ক্রোড়পত্র
নির্জন এক কলকাতায় বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় প্রিয় বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে সিগারেটের
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাবার মত স্বাধীনতা খুব বেশী একটা পাওয়া যায় না। সে রকমই একটা
সন্ধ্যা পেয়েছিলাম সে দিন। তারামন্ডলের গোল ও বিষন্ন গম্বুজ পেরিয়ে ধর্মতলার দিকে মুখ
করে দাঁড়ালে দেখা যায় ডান দিকে প্রবেশ করেছে অভিজাত হো চি মিন সরণী। একটি কাব্যগ্রন্থের
আনুষ্ঠানিক প্রকাশ উপলক্ষ্যে কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ। আই সি সি আর থেকে বেরিয়ে এসে আমরা
থমকে গেছিলাম। আশ্চর্য শান্ত হয়ে গেছে বৃষ্টিধোয়া কলকাতা। সে আমাদের গ্রহণ করতে চায়
না অনেক সময়েই। আজ সে বুকে টেনে নিয়েছে আমাদের। আমি আর বন্ধু কুন্তল (মুখোপাধ্যায়)
সিগারেট ধরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিলাম। হুসহাস করে বিদেশী গাড়ি চলে যাচ্ছে পাশ
দিয়ে। থাই-স্পা’র থেকে বেরিয়ে আসছে কাঁধ-ছাপানো চুলের সুন্দরীরা। একটা বিশাল বাড়ির
পেটের মধ্যে ক্রমাগত উঠছে আর নামছে এলিভেটর। তার ওপেক-কাঁচের ভিতর ঘামের মত জলীয় বাষ্প।
সে দিকেই তাকিয়ে ছিলাম আমরা।
হঠাৎ আমাদের সেই reverie ছারখার
করে দিয়েছিল এক নীল পোষাকের মানুষ। খেয়াল করিনি যে আমরা Consulate General of the
United States of America-র গেটের ঠিক উলটো দিকে দাঁড়িয়ে। নিশ্চয় ভয়ানক কোনও সন্ত্রাসবাদীদের
মত লাগছিল আমাদের। প্রায় হটিয়েই দেওয়া হয়েছিল আমাদের। তাকিয়ে দেখেছিলাম সেই বিশাল বাড়ির
পাহারায় আমার দেশের সশস্ত্ররক্ষীর দল। এমনিতেই কলকাতায় গেলে আমার স্বপ্রতিভতা হারিয়ে
যায়। বাধ্য নাগরীকের মত বলে ফেলেছিলাম, ‘তা হলে উলটো দিকের ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়াই?’
লোকটি কিছুক্ষণ থমকে থেকে বলেছিলেন, ‘না, ওদিকেও আপনারা দাঁড়াতে পারবেন না… এটা
হাই-সিকিউরিটি জোন… কিছুটা এগিয়ে গিয়ে … ঐ যে গেটটা দেখছেন… ওখানে গিয়ে দাঁড়ান…’।
ঠিক এই সময়েরই কিছুটা আগে-পরে
সংসদকক্ষ থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে হয়তো একটু একটু করে ক্রমশ খিদের জ্বালায় মৃত্যুর
মুখে ঢলে পড়ছিল সেই তিন বোন। হয়তো তখন থেকেই ব্লুপ্রিন্ট সাজানো হচ্ছিল, এই মৃত্যু
থেকে ঠিক কতটা মাইলেজ পাওয়া যেতে পারে। বা এই মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে কী অবলীলায় ছুঁড়ে
দিতে হবে এই স্টেটমেন্ট, ‘বাচ্চাগুলোর মা মানসীক ভারসাম্যহীন… আসলে মায়ের উদাসীনতাতেই
মেয়েগুলো…’। পড়েছিলাম, কী হতভাগ্য সেই দেশ, যাকে কেবলই বীরের জন্ম দিতে হয়। প্রকাশ্যে
ধূমপান (যদিও সেটা প্রকাশ্যে চুরির থেকে বড় অপরাধ নয় সম্ভবত), জুতো-ব্যারনের অপহরণ-কান্ড,
হাই সিকিউরিটির বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি ইত্যাদির বাইরে দাঁড়িয়ে আজ বলতে ইচ্ছে করছে, কী
হতভাগ্য সেই দেশ, যখন নিজের দেশের মাটির দিকে বন্দুক তাক করে থাকতে হয় স্নাইপারকে,
যখন নিজের দেশের সংসদের অদূরে খিদে পেটে নিয়ে মরে যায় শিশু … আর নিজের শহরে এক নির্জণ
সন্ধ্যায় বৃষ্টিভেজা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরানোর স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে একজন
তরুণ কবি!
