Saturday, August 11, 2018

ধারাবাহিক গদ্য চন্দন ঘোষ




চিকিৎ"শকিং"ডায়েরিঃ যে তোরে পাগল বলে


সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারের বাইরে বসে থাকার অভিজ্ঞতা সৌম্যর বহুদিনের। ডাক্তারি পড়তে আসারও অনেক আগের। ফুলদাকে নিয়ে তখন ওকেই যেতে হত ডাঃ নন্দীর চেম্বারে। ফুলদা খুবই নিরীহ মানুষ। সে মানুষের কপাল দেখে কী করে জানি বিচিত্র সব ভবিষ্যৎবাণী করতে পারত। আর আশ্চর্য ব্যাপার! কয়েকটা খেটেও যেত। তারপর রাস্তা থেকে নোংরা ময়লা পাগল টাইপের মানুষদের ধরে এনে আচ্ছা করে সাবান দিয়ে চান করাতো। লোকজন জড়ো হয়ে যেত। গোল বাধল যখন ও লাল সিঁদুরের টিপ পরে বন্ধ ঘরে কালী কালী বলে চিৎকার করে স্বয়ং মা কালীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল আর মাঝে মাঝে রাত্তিরে খয়রামারি শ্মশানে হাজির হওয়া শুরু করল। সেই থেকে নন্দীসাহেবের চেম্বারে যাতায়াত শুরু হয়েছিল সৌম্যর। তবে ফুলদার জন্য নন্দীসাহেবের ওই শক থেরাপিটা সৌম্যর একেবারে পছন্দের ছিল না।
#
সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে বসে থাকতে থাকতে সৌম্যর কখনও কখনও সন্দেহ হত নিজেরই ওপর। সে কী নিজেও খুব নর্মাল। বস্তুত যে সব মানুষেরা নিজেদের নর্মাল ভাবে তারা কী সত্যিই তাই? ভেবে দেখা দরকার যে তথাকথিত পাগলদের যে জগত আছে, সেখান থেকে আমাদের মানে তথাকথিত সুস্থ মানুষদের কেমন দেখায়। অ্যাবনর্মাল মনে হয় না তো। সৌম্যকে হস্টেলে সবাই ছিটেল বলত। পাশ করার পর, চাকরি পাবার পর এমনকি বিয়ে করবার পর তার এই ভেতরের পাগল পাগল ভাবটা যেয়েও যায়নি। স্বাতী তো এই জন্যেই তাকে পাগলা ডাক্তার বলে খেপায়। পাগলদের প্রতি তার প্রবল টান।  পাগলদের জগতটা একটা গহীন রহস্যময় দেশ যেন। সাধারণ মানুষের কাছে সেই জগতের রাস্তা বন্ধ।
#
ইদানীং যে সৌম্যকে ডাঃ ঘোষের চেম্বারে আসতে হচ্ছে সেটা অবশ্য স্বাতীর বোন ভাস্বতীর জন্য। দুর্গা প্রতিমার মতো চেহারা ছিল তার। বেথুন স্কুলের মেধাবী ছাত্রী ছিল একদিন। কী যে হল বাবার চাপে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েই ফেঁসে গেল সে। একটা অলীক প্রেমে ফাঁদে আটকে গেল তার জীবন। ছেলেটির দিক থেকে হয়ত ব্যাপারটা প্রেমই ছিল না। তবু আজও সেই বিদেশে পাড়ি দেওয়া ছেলেটিকে সে ভুলতে পারে না। সবাইকে ধরে ধরে বলে বেড়ায়, জানো কাল আমার বিয়ে। অভিজিৎ ফোন করেছিল। ও ইউ এস এ থেকে আজই ফিরছে। কালই আমাদের রেজিস্ট্রি। সৌম্যদা, শুনছ কাল আমার বিয়ে। অভিজিৎ আসছে। এইভাবে কাল্পনিক অভিজিতের সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথনে তার নিষ্ফল দিনগুলো কেটে যায়।
