিয়ে যেতে চান কিন্তু স্বামী
তার পাশে নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহত্যার পথই বেছে নিলেন।
প্রায় দেড়শ বছরের ব্যবধানে এই দুটি
সামাজিক চিত্রের মধ্যে খুব একটা কি অদল বদল ঘটল? বোধহয় না। অথচ এই সময়টুকুর মধ্যে সন্তান
প্রতিপালনসহ সংসারের যাবতীয় দাবী মিটিয়ে নারী কিন্তু ছুঁয়ে ফেলেছে অগ্রগতির সবকটি শিখর।
জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি খেলা সিনেমা সর্বক্ষেত্রেই সে তার সাফল্যের
আলো ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। কিন্তু কেমন সে আলো? সে আলোর উৎসমুখ কতটা সাবলীল কতটা দ্বিধাহীন
কতটা মুক্ত কতটা স্বাধীন- সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
রাসসুন্দরী দেবী যথার্থই বলেছিলেন,
" পুত্র সন্তান হইলে পাখির মতো উড়িয়া যাইতাম।" পাখির মতো উড়িয়া যাওয়া অর্থাৎ
সাবলীল নির্ভার এক স্বাধীন উড়ান আজও আমাদের দেশে এক নারীর ভাগ্যে অতি দু্র্লভ স্বপ্ন
মাত্র। সাম্প্রতিক কালের সমীক্ষায়( এনসি এই আর-ই) দেখা যাচ্ছে, ভারতে প্রতি দশ জন মেয়ের
চার জনের নিজেদের বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলার থাকে না। দশ জনের মধ্যে আট জনকেই চিকিৎসক
দেখাতে গেলে বাড়ির অনুমতি নিতে হয়। দশ জনের মধ্যে ছ জনকেই কোন না কোন ভাবে মাথা ঢাকতে হয় এবং বিয়েতে
গড়পড়তা ৩০হাজার টাকা পণ দিতে হয়। ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৮ জন নারী ধর্ষিতা হয় এবং ১৪ জন
নির্যাতিতা হয়। আমরা এও জানি, কন্যা ভ্রুণ হত্যা, নারী সন্তান হত্যা এবং অনার কিলিং
এর নামে এক বিশাল সংখ্যক নারী হত্যা সংগঠিত হয়ে চলেছে প্রতি মুহূর্তে।
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী
দেশের প্রতিটি নাগরিক আইনের চোখে সমান। জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অংশগ্রহন, সমান সুযোগ সুবিধা, সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ
করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। কিন্তু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক দেশে নারীরা কি পুরুষের সমান
অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে? যদি পারত
তাহলে নারী স্বাধীনতা নামক শব্দবন্ধটি এত জোরাল ভাবে সমাজের বুকে আছড়ে পড়ত না। একটি
স্বাধীন রাষ্ট্রে নারী স্বাধীনতার বদলে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হত।
অর্থাৎ নারীকে এখানে মানুষ নয়, আলাদা শ্রেণী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এবং ঠিক এখানেই
সংবিধান বর্ণিত মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা নারীর ক্ষেত্রে মেকি স্বাধীনতায় পরিনত হয়েছে।
১৮৮৪ সালে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছেন, শিকার
ও খাদ্যসংগ্রহের ভিত্তিতে যেসব সমাজ প্রতিষ্ঠিত,
যেখানে জনজাতির সবাই শ্রম দান করে এবং সব সম্পত্তি সম্প্রদায়ের মালিকানাভুক্ত,
সেখানে নারী কোন দ্বিতীয় স্থান ভোগ করত না। তিনি উল্লেখ করেন," নারীর অধঃস্তনতার
অভ্যুদয় ঘটে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর ভিত্তি করে যখন নির্দিষ্ট শ্রেণীসমাজ গড়ে ওঠে।
তিনি বলেন পুরুষ প্রাধান্য কম বেশি বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতায় পরিলক্ষিত হয়। তা দুই লিঙ্গের
মধ্যে দেহগত বৈশিষ্ট্যের জন্য নয়, বরং কালক্রমে তা ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত হয়ে গেছে।
শ্রেণিবিভক্ত সমাজে পরিবারের ভরণপোষনের দায়িত্ব পুরুষের ওপর বর্তালে নারীর অধঃস্তনতা বিকাশ লাভ করে।"
সাম্যবাদ সূচনা লগ্ন থেকে নারীমুক্তির
কথা বলে আসছে এবং সে এও বলেছে যে, পুঁজিবাদী
সমাজ নির্মূল না হলে নারীর অধঃস্তনতা দূর করা যাবে না। যদিও নারীবাদ তার স্বাধীনতার
আন্দোলনকে স্বতন্ত্র রাখতে চায়। তার আশঙ্কা সাম্যবাদ পুরুষতন্ত্রের এক রূপ। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নারীবাদের তরঙ্গ ধাবিত হয়েছে সমাজের মূল স্রোতে পূর্ন অংশগ্রহনের
দাবীতে।
প্রকৃতির এক অপরিহার্য অঙ্গ হল নারী।
নারী কেবলমাত্র একটি সত্তার নাম নয় বরং সে একটি চালিকা শক্তি যাকে ছাড়া পৃথিবী স্তব্ধ
ও স্থবির। সভ্যতার বিনির্মানে যুগে যুগে পুরুষের পাশাপাশি নারীও অবদান রেখে এসেছে সমানভাবে।
জন্ম দিয়েছে নতুন ইতিহাসের। কিন্তু বিনিময়ে কেবলই জুটেছে অবিচার আর পরাধীনতার শেকল।
মাকড়সার জালের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরেছে নানা সমস্যা আর ততই তলিয়ে গেছে তার
প্রকৃত স্বাধীনতার সুখ ও আনন্দ। জাতিসঙ্ঘের এক সমীক্ষা অনুযায়ী নারী পৃথিবীর দুই- তৃতীয়াংশ
কর্ম সমাধা করে থাকে এবং ৪৫ ভাগ খাদ্য উৎপাদন করলেও তারা আয়ের শতকরা দশভাগ এবং সম্পত্তির
শতকরা এক ভাগ মালিকানা ভোগ করে।
স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়েও যে সকল
সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আজও ভারতের নারীকে পরাধীনতার মোড়কে বাঁচতে হয় সেগুলিকে তিন ভাগে
ভাগ করা যেতে পারে।
(১) পারিবারিক সমস্যা
ক. মানসিক নির্যাতন
খ. শারীরিক নির্যাতন
গ. পারিবারিক বৈষম্য
ঘ. যৌতুক
ঙ. তালাক
চ. অনার কিলিং
জ. নারীর অবমূল্যায়ন
(২) সমাজিক সমস্যা
ক. ইভটিজিং
খ. ধর্ষণ / গণ ধর্ষণ
গ. এডস্ সন্ত্রাস
ঘ. সামাজিক বৈষম্য
ঙ. কর্মক্ষেত্রের অভাব ও বৈষম্য
ও যৌন হেনস্তা
(৩) অর্থনৈতিক সমস্যা
ক. সম্পত্তির অধিকার বঞ্চিত
খ. উপার্জনের ক্ষেত্রে বৈষম্য
গ. উত্তরাধিকার বঞ্চিত
এইসব বিবিধ বাধার মধ্যে দিয়েই নারীর
স্বাধীনতা দিনের পর দিন সোনার পাথর বাটিতে
পরিনত হয়েছে।
নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে রোকেয়া বিংশ
শতাব্দীর প্রথমার্ধে (১৮৮০- ১৯৩২) বলেন," স্বাধীনতার অর্থ পুরুষের ন্যায় উন্নত
অবস্থা বুঝিতে হইবে।.............. ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া
মরি কেন, কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজেরা অন্নবস্ত্র
ও উপার্জন করুক।" আজ ২০১৮ সালে এসে নারী চায়, তাকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হোক, নারী হিসেবে
নয়। আর এই মানসিক পরিবর্তন যদি প্রকৃতই সম্ভব
হয় তাহলে তারই মধ্যে সম্ভবত নিহিত আছে নারীর
পরাধীন সমস্যার বহু সমাধান।
আসুন, আমরা একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলি,
যেখানে দখলবাজি, জবরদস্তি, অধঃস্তনতা, পরাধীনতা থাকবে না এবং গড়ে উঠবে প্রকৃত সাম্যবাদ
ও মানুষের স্বাধীনতা। আমরা সেই দিনটার জন্য অপেক্ষা করি- যেদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ
বুঝতে পারবে, নারী হল অর্ধেক আকাশ। সভ্যতার
অগ্রগতিতে সেদিন নারীর সাবলীল দ্বিধাহীন মুক্ত অংশগ্রহন পুরুষকেও পূর্ণতা দেবে; সে
পাশে পাবে তার সহযোদ্ধাকে, তার জীবনসঙ্গীকে।
No comments:
Post a Comment