আমি কবি নই; কিন্তু কুন্তল তো কবিই।
২
মৃদু ও লঘু এক ধরণের পরাধীনতার মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রবল
বানিজ্য সম্ভাবনা। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বানিজ্য। এটিকেও আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চারিয়ে
দেওয়া হয়। চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভার্চুয়াল জগত সব থেকে বেশী যে ক্ষেত্রটায়
সুকৌশল প্রবেশ করেছে তার মধ্যে কাম-বিপনন
অন্যতম। লক্ষ লক্ষ সাইট। হরেক কিসিমের কাম-বিপননের উৎসব।
এর মধ্যে
একটা ক্যাটেগোরি আজকাল বিপুল ব্যাবসা করে। সেটি ফেমডম। নারী শাসিত সেই উৎপিড়নের জগত।
একটা সময় পর্যন্ত আফ্রিকা ও আমেরিকার কালো মানুষগুলোকে এই খেলায় ব্যাবহার করা হত।
ইউরোপের ও এশিয়ার বিপুল বাজারে সাদা চামড়ার মানুষকে নিয়ে যে ভার্চুয়লা ব্যবসা,
সেটা আর কাজ করছিল না তেমন। যে dividend
তার দেবার কথা তা ক্রমশ শুকিয়ে আসছিল। এই monotony থেকে বের হওয়ার কারণে স্বাভাবিক
ভাবেই কালো চামড়ার মানুষগুলোকে বেচা শুরু হয়। এই একটা মনস্তাত্ত্বিক দিকও আছে। কয়েক-শো
বছর ধরে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ দিয়ে শুষে নেওয়া গেছে যে মানুষগুলোকে যৌন-বানিজ্যের
ক্ষেত্রে তাদের কোথাও একটা জিতিয়ে দেওয়া হল। এই জিতিয়ে দেওয়াটা কিন্তু কোনও
empowerment নয়। আসল খেলাটা লুকিয়ে থাকে এর পরেই। এটি আসলে স্ক্রিনের উলটো দিকে বসে
থাকা, ক্ষুধার্ত চোখ নিয়ে বসে থাকা মানুষগুলোকে এক ধরণের মর্ষকামের আনন্দই দেয়। জু-ফিলিয়াকের
সঙ্গে সেখানে আর কোনও পার্থক্য থাকে না। সেখান
থেকেই লুকিয়ে থাকা এই সব সাইটের ভাঁড়ারে ভরে ওঠে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার।
ফেমডম অনেকটা সেই কাজটাই করে।
প্রথম মাত্রায় মনে হওয়া স্বাভাবিক যে অন্তত এই ক্ষেত্রে তাহলে স্বাধীনতার এক উদযাপন
করছে মেয়েরা। পারভার্শন অনেক বড় শব্দ। হাজার বিতর্ক আছে সে্টা নিয়ে। মানে কোথ থেকে
সীমারেখা টানা হবে তা নিয়ে। কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত; এটি পারভার্শন হলেও নিশ্চিত
যে, এই পারভার্শনটাকেও রীতিমত মার্কেট সার্ভে করে, হিসাব কষেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছদ্ম
পরাধীনতার আড়ালে বানিজ্যের সেই সম্ভাবনাই সেটা করেছে।
এই ছদ্ম-স্বাধীনতা (যা আবার
প্রকারান্তরে পরাধীনতার বেড়াজাল তৈরী করতে পারে) কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের কথাবার্তার
মধ্যেও ছড়িয়ে থাকে। যেমন, ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’। যদিও এখন এটা
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্যাবহার করা হয়, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে এই
কথাটার মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই নারীই। টিভির বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে দেখুন।
চাকুরীরতা মায়েরা বাড়ি ফিরেই সন্তানের জন্য দু’মিনিটে বানিয়ে ফেলছে নুডলস। তার
কোনও ক্লান্তি নেই। নিজের শয়নভঙ্গিমার মত দু-দন্ড নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার সহজ
কোনও স্বাধীনতা নেই তার। ডিটারজেন্টে ছেলেমেয়ের জামাকাপড় ঝকঝকে করে কেচে, সাফসুতোর
করে, ছুট্টে উঠে পড়ছে বাসে। ট্রেনে। যে সংসার সে ফেলে আসছে বাড়িতে সে দিকে তাকিয়ে
তার ঠোঁটের কোনে একটু মায়াবী হাসি। আর কোথাও যেন একটু হাহাকারও। তার রোজগারের একশো
শতাংশ টাকাই খরচ হবে পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য। তবুও নারীর সঙ্গে এই ‘সুখী গৃহকোন,
শোভে গ্রামোফোন’-মার্কা ইমোশনটুকু জুড়ে না দিলে ব্যবসা হয় না। কোথাও যেন এই
বার্তাটা ছড়িয়ে দেওয়াও যে, নারীরা আসলে এই মৃদু পরাধীনতাটাই চায়। নেহাত বাধ্য হয়েই
তাকে সাময়ীকভাবে এই বাঁধন ছেড়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু দিনশেষে সে আবার ঐ রূপেই ফিরে
যাবে।
এবার আসা
যাক আসল কথায়। এখানেও কিন্তু সেই দশভুজার কনসেপ্ট। তুমি দশ হাতে সব কাজ সামলাতে
পারলেই তুমি সার্থক। মানে তুমি রান্না কোরো, সঙ্গে চুলও বেঁধো। বেশ, প্রতিদিনই
তুমি এই কাজটা করো। করেই যাও। কিন্তু একদিন যদি তুমি এই কাজটা না করতে পারো তা হলে
তুমি আর সেই প্রবাদের মানুষটি রইলে না। তুমি এলেবেলে এক লোক হয়ে গেলে। তুমি হাজার
হাজার সাধারণ মানুষের একজন হয়ে গেলে। এর পর রইল আরেকটি সম্ভাবনা। ধরা যাক তুমি
একটি কাজই বেশ ভালো বা মোটামুটি বা বেশ খারাপভাবেই পারো। মানে দশদিক সার্থকভাবে
সামলানোর মত ক্ষমতা তোমার নেই। তাহলে তুমি কোনও হিসাবেই আসবে না। সারা পৃথিবী এতদিনে
জেনে গেছে যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।
যে তুমি রেঁধে আর চুল বেঁধে মানুষজনকে রীতিমত তাক লাগিয়ে
দিচ্ছ, সেই তুমিও মনে রেখ, এই দশভুজের মধ্যে দিয়ে তোমার একটা ক্ষমতায়ণ হয়েছে
নিশ্চিত। কিন্তু প্রতিটা মূহুর্ত সেই দশটা হাত কে ব্যাবহার করতে করতে তুমি
সাংঘাতিকভাবে পরাধীন।
কিছুদিন আগে খবরের কাগজ থেকে
শুরু করে সোস্যাল মিডিয়াগুলিতে একটি ছোট্ট ভিডিও ও খবর উল্কার গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
র্যাম্পে হাঁটতে হাঁটতে একজন মা তার সন্তানকে স্তন্যপান করাচ্ছেন। হাজার হাজার ওয়াটের
আলোর ঝলকানির মধ্যে … ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মধ্যে মার্জার ভঙ্গিতে হেঁটে চলা সেই মায়ের
স্তনবৃন্তে মুখ রেখেছে শিশু। একটা মেসেজ ছড়িয়ে পড়েছিল। স্তন্যপান শিশুর জন্মগত অধিকার।
স্তন্যপান করানোর স্বাধীনতাও মায়ের থাকা দরকার। আমাদের মত দেশের কথা ছেড়েও দেওয়া যাক;
এমনকি ‘ফার্স্ট ওয়ার্ড’ দেশগুলিতেও মায়েদের প্রকাশ্যে স্তন্যপান করানো নিয়ে হাজার ট্যাবু
। হাজার লোকলজ্জা। সেটাকে ভেঙে ফেলাই দরকার।
কিন্তু ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের র্যাম্পকেই কেন বেছে নেওয়া হল? হঠাৎ একটা সম্ভাবনার
কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছি কিছুটা। এটাও সেই দশভুজার কনসেপ্ট নয় তো? ফ্যাশন র্যাম্পে
হাঁটার মধ্যে দিয়ে সত্যিই কি ক্ষমতায়নের স্বাদ পেয়েছে নারীরা? নির্বোধ মাংসের প্রদর্শণকে
যদি সৌন্দর্যের উদযাপন বলে চালিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আরশোলাকেও পাখি বলে মেনে নিতে হয়।
এবার তুমি সেখানে হাঁটতে হাঁটতে স্তন্যপান করানোর মত একটা মহান বিষয়ের শরিক হলে। এই
বিপ্লবের মাধ্যমে আরো একটা বিষয়কে legitimacy দেওয়া গেল। সেটা হল, যে মা র্যাম্পে
হাঁটে সেই মা শিশুকে স্তন্যপানও করায়। এবং অনিবার্যভাবে যে বিতর্কটাকে পিছনে ঠেলে দেওয়া
গেল সেটি হল, বিকিনি পরা মহিলার ঐ অদ্ভুত ভঙ্গিতে কার্পেটের ওপর দিয়ে দু’পাশে কৃত্রিম
দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে হেঁটে যাবার মধ্যে দিয়ে আসলে কী উদযাপিত হয়। অনেকে তর্ক করতেই পারেন,
একজন পুরুষ যদি অন্তর্বাস পরে প্রকাশ্যে ঘুরত পারে তাহলে একজন নারী কেন সেই স্বাধীনতা
ভোগ করবে না। আলবাৎ কথাটায় যুক্তি আছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সেই স্বাধীনতা কি শুধুমাত্র
বিকিনি পরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে?
সেদিন টিভিতে র্যাম্পে-হেঁটে-যাওয়া
ঐ বিদেশী মহিলার সংবাদ’টি দেখানো হচ্ছিল। মাতৃত্বের চমৎকার প্রকাশ। কিন্তু সবিস্ময়ে
দেখলাম, মহিলার হ্রস্বতম পোষাকের কোথাও কোথাও প্রজাপতি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই প্রজাপতিটি
উড়েই চলেছে। পঁচানব্বই শতাংশ উন্মুক্ত নারী শরীরের পাঁচ শতাংশকে ঢাকা দিতে প্রাণপনে
ডানা ঝাপটে চলেছে সেই প্রজাপতি। ব্লার করার জন্য তার ডানা ঝাপটানো।
র্যাম্পে কিন্তু কোনও প্রজাপতি
ছিল না। সেখানে ছিল অনেক ক্যামেরা আর হাজার হাজার চোখ।
পরাধীনতা আর ছদ্ম-স্বাধীনতার
মধ্যে আসলে কি এটুকুই তফাৎ? ঐ প্রজাপতি ওড়া আর না ওড়ার মধ্যে শুয়ে থাকা একটা অদৃশ্য
লাইন! যেটিকে দেখা যায় না, কিন্তু যেটি আছে। এবং প্রবলভাবেই আছে।
No comments:
Post a Comment