#
এখন ডাঃ ঘোষের চেম্বারে বসে আছে সৌম্য। চারদিকে অদ্ভুত সব মানুষ। ওদের মাথার ভেতরটা খুলে দেখতে চায় সৌম্য। ওদের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়। পারে না। এই মূহুর্তে একজন মানুষ ওকে লক্ষ করছে। ভারি অর্থপূর্ণ দৃষ্টি তার। নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে লোকটা সৌম্যর পাশে এসে বসে। কোন ভণিতা না করেই শুরু করে, আচ্ছা এই যে ডাক্তার, এর কী অনেক বড় হাত? সৌম্য বলে, এমন আর বড়ো কী? এই আমারই মতোই লম্বা। তবে নলেজ অনেক। ঠাট্টাটাকে আমল না দিয়ে লোকটা বলে, তাহলে আমাকে সারাতে পারছে না কেন? "পারবে, পারবে, সময় হয়নি এখনও। সময় না হলে কিচ্ছু হয় না"। "আর কবে সময় হবে, তিন বছর তো হয়ে গেল। আমি আর এখন যা যা করতে চাই তার কিচ্ছু করতে পারি না।" "কী কী করতে চান আপনি?" "চাকরি করতে চাই আবার, একটা বড়ো বড়ো জানলাওলা বড়ো একটা খোলামেলা ঘরে থাকতে চাই, মার জন্যে অনেক শাড়ি গয়না কিনে দিতে চাই, একলা থাকতে আমার খুব ভয় করে, জানেন, আমার একজন লোক চাই।" সৌম্য কী বলবে বুঝতে পারে না। বলে, পাবেন, পাবেন, ডাক্তারকে আমি বলে দেব। এরপরই লোকটা সেই অমোঘ প্রশ্নটা করে বসে, আপনি কী করেন? ডাক্তার সৌম্য এবার প্রমাদ গোনে। বলে, এই ব্যবসা বাণিজ্য করি আর কী। "কিসের কারবার আপনার?" অনেক ঢোঁক গিলে সৌম্য বলে, এই মানুষের কারবার, মানুষ এধার ওধার করার কারবার। লোকটা বল্ল, যাঃ তাই হয় নাকি। আপনি লুকোচ্ছেন। আপনি কী এন জি ও করেন? আমার একটা এন জি ওর দরকার। জানেন, আমার কাউন্সেলিং দরকার। এই ডাক্তার আমাকে কাউন্সেলারের খোঁজ দিতে পারবে? কী বলেন, পারবে?সৌম্য বলে, আলবত পারবে। লোকটা হঠাৎ বলে, আপনি কাকে দেখাতে এসেছেন? সৌম্য নিজের বুকে আঙুল দিয়ে বলে, আমাকে। লোকটা সন্দেহের চোখে তাকায়। তারপর আলতো করে বলে, যাঃ! কিন্তু আপনার সঙ্গে ওরা কারা? সৌম্য বলে, আমার বউ আর শ্যালিকা। লোকটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। "জানেন, আমার কোনো বউ নেই। আচ্ছা, আপনি কি আপনার বউকে দেখাতে এনেছেন?" সৌম্য কী বলবে ভেবে পায় না।
#
ঠিক তখনই হঠাৎ ভাস্বতী বলে ওঠে, সৌম্যদা, শিগগির চল। এয়ারপোর্টে অভিজিত এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই মাত্র ফোন করল। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আজই তো আমাদের বিয়ে। সৌম্যদা শিগগির চল।  না হলে প্লেন ছেড়ে দেবে। সৌম্য কী বলবে বুঝতে পারে না। অমনি চারদিকে যেন একশোটা বেল বেজে ওঠে। অদৃশ্য একটা অ্যাড্রেসিং সিস্টেমে শোনা যায়, ভাস্বতী সেন, ভাস্বতী সেন, কাম ইন, প্লিজ কাম ইন।

(ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment

'রাষ্ট্র মানেই পরবাসী নিজের ঘরেতে ' : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র  " It's coming through a hole in the air,  from those nights in Tiananmen Square.  It's coming